ভূরাজনীতির অন্তঃপুরে
বৈষম্যের নয়া শিকলে কাশ্মীর

মাহনুর ইসলাম লিজা
প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২২ | ১২:০০
প্রকৃতির ভূস্বর্গ হিসেবে পরিচিত কাশ্মীর আজ বিভিন্ন কারণে নরকে পরিণত হয়েছে। গুলি, বোমার আওয়াজ ও বারুদের গন্ধে শান্ত, স্নিগ্ধ, নির্মল কাশ্মীর উপত্যকা আজ অশান্ত ও উত্তপ্ত। ভারত, পাকিস্তান আর চীনের আগ্রাসী মনোভাবে নিজেদের ঐতিহ্য হারাতে বসেছে সৌন্দর্যের এই লীলাভূমি। এর ফলে কাশ্মীরিরা পড়েছে মহাসংকটে। আতঙ্কের সঙ্গে সেখানে বাস করছেন সাধারণ মানুষ। বাঁচার জন্য প্রতিদিনই যুদ্ধ করে যেতে হচ্ছে তাদের।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারত তাদের কাশ্মীর নীতিতে বড় পরিবর্তন আনে। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করা হয়। রাজ্যটিকে দ্বিখণ্ডিত করে 'জম্মু ও কাশ্মীর' এবং 'লাদাখ' নামে দুটি আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয়। রাজ্য দ্বিখণ্ডিত হওয়ার পর এই কমিশন জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভার সীমানা পুনর্গঠনের কাজে হাত দেয়। গত ডিসেম্বর মাসে কমিশন সুপারিশ করে, নতুন এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিধানসভার মোট আসন বাড়িয়ে করা হবে ৯০। এর মধ্যে জম্মু অঞ্চলে বাড়বে ছয়টি আসন। ৩৭ থেকে বেড়ে এই অঞ্চলের মোট আসন হবে ৪৩। জম্মুর মোট জনসংখ্যা ৫৩,৫০,৮১১। অন্যদিকে, কাশ্মীর অঞ্চলে একটি আসন বেড়ে হবে ৪৭। কাশ্মীরের মোট জনসংখ্যা ৬৯,০৭,৬২৩। এই প্রস্তাব কার্যকর হলে জম্মু ও কাশ্মীরের মধ্যে আসনসংখ্যার ব্যবধান ৯ থেকে কমে ৪-এ দাঁড়াবে। সরকার গঠনে হিন্দুপ্রধান জম্মুকে সুবিধা পাইয়ে দিতেই বিজেপি এই আসনবিন্যাসের দিকে এগোচ্ছে বলে উপত্যকার রাজনীতিকরা অভিযোগ করেছেন। আর এর মধ্য দিয়ে জননীতি নয়, রাজনৈতিক বিভাজনকেই ইস্যু করছে বিজেপি।
কাশ্মীর এমন স্থানে রয়েছে যার চারপাশে বেষ্টনী করে রেখেছে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও চীন। তবে কাশ্মীর সংকট নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের সমস্যা চিরচেনা। বর্তমানে এ সমস্যা শুধু ভারত-পাকিস্তানের স্বার্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এ সমস্যা দক্ষিণ এশিয়াসহ সমগ্র বিশ্বের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে এ সমস্যার নেপথ্যে রয়েছে বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থ। এ সমস্যাকে জিইয়ে রেখে তারা তাদের অস্ত্র ব্যবসার প্রসার ঘটাতে চায়।
ভারত ও পাকিস্তান আলাদা দেশ হওয়ার পর কাশ্মীরও দুই ভাগ হয়ে যায়। প্রতিবেশী পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই দেশের নিয়ন্ত্রণে যাওয়া কাশ্মীরের দুই অংশে আসে আলাদা শাসননীতি। জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের তিন বিভাগের মধ্যে কাশ্মীরের জনসংখ্যার অধিকাংশ মানুষ মুসলিম। অন্যদিকে জম্মুতে বসবাসকারী মানুষের অধিকাংশই হিন্দু। লাদাখে হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের পাশাপাশি বৌদ্ধ ধর্মের মানুষের উপস্থিতি রয়েছে।
কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তানের দুই রাষ্ট্রের পরস্পরবিরোধী অবস্থা, দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারার মধ্যে কাশ্মীর সমস্যার মূল কারণ লুকিয়ে রয়েছে। জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি নয়াদিল্লির। এ ছাড়া পাকিস্তানের মদদেই কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী কাশ্মীরকে অশান্ত করে তুলছে বলে অভিযোগ রয়েছে ভারতের। এদের মধ্যে লস্কর-ই-তৈয়বা, জইশ-ই-মুহাম্মদ রয়েছে। এদিকে পাকিস্তান বরাবরই মনে করে, কাশ্মীর তাদের একটি জাতীয় পরিচয়। একে বাদ দিয়ে ভারত বিভাজন ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা দুটিই অসম্পূর্ণ।
এদিকে ভারতের রাজ্য দ্বিখণ্ডিত করার পদক্ষেপে বিপক্ষে সরব হয় পাকিস্তান। তবে বিষয়টিকে এক প্রকার এড়িয়ে যায় নিরাপত্তা পরিষদ। পাকিস্তানের অভিযোগ বিবেচনায় এনে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বৈঠকও করেনি তারা। কেউ কেউ মনে করছেন, আফগান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে পাকিস্তানের ওপর নির্ভর করায় ভারত প্রত্যুত্তর দিয়েছে কাশ্মীরকে তড়িঘড়ি প্রক্রিয়ায় 'কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল' ঘোষণা করে।
এ ছাড়া কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের নৈতিক ও আইনি যুক্তিগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমলে নিচ্ছে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি ভারত ও কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের কৌশলগত লক্ষ্য ও নীতির স্পষ্টতা ও ধারাবাহিকতারও অভাব রয়েছে। এগুলো ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অবস্থান আরও নড়বড়ে করে তুলছে। সময়ের সঙ্গে প্রতিবেশী দুই দেশের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি ভারসাম্য হারিয়েছে। দুই ক্ষেত্রেই ভারতের চেয়ে বেশ পিছিয়ে পাকিস্তান।
ভারত ও পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্রের মধ্যকার পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস ও শত্রুতাপূর্ণ মানসিকতাই দুই দেশের শান্তি প্রক্রিয়ার মধ্যে বড় বাধা বলে ধারণা করা হয়।
কয়েক মাস ধরে কাশ্মীরের পরিস্থিতি ভয়াবহ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে হত্যা শুরু হয়েছে সেখানে। এ ছাড়া নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করেও হামলা চালানো হচ্ছে। এ পরিস্থিতিকে নব্বই দশকের সঙ্গে তুলনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এরপর নড়েচড়ে বসে ভারতীয় প্রশাসন। গত অক্টোবরে দিল্লিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জরুরি বৈঠক ডাকেন। পরবর্তীতে কাশ্মীরে একটি বিশেষ দল পাঠানো হয়। কাশ্মীর পুলিশের সঙ্গে সেই দল তল্লাশি অভিযান শুরু করে। এরপরই ৭০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আটক ব্যক্তিরা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাত-ই-ইসলামীর সমর্থক বলে অভিযোগ করে পুলিশ।
কাশ্মীর পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসার পরে কাশ্মীরে উত্তেজনা বেড়েছে। কয়েকটি সন্ত্রসী সংগঠনও নতুন করে সক্রিয় হয়েছে। এরই জেরে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। যদিও কাবুল দখলে নেওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তালেবান মুখপাত্র জাবিহউল্লাহ মুজাহিদ আন্তর্জাতিক পক্ষের সঙ্গে যে কোনো সংঘাত এড়ানোর কথা বলেন।
এদিকে আফগানিস্তানে ক্ষমতার মসনদে তালেবান বসা পাকিস্তানের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে আর ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরি জনতা যদি আফগানিস্তানের নিকট-প্রতিবেশীদের দ্বারা উৎসাহিত হয়, সেজন্য সব সময়ই ভয়ে ভয়ে থাকে দিল্লি। চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত ছাড়া আফগানিস্তানে যাওয়া-আসার সহজ সুযোগ রয়েছে কাশ্মীরের। ঐতিহাসিক 'সিল্ক্ক রোড' আমল থেকেই হিমালয়ের পশ্চিম ঢালের জনপদগুলো বিভিন্ন পার্বত্য পথের মাধ্যমে সংযুক্ত। ফলে কাশ্মীর থেকে চীন ও মধ্য এশিয়ায় যাতায়াতের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে আফগানিস্তান। সেই আফগানিস্তানের ঘটনা প্রবাহের আঁচ ভারতে, বিশেষত কাশ্মীর ইস্যুতে পড়তে বাধ্য। তালেবানদের কবজায় কাবুল আসার পর দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে কড়া বার্তা দিয়েছে ভারত। যদিও প্রতিবেশী চীন, পাকিস্তান, ইরান, এমনকি রাশিয়াও তালেবানদের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন করে চলেছে।
এ ছাড়া ভারতে হিন্দুত্ববাদের ক্রমবর্ধমান উত্থান পাকিস্তানের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর মধ্যে আবার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের চলমান দ্বন্দ্ব। চীনের সঙ্গেও ভারতের সাংঘর্ষিক সম্পর্ক রয়েছে। এর জের ধরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সখ্য বাড়ছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে আবার গভীর হয়েছে চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক। এই ভাঙা-গড়ার কারণে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্পর্কের হিসাব-নিকাশ বদলে যাচ্ছে। এর জের ধরে পাকিস্তানকে কৌশলগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে।
এসব সমস্যার সমাধান করতে কয়েক দশক সময় লাগতে পারে। কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে তাই পাকিস্তানকে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপের চেয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রিক দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ করতে হবে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ভয়াবহ সমস্যার মধ্য দিয়ে দিন পার করছে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ। যুদ্ধ করেই বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাদের। প্রতিদিনই বৈষম্যের নতুন নতুন শিকলে বাঁধা পড়ছে কাশ্মীরিরা।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারত তাদের কাশ্মীর নীতিতে বড় পরিবর্তন আনে। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করা হয়। রাজ্যটিকে দ্বিখণ্ডিত করে 'জম্মু ও কাশ্মীর' এবং 'লাদাখ' নামে দুটি আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয়। রাজ্য দ্বিখণ্ডিত হওয়ার পর এই কমিশন জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভার সীমানা পুনর্গঠনের কাজে হাত দেয়। গত ডিসেম্বর মাসে কমিশন সুপারিশ করে, নতুন এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিধানসভার মোট আসন বাড়িয়ে করা হবে ৯০। এর মধ্যে জম্মু অঞ্চলে বাড়বে ছয়টি আসন। ৩৭ থেকে বেড়ে এই অঞ্চলের মোট আসন হবে ৪৩। জম্মুর মোট জনসংখ্যা ৫৩,৫০,৮১১। অন্যদিকে, কাশ্মীর অঞ্চলে একটি আসন বেড়ে হবে ৪৭। কাশ্মীরের মোট জনসংখ্যা ৬৯,০৭,৬২৩। এই প্রস্তাব কার্যকর হলে জম্মু ও কাশ্মীরের মধ্যে আসনসংখ্যার ব্যবধান ৯ থেকে কমে ৪-এ দাঁড়াবে। সরকার গঠনে হিন্দুপ্রধান জম্মুকে সুবিধা পাইয়ে দিতেই বিজেপি এই আসনবিন্যাসের দিকে এগোচ্ছে বলে উপত্যকার রাজনীতিকরা অভিযোগ করেছেন। আর এর মধ্য দিয়ে জননীতি নয়, রাজনৈতিক বিভাজনকেই ইস্যু করছে বিজেপি।
কাশ্মীর এমন স্থানে রয়েছে যার চারপাশে বেষ্টনী করে রেখেছে ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও চীন। তবে কাশ্মীর সংকট নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের সমস্যা চিরচেনা। বর্তমানে এ সমস্যা শুধু ভারত-পাকিস্তানের স্বার্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এ সমস্যা দক্ষিণ এশিয়াসহ সমগ্র বিশ্বের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে এ সমস্যার নেপথ্যে রয়েছে বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থ। এ সমস্যাকে জিইয়ে রেখে তারা তাদের অস্ত্র ব্যবসার প্রসার ঘটাতে চায়।
ভারত ও পাকিস্তান আলাদা দেশ হওয়ার পর কাশ্মীরও দুই ভাগ হয়ে যায়। প্রতিবেশী পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই দেশের নিয়ন্ত্রণে যাওয়া কাশ্মীরের দুই অংশে আসে আলাদা শাসননীতি। জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের তিন বিভাগের মধ্যে কাশ্মীরের জনসংখ্যার অধিকাংশ মানুষ মুসলিম। অন্যদিকে জম্মুতে বসবাসকারী মানুষের অধিকাংশই হিন্দু। লাদাখে হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের পাশাপাশি বৌদ্ধ ধর্মের মানুষের উপস্থিতি রয়েছে।
কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তানের দুই রাষ্ট্রের পরস্পরবিরোধী অবস্থা, দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারার মধ্যে কাশ্মীর সমস্যার মূল কারণ লুকিয়ে রয়েছে। জম্মু-কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি নয়াদিল্লির। এ ছাড়া পাকিস্তানের মদদেই কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী কাশ্মীরকে অশান্ত করে তুলছে বলে অভিযোগ রয়েছে ভারতের। এদের মধ্যে লস্কর-ই-তৈয়বা, জইশ-ই-মুহাম্মদ রয়েছে। এদিকে পাকিস্তান বরাবরই মনে করে, কাশ্মীর তাদের একটি জাতীয় পরিচয়। একে বাদ দিয়ে ভারত বিভাজন ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা দুটিই অসম্পূর্ণ।
এদিকে ভারতের রাজ্য দ্বিখণ্ডিত করার পদক্ষেপে বিপক্ষে সরব হয় পাকিস্তান। তবে বিষয়টিকে এক প্রকার এড়িয়ে যায় নিরাপত্তা পরিষদ। পাকিস্তানের অভিযোগ বিবেচনায় এনে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বৈঠকও করেনি তারা। কেউ কেউ মনে করছেন, আফগান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে পাকিস্তানের ওপর নির্ভর করায় ভারত প্রত্যুত্তর দিয়েছে কাশ্মীরকে তড়িঘড়ি প্রক্রিয়ায় 'কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল' ঘোষণা করে।
এ ছাড়া কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের নৈতিক ও আইনি যুক্তিগুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমলে নিচ্ছে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। পাশাপাশি ভারত ও কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের কৌশলগত লক্ষ্য ও নীতির স্পষ্টতা ও ধারাবাহিকতারও অভাব রয়েছে। এগুলো ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অবস্থান আরও নড়বড়ে করে তুলছে। সময়ের সঙ্গে প্রতিবেশী দুই দেশের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি ভারসাম্য হারিয়েছে। দুই ক্ষেত্রেই ভারতের চেয়ে বেশ পিছিয়ে পাকিস্তান।
ভারত ও পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্রের মধ্যকার পারস্পরিক সন্দেহ, অবিশ্বাস ও শত্রুতাপূর্ণ মানসিকতাই দুই দেশের শান্তি প্রক্রিয়ার মধ্যে বড় বাধা বলে ধারণা করা হয়।
কয়েক মাস ধরে কাশ্মীরের পরিস্থিতি ভয়াবহ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে হত্যা শুরু হয়েছে সেখানে। এ ছাড়া নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের লক্ষ্য করেও হামলা চালানো হচ্ছে। এ পরিস্থিতিকে নব্বই দশকের সঙ্গে তুলনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এরপর নড়েচড়ে বসে ভারতীয় প্রশাসন। গত অক্টোবরে দিল্লিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জরুরি বৈঠক ডাকেন। পরবর্তীতে কাশ্মীরে একটি বিশেষ দল পাঠানো হয়। কাশ্মীর পুলিশের সঙ্গে সেই দল তল্লাশি অভিযান শুরু করে। এরপরই ৭০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আটক ব্যক্তিরা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাত-ই-ইসলামীর সমর্থক বলে অভিযোগ করে পুলিশ।
কাশ্মীর পুলিশের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসার পরে কাশ্মীরে উত্তেজনা বেড়েছে। কয়েকটি সন্ত্রসী সংগঠনও নতুন করে সক্রিয় হয়েছে। এরই জেরে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। যদিও কাবুল দখলে নেওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তালেবান মুখপাত্র জাবিহউল্লাহ মুজাহিদ আন্তর্জাতিক পক্ষের সঙ্গে যে কোনো সংঘাত এড়ানোর কথা বলেন।
এদিকে আফগানিস্তানে ক্ষমতার মসনদে তালেবান বসা পাকিস্তানের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে আর ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরি জনতা যদি আফগানিস্তানের নিকট-প্রতিবেশীদের দ্বারা উৎসাহিত হয়, সেজন্য সব সময়ই ভয়ে ভয়ে থাকে দিল্লি। চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত ছাড়া আফগানিস্তানে যাওয়া-আসার সহজ সুযোগ রয়েছে কাশ্মীরের। ঐতিহাসিক 'সিল্ক্ক রোড' আমল থেকেই হিমালয়ের পশ্চিম ঢালের জনপদগুলো বিভিন্ন পার্বত্য পথের মাধ্যমে সংযুক্ত। ফলে কাশ্মীর থেকে চীন ও মধ্য এশিয়ায় যাতায়াতের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে আফগানিস্তান। সেই আফগানিস্তানের ঘটনা প্রবাহের আঁচ ভারতে, বিশেষত কাশ্মীর ইস্যুতে পড়তে বাধ্য। তালেবানদের কবজায় কাবুল আসার পর দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে কড়া বার্তা দিয়েছে ভারত। যদিও প্রতিবেশী চীন, পাকিস্তান, ইরান, এমনকি রাশিয়াও তালেবানদের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন করে চলেছে।
এ ছাড়া ভারতে হিন্দুত্ববাদের ক্রমবর্ধমান উত্থান পাকিস্তানের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর মধ্যে আবার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের চলমান দ্বন্দ্ব। চীনের সঙ্গেও ভারতের সাংঘর্ষিক সম্পর্ক রয়েছে। এর জের ধরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সখ্য বাড়ছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে আবার গভীর হয়েছে চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক। এই ভাঙা-গড়ার কারণে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্পর্কের হিসাব-নিকাশ বদলে যাচ্ছে। এর জের ধরে পাকিস্তানকে কৌশলগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে।
এসব সমস্যার সমাধান করতে কয়েক দশক সময় লাগতে পারে। কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে তাই পাকিস্তানকে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপের চেয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রিক দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ করতে হবে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ভয়াবহ সমস্যার মধ্য দিয়ে দিন পার করছে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ। যুদ্ধ করেই বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাদের। প্রতিদিনই বৈষম্যের নতুন নতুন শিকলে বাঁধা পড়ছে কাশ্মীরিরা।
- বিষয় :
- ভূরাজনীতির অন্তঃপুরে
- ভূরাজনীতি