ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

বাস্তবতার অন্বেষণে পাওয়া

জাদুবাস্তবতা

বাস্তবতার অন্বেষণে পাওয়া

‘ল্যাংগুয়েজ অব পেইন’

মোহাম্মদ ইকবাল

প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ০০:১০

রেনেসাঁর সময় থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত শিল্পচর্চার ধারার দিকে তাকালে একটা পরিবর্তন চোখে পড়ে। একসময় পৌরানিক বিষয়বস্তু বা ধর্মীয় ইতিহাস নিয়ে শিল্পচর্চা হয়েছে। পরে ছবিতে মানবতাবাদ ক্রমশ প্রবেশ করেছে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসার ছবিটির কথাই ধরা যাক। মোনালিসার চেয়ে অনেক ভালো ছবিও আছে, তারপরও কেন এই ছবিটিকে এত গুরুত্ব দেওয়া হয়? 
মোনালিসার ছবিতে একজন সাধারণ মানুষ বিষয়বস্তু হিসেবে এসেছে। ধারণা করা হয় ১৫০৩ থেকে ১৫০৬ সালের ভেতর মোনালিসা আঁকা হয়। সে সময়ের শিল্পীরা যে ধারার ছবি আঁকতেন, তা ভেঙে আত্মপ্রকাশ করা প্রথম ছবি মোনালিসা। মোনালিসার মধ্য দিয়ে এক ধরনের মানবতাবাদ চিত্রকলায় প্রবেশ করে।  অর্থাৎ শিল্পীর নিজস্ব ভাবনার আলো সেখানে ছবিতে প্রতিফলিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে শিল্পীদের আঁকা ছবিগুলোকে মোটা দাগে ঘটনোকেন্দ্রিক ও চিন্তাকেন্দ্রিক, এই দুই সারিতে ফেলা যায়। বর্তমানের ছবিতে চিন্তাভাবনার ছাপ প্রবলভাবে উপস্থিত। বাস্তবতাকেই আঁকা হচ্ছে। কিন্তু শিল্পী তাতে তাঁর চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটিয়ে একটা নতুন মাত্রা যোগ করছেন। জাদুবাস্তবতা, অধিবাস্তবতা প্রভৃতি এর ভেতর দিয়েই নিজেকে প্রকাশ করছে।
আমি আমার ছবিতে মূলত মানবতাবাদের প্রকাশ ঘটিয়েছি। প্রধানত মানবদেহের মধ্য দিয়ে। আমার ছবিতে বিষয়গতভাবে মানবশরীর এলেও এর পেছনে ভাবনাচিন্তার বিকাশটা ঘটেছে একটু বিচিত্র উপায়ে। আমার আঁকার শুরুটা ছিল বাউল-সন্ন্যাসী এঁদের জীবনযাত্রা কেন্দ্রিক। সে সময়ে আমি তাঁদের জীবনযাত্রা, দর্শন লক্ষ্য ও অনুধাবন করতে চেয়েছি। সেভাবেই আমার ছবিকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা আকার পেয়েছে। অতঃপর সেই ভাবনা আমার ছবিতে আত্মপ্রকাশ করেছে। যে ছবিগুলোর কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে : Unletlered life — বাঁধনহীন জীবন, Outside of Social Bondaqe — সামাজিক বন্ধনের বাইরে। এগুলো আমার সিরিজ ছবি। বিরানব্বই সাল থেকে নিরানব্বই সাল পর্যন্ত আঁকা।  
বিপুলা পৃথিবীর ডাকে সাড়া
১৯৯৩ সালে, জাপানের ওসাকায় অনুষ্ঠিত ত্রিবার্ষিক চিত্রপ্রদর্শনীতে (ট্রিয়েনাল) দুটি ছবি জমা দিয়েছিলাম। নিয়ম অনুযায়ী একটি ছবি প্রদর্শনীর জন্য মনোনীত হয় এবং  সৌভাগ্যক্রমে সেই ছবি প্রদর্শনীতে একটি বড় পুরস্কার জেতে।
একটা ছবির ভেতর অনেক কিছু থাকে। জীবনধারার ছাপ, ছবির কম্পোজিশন প্রভৃতি। একটা দর্শকের মনে কী বার্তা পৌঁছে দেবে তা এরা নিয়ন্ত্রণ করে । আমার ছবির মধ্য দিয়ে আমি সন্ন্যাসীদের বিশেষ জীবনধারা তাদের আন্তর্জগৎটিকে সামনে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। ওসাকায় পুরস্কারের মাধ্যমে তা স্বীকৃতি পেল। 
পুরস্কার এখানে মুখ্য নয়। মুখ্য ওই স্বীকৃতি। আমার ভাবনাচিন্তা থেকে জন্মানো শিল্পশৈলী, আমার চর্চা যে একটা আন্তর্জাতিক পরিসরে স্বীকৃত হয়েছে, এটাই আমাকে একটা অমূল্য উপলব্ধি উপহার দিয়েছিল। 
 ১৯৯৯ সালে আমি মনোবুশো বৃত্তি নিয়ে জাপানে যাই। গন্তব্য আইচি। প্রতিষ্ঠান আইচি ইউনিভার্সিটি অব এডুকেশন। সেখানে জাপানের রীতি অনুযায়ী দ্বিতীয়বার স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভর্তি হতে হয়। তখন বিমূর্ত ধারার ছবি আঁকতে শুরু করি। জাপানি চিত্রউপকরণের প্রশংসা করতেই হয়।  আশি-নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে ভালো চিত্র উপকরণ ছিল না। জাপানে গিয়ে উৎকৃষ্ট রং, ভালো ক্যানভাস পেয়ে কিছু নিরীক্ষায় নামতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। সে সময়ের বিমূর্ত ছবিগুলোয় আমি মূলত টেকনিককে প্রাধান্য দিয়েছিলাম। তখনকার আঁকা সিরিজ ছবিগুলোর ভেতর উল্লেখযোগ্য Distant skies — অতীতের আকাশ, Original Space — বাস্তব জমিন। 
নাগোয়া শহরে একবার প্রদর্শনী চলাকালে গ্যালারি মালিক আমার পুরোনো ক্যাটালগগুলোর পাতা উল্টে দেখছিলেন। হঠাৎ বললেন, ইকবাল, তোমার পুরোনো ছবিগুলো দেখতে দেখতে একটা কথা মনে হলো। তোমার আগের ছবিগুলো কেমন অন্ধকার। ধীরে ধীরে ছবিতে আলো প্রবেশ করেছে।  ব্যাপারটা কিন্তু তিনি বলার আগে আমার মনেই হয়নি। আমি নিজেও লক্ষ্য করে অবাক হয়ে গেলাম। জাপানে এসেছি তখন দেড় বছর। মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে আমার কাজগুলো এতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল কী করে? কারণ পরিবেশ। পরিবেশ শিল্পীর কাজের অন্যতম নিয়ামক। দেশে আমি যেখানে ছবি আঁকতাম, যে জায়গাগুলো আমার চলাফেরার পরিধির ভেতর ছিল, সেগুলো ছিল অন্ধকার, অপরিচ্ছন্ন, বিষণ্ন। জাপানে এসে আমি যখনই বিপরীত পরিবেশ পেলাম, আমার ছবি বদলাতে শুরু করল।
আইচি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করে ২০০৩ সালে আসি হিরোশিমা শহরে। মানুষের চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতার অমোচনীয় স্বাক্ষরবাহী সেই হিরোশিমা। এবার বিদ্যাপীঠ, হিরোশিমা সিটি ইউনিভার্সিটি। 

এখানে শুরু হয় আমার পিএইচডি গবেষণার কাজ। হিরোশিমার সংস্পর্শে আসার ফলেই হয়ত যুদ্ধ, যুদ্ধের ফলশ্রুতি, মানুষের ভবিষ্যৎ প্রভৃতি বিষয়াদি আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখত। হিরোশিমায় আমি আবার অবয়বধর্মী বা ফিগারেটিভ কাজে মনোনিবেশ দিই। এবার তাতে বিমূর্ততা প্রবেশ করেছে। সেই সময়ের কাজগুলোর ওপর, ২০০৫ সালে, জাপানে জাতীয় পর্যায়ে আমি গ্র্যান্ড প্রাইজ পেয়ে যাই।  

বাস্তবতার অন্বেষণ
একটা বিষয় আমার শিল্পযাত্রায় ভাবে অনুভব করেছি। শিল্পীকে সার্বক্ষণিক অন্বেষণে থাকতে হয়। প্রকৃত শিল্পী সেই অন্বেষণে থাকেন বলেই নিত্য নতুন শৈলীর জন্ম হয়। শিল্পকলা অগ্রসর হতে থাকে। শিল্পে জাদুবাস্তবতা, অধিবাস্তবতার জন্ম হয়। এই অন্বেষণের শর্তেই আমি আমার আগের অনেক ভাবনাচিন্তাকে বাদ দিয়েছিলাম। নতুনকে গ্রহণ করেছিলাম। আমার পরিকল্পনা ছিল— বিশেষ একটা কিছু নিয়ে আমি পড়ে থাকব না। প্রতিনিয়ত অন্বেষণে থাকব।  লক্ষ্য রাখব আমার কাজের মধ্য দিয়ে কী বার্তা পৌঁছাচ্ছে। আমি সবসময় সংবাদপত্র পড়তাম। বিশ্বে প্রতিনিয়ত কী ঘটছে সে সম্বন্ধে হালনাগাদ থাকতে চাইতাম। এখনো আমি পত্রপত্রিকা বা অনলাইনে নিয়মিত সংবাদ পড়ি। আমি মনে করি শিল্পী একজন সচেতন ব্যক্তি। তাকে সাম্প্রতিক তথ্য জানতে হয়। তবেই কেউ চিত্রকলা কিংবা লেখার মাধ্যমে বড় কোনো ভূমিকা রাখতে পারে।  এতোটা বড় যা কোনো দুঃশাসনের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে। 
তখন আমি হিরোশিমায়। এক অনলাইন পত্রিকায় আমি গাজার একটি ছবি দেখতে পাই। ধ্বংসস্তূপের ওপর একটা শিশুর মাথা পড়ে আছে। কী সুন্দর সেই মুখ। ছবিটি দেখে ভয়ানক ধাক্কা খাই। ভাবতে থাকি, কোন পথে তাকে ব্যক্ত করব। যুদ্ধের ছবি তো অনেকভাবেই আঁকা যায়। আমি প্রবল অস্থিরতার ভেতর আমার পথের সন্ধান করতে থাকলাম। কিভাবে এই ভয়াবহতা আমি ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে পারি। আমার একটি বৈশিষ্ট্য— কোনো বিশেষ দৃশ্য যখন আমার মনে ছাপ ফেলে আমি তা দেখে দেখে নয়, বরং স্মৃতি থেকে আঁকি। সংবাদপত্রের ছবিটি যখন আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, আমি বিরাট ক্যানভাসে সেই শিশুটির মুখ আঁকলাম। শুধু মুখ। একটা মুখ কিন্তু নিছক মুখ নয়। মানুষের মুখ অভিব্যক্তির আধার। মানুষের আবেগানুভূতি তার চোখে ব্যক্ত হয়। কেউ যদি চোখ ঢেকে রাখে, তার অভিব্যক্তি আড়াল হয়ে যায়। আমি মানুষের চোখ মুখ্য করে তুললাম। এবং সেই যে জাপানে আসার পর, বিমূর্ত পটভূমিতে আমি মানব অবয়ব নিয়ে এসে নতুন শৈলী তৈরি করেছিলাম, এখানে ক্রমশ তার বিকাশ ঘটল। 
ছবি আঁকতে আমি আলাদা কোনো কল্পনার আশ্রয় নিইনি। আমি বাস্তবকে দেখেছি, অতঃপর সেই দেখাটুকু আমি নিজস্ব শৈলীতে প্রকাশ করেছি। আমার চরিত্রেরা বাস্তব, কিন্তু তাদের যে বাস্তবতা, তা জাদুকরী। ফলে তাদের আঁকতে গিয়ে ছবিতে হয়ত জাদুবাস্তবতা প্রকাশ করেছে। 
চারুকলার উল্টো দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশ পথেই একটা বট গাছ আছে। কাছেই ছিল মোল্লা ভাইয়ের টং। মোল্লা ভাইয়ের একমাথা ঝাঁকড়া চুল। পরনে লাল পাঞ্জাবি, কাঁধে লাল গামছা। মোল্লা ভাইয়ের এক সাগরেদ ছিল। প্রবেশপথের সেই বটগাছের নিচে একটা খুপরি করে থাকত লোকটা। প্রায়ই ধড়টা খুপরির ভেতরে রেখে পা দুটো বাইরে রেখে শুয়ে থাকত। একদিন, লোকটা বাধহয় ব্যথা পেয়েছিল, দেখি পায়ে একটা লাল পট্টি বাঁধা। ছবিটা আমার মনে গেঁথে গেল। তখনই প্রথম মনে এসেছিল এই বিবাগী মানুষগুলোকে নিয়ে ছবি আঁকলে কেমন হয়। 
পরে এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে যাই কুমিল্লার বেলতলীতে ল্যাংটার মেলায়। সেই ‘বিবাগী মানুষ’দের এক বিরাট সমাবেশ। যেন ভুবনের আনাচ কানাচ থেকে অগনিত গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী সন্ন্যাসিনী সেখানে সমবেত হয়েছেন। বিচিত্র তাদের বেশভূষা, আচার আচরণ। কেউ এসেছে ঘোড়ায় চেপে, কারো চুলে দীর্ঘ জটা। মানুষের খুলিতে তরল ঢেলে পান করছে কেউ কেউ। খেয়ালী তাদের ভুবন। এই মানুষগুলো বাস্তবের মানুষ। কিন্তু তাদের জগৎটি জাদুকরী। অতএব, আমি যখন তাঁদের আঁকলাম, তাঁদের জীবনধারার প্রয়োজনে, আমার নিজস্ব অঙ্কনশৈলীর আমন্ত্রণে, হয়ত ছবিতে জাদুবাস্তবতা প্রবেশ করল। 
এই জাদুবাস্তবতা বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। আমার বাস্তবতার অন্বেষণ থেকে পাওয়া।

আরও পড়ুন

×