ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

ভূরাজনীতির অন্তঃপুরে

শান্তির নোবেলজয়ী প্রধানমন্ত্রীর দেশে অশান্তির দাবানল

শান্তির নোবেলজয়ী প্রধানমন্ত্রীর দেশে অশান্তির দাবানল

ইলিয়াস হোসেন

প্রকাশ: ২৬ নভেম্বর ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২১ | ১৪:২০

মাত্র দু'বছর আগের কথা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার গ্রহণকালে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ বলেছিলেন, 'যুদ্ধ মানুষকে আগ্রাসী বানায়। মানুষ নিষ্ঠুর, বর্বর হয়।'

সেই বক্তব্যের এক বছর না যেতেই তিনি নিজ জনগণের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ শুরু করেন। এর বছর খানেক পরে ঘটে আরও অভাবনীয় ঘটনা। বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসে দৃশ্যত প্রথম কোনো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ঘোষণা দিয়েই সরাসরি রণাঙ্গনে থেকে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন।

দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী টাইগ্রিস পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ) দমনে তিনি নজিরবিহীন এ পদক্ষেপ নিয়েছেন। তবে বিশ্নেষকরা বলছেন, এ যুদ্ধে তার জয়ের কোনো গ্যারান্টি নেই। প্রাণহানি ছাড়া তার এ অবিমৃষ্যকারিতা কার্যত কোনো সমাধান দেবে না। আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল এ দেশটির গৃহযুদ্ধ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আবির যুদ্ধ-উন্মাদনায় আফ্রিকার শৃঙ্গে (হর্ন অব আফ্রিকা) বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে বিশ্নেষকরা সতর্ক করে দিয়েছেন।

ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনী, তাদের মিত্র মিলিশিয়া বাহিনী এবং দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় বিদ্রোহীদের মধ্যে যুদ্ধে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হয়েছেন ২০ লাখের বেশি মানুষ। ১০ লাখের বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষাবস্থায় পড়েছেন। বিদ্রোহী বাহিনীর পাশাপাশি সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধেও ধর্ষণ ও গণহত্যার অভিযোগ করেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। এই মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেই সরকারি বাহিনী ও টিপিএলএফ যোদ্ধাদের মধ্যে লড়াই তীব্র হচ্ছে।

যুদ্ধ-উন্মাদনা উস্কে দিয়ে ৪৫ বছর বয়সী নেতা আবি বলেছিলেন, 'আমরা শত্রুদের গোরস্তানে পাঠাতে আমাদের রক্ত ও অস্থি দিয়ে ইথিওপিয়ার মর্যাদা ও পতাকা রক্ষা করব।' তবে তার হুঙ্কারকে অসার প্রমাণ করে গত জুনে বিদ্রোহী বাহিনী টাইগ্রে অঞ্চলের বেশিরভাগের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর তারা সরকারি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে রাজধানী আদ্দিস আবাবার কাছের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর কবজায় নেয়। পরে বিদ্রোহী বাহিনী রাজধানীর কাছাকাছি চলে আসায় আবি সরকার এ মাসের শুরুতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। উপায়ান্তর না পেয়ে আবি জনগণকে দেশ রক্ষায় অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ারও আহ্বান জানান।

যে কোনো মুহূর্তে টাইগ্রে বিদ্রোহীরা রাজধানীর দিকে অগ্রসর হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ অবস্থার মধ্যেই বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াইরত সরকারি বাহিনীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আবি বুধবার যুদ্ধক্ষেত্রে যোগ দিয়েছেন।

গত সোমবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেছিলেন, 'আমি আগামীকাল থেকে প্রতিরক্ষা বাহিনীর নেতৃত্ব দেব।' তবে সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবি কোথায় অবস্থান করছেন, তা স্পষ্ট নয়। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম তার রণাঙ্গনে অবস্থানের খবর দিলেও লড়াইয়ের মাঠে তার ছবি প্রকাশ করেনি। কর্মকর্তারাও তার অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে চাননি।

দেশটিতে লড়াই তীব্রতর হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার তাদের নাগরিকদের ইথিওপিয়া ত্যাগ করতে বলেছে। যুদ্ধাবস্থার কারণে জার্মানি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নিচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সংকটের কূটনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, ইথিওপিয়ায় চলমান গৃহযুদ্ধের কোনো সামরিক সমাধান নেই। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও দ্রুত যুদ্ধ সমাপ্তির আহ্বান জানিয়েছেন।

সংস্কারক থেকে অস্পৃশ্য নেতা: ২০১৮ সালে আবি ইথিওপিয়ার ক্ষমতায় আসার পর প্রতিবেশী ইরিত্রিয়ার সঙ্গে দুই দশক ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটে তারই হাত ধরে। ফলে ক্ষমতায় আসার মাত্র এক বছরের মাথায় শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান তিনি।

গণতান্ত্রিক সংস্কার, রাজবন্দিদের মুক্তি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাসহ নানা পদক্ষেপ নিয়ে আবি সারা বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। তবে এখন তিনি আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। জাতিসংঘের ১৬ কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে আবি সরকার। বিদ্রোহী টিপিএলএফকে দমন করতে গিয়ে তিনি এখন এক অস্পৃশ্য নেতা।

টিপিএলএফের উত্থান ১৯৯১ সালে গেরিলা আন্দোলনের মাধ্যমে। পরে তারা তিন দশক দেশ পরিচালনা করে। কিন্তু ২০১৮ সালে আবির কাছে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা হারায় দলটি। ২০১৯ সালে টিপিএলএফ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন আবি। সমালোচকরা বলছেন, এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল আবির একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা। তিনি নিজেকে সম্রাটের আসনে বসাতে চান।

নিজ দেশে জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পাশাপাশি আবি প্রতিবেশীদের সঙ্গেও বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করেই নীল নদের পানি প্রবাহ ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত করে অতিকায় রেনেসাঁ বাঁধ চালু করেছে তার সরকার। ফলে মিসরসহ কয়েকটি দেশ অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। এসব দেশও বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে বলে আবি সরকারের অভিযোগ।

আবি সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসুসের সঙ্গেও বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। এক সময় টিপিএলএফ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন আধানম। টিপিএলএফের জন্য অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টার জন্য তাকে অভিযুক্ত করেন ইথিওপিয়ার সেনাপ্রধান। তবে ওই অভিযোগ অস্বীকার করেন আধানম।

আবি এখন আন্তর্জাতিক দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও তার পাশে দাঁড়িয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। আলজাজিরার এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, আবি সরকারকে সামরিক রসদ দিচ্ছে আমিরাত। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে ৯০ বার বিমান চলাচল করেছে দুই দেশের মধ্যে, যার অনেকগুলো ছিল গোপনীয় মিশনে।

ভয়াবহ পরিণতির শঙ্কা: ইথিওপিয়ার সংঘাত দীর্ঘ হলে এর ভয়াবহ প্রভাব পড়বে প্রতিবেশী ইরিত্রিয়া, সুদান ও কেনিয়ায়। এসব দেশেও শরণার্থী ও অস্ত্রশস্ত্র ছড়িয়ে পড়বে। বাড়বে উদ্বাস্তের সংখ্যা। সংঘাতের ফলে আল-শাবারের মতো জঙ্গি সংগঠন শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। এর ফলে সোমালিয়া থেকে তাদের তৎপরতা ইথিওপিয়া ও সুদানেও বিস্তৃত হতে পারে।

এতে 'আফ্রিকার শৃঙ্গের' তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ দেশ জিবুতি ও সোমালিল্যান্ডে সন্ত্রাসবাদ দেখা দিতে পারে। গণতন্ত্রের দাবিতে উত্তাল সুদানে এর জেরে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে ইথিওপিয়ার। সেখানে ৮০টির মতো নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী রয়েছে। এসব গোষ্ঠী একটির বিরুদ্ধে আরেকটি লেগে থাকতে পারে। ফলে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে দেশটি ক্ষতবিক্ষত এবং ভেঙে পড়তে পারে।

নিউইয়র্ক টাইমসে এক নিবন্ধে ইথিওপিয়া বিশেষজ্ঞ আওল আলো লিখেছেন, দু'পক্ষের মধ্যে অবিশ্বাস এতই চরমে যে, তাদের মধ্যে শান্তিচুক্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ। আবি বিদ্রোহীদের 'আগাছা' ও 'ক্যান্সার' বলে মন্তব্য করেছেন। আর বিদ্রোহী নেতারা আবিকে বলছেন 'ফ্যাসিস্ট'।

আরও পড়ুন

×