ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

হুমায়ুন আজাদ: ভাষা ও কবিতা

জন্মদিন

হুমায়ুন আজাদ: ভাষা ও কবিতা

হুমায়ুন আজাদ [২৮ এপ্রিল ১৯৪৭–১২ আগস্ট ২০০৪]

কুমার চক্রবর্তী

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ২৩:৪৯

ভাষাই লেখকের আয়না, আর লেখকও ভাষার আয়না। ভাষাকে কুঁদে কুঁদে তিনি তাঁর আপন অবভাস নির্মাণ করেন, আপন ভাব ও চিন্তাকে প্রকাশের জন্য তিনি ছেঁকে নেন ভাষাকে, যেন সংজ্ঞাপন অনুযায়ী তা প্রতিফলিত হতে পারে। মূলত ভাষায় ধরা থাকে সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি, সময় এবং স্মৃতি। ভাষা প্রতিফলিত করে ব্যক্তিকে, তাঁর অণুবিশ্বের চিন্তাকাঠামো ও চিন্তাসূত্রকে, আবার ভাষার মাধ্যমেই সভ্যতা ও জনপদের ব্যাপক-গভীর-সামষ্টিক ভাবনাকাঠামোর আদলটি ফুটে ওঠে। ভাষা ও চিন্তার সম্পর্কটি অন্যোন্য এবং গভীর। ভাষা আগে না চিন্তা আগে—এই মীমাংসায় না গিয়েও বলা যায়, ভাষা হচ্ছে মাধ্যম যা প্রকাশ করে চিন্তা ও অনুভূতিকে, আর এই প্রকাশের ক্ষেত্রে ভাষার সমস্যা ভাবপ্রকাশের সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে কিন্তু ভাবের সমস্যা ভাষার সমস্যা নাও হতে পারে।
ভাষাই ভাবের প্রকাশ, আবার ভাষাই ভাবের প্রতিবন্ধক। বিনির্মাণসূত্রে আমরা আবার জানি যে, শব্দের মানে বলে কিছু হয় না, যতই তা ধরতে চাই আমরা ততই তা হয়ে পড়ে অধরা, মায়ামারীচের মতো। আকরণোত্তরবাদী রোলাঁ বার্তের “লেখকের মৃত্যু” থেকে যা-ই বেরিয়ে আসুক না কেন, আমরা জানি ভাষা এক অস্মিতার প্রকাশ আর এই প্রকাশশৈলীর যে নেপথ্যব্যক্তি, সেই লেখকের আপন ব্যক্তিত্ব ও প্রতিস্বের আলম্বন এবং প্রতিফলন ধরা পড়ে তাঁর ভাষায়। কথক যে প্রতিবেদন তৈরি করেন সেখানে কথনবিশ্বের সাথে তাঁর সম্পর্কটি ভাষিক প্রকৃতির। একটি যেন অপরটির মুকুর, একটিতে ফুটে ওঠে অন্যটির প্রতিবিম্ব। কিন্তু ভাষার দৈন্যের কারণে যেমন চিন্তায় শূন্যস্থান সৃষ্টি হয়, তেমনই চিন্তার দৈন্যের কারণেও ভাষায় শূন্যস্থান দেখা দেয়।
যিনি লেখক হবেন, আর যেভাবেই নিজকে বিন্যস্ত ও ব্যবস্থিত করতে চান, লেখকজীবনের শুরুতেই নিজ-ভাষাকে গুছিয়ে নিতে সংকল্পবদ্ধ হতে হবে তাঁকে। তাড়াতাড়ি ভাষাকে উপযোগী করতে হবে, যা হবে তাঁর স্বতন্ত্র চিন্তা ও ভাবনাকে প্রকাশের উত্তম মাধ্যম এবং যা হবে তাঁর ব্যক্তিগত ভাষা, যা হতে পারে শানিত, উদ্যত, বা নম্য, কিন্তু তাকে হতেই হয় ভিন্ন ও প্রাণিত ভাষা। বলা হয়ে থাকে, যে, চিন্তা বা অনুভূতির প্রথম বিকৃতি ঘটায় ভাষা; এর দ্বারা হয়তো ভাষার সীমাবদ্ধতার দিকটিকেই বোঝানো হয়েছে। চিন্তা বা অনুভূতি মূলত বিমূর্ত বিষয়, তাকে ভাষিক মূর্ততায় আবদ্ধ করতে গিয়ে এর কিছু অংশ অধরা থেকে যায়। ফলে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন, চিন্তা ও তার অনুলিখনের মধ্যে দেখা দেয় ফাঁক, আর এই ফাঁক যত বেশি হয় ততই বাড়তে থাকে লেখকের বিড়ম্বনা ও অক্ষমতা। লেখকের সার্থকতা সেখানেই যেখানে তিনি চিন্তা ও তার প্রতিফলনের মধ্যে যত ব্যবধান কমিয়ে আনতে পারেন, যত বেশি স্থান দিতে পারেন চিন্তাকাঠামোকে ধরার। সৃজনশীল লেখক ঠিক এই কাজটিই করেন—তিনি তাঁর ভাষাকে এমনভাবে সংগঠিত ও নির্বাচিত করেন যা সর্বাত্মকভাবে নবচিন্তা বা অনুভূতিতে বহন করতে সক্ষম হয়।
এই চিন্তনপরিসরকে বিবেচনায় রেখে যদি আমরা হুমায়ুন আজাদের লিখনবিশ্বকে দেখতে থাকি, তাহলে এমন একটি পরিস্থিতি বা ভাষিক অবস্থাকে নির্দ্বিধায় আবিষ্কার করতে পারি যা লেখক ও তাঁর স্বনির্মিত ভাষামণ্ডলের মধ্যে একটি বিকল্পহীন আস্থা ও অবিভাজ্য অবস্থাকে তুলে ধরতে চায়। লেখকজীবনের শুরুতে তিনিও, প্রভাবিত ও প্রাণিত হয়েছিলেন দুজনের লিখনশৈলী দ্বারা: সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বুদ্ধদেব বসু, যাঁদের কথা তিনি স্বীকারও করেছেন; একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেও ছিলেন:
কবিতায় আমি ঠিক একক কোনো কবি দিয়ে প্রভাবিত হয়েছি ব’লে মনে হয় না, যদিও সুধীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ, এবং পশ্চিমের কোনো কোনো কবি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। গদ্যে আমি সচেতনভাবেই, তিরিশ বছর পর্যন্ত, মেনেছি বুদ্ধদেব বসু এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রভাব। তারপর আমার গদ্যে সুধীন্দ্রনাথ নেই, বুদ্ধদেবও নেই।
[দ্রষ্টব্য : হুমায়ুন আজাদ : আততায়ীদের সঙ্গে কথোপকথন : আগামী প্রকাশনী, ঢাকা : ১৯৯৫; পৃষ্ঠা : ৬৩]
কিন্তু খুব দ্রুতই তিনি তাঁর নিজস্ব ভাষাকে পেয়ে যান যে-ভাষা সত্যিকার-অর্থেই তাঁর লিখনবিশ্বকে ধারণ এবং প্রতিফলিত করেছিল। আর এই ভাষার ব্যবহার গদ্যের মতো তাঁর কবিতায়ও ফেলে প্রভাব, যা, অনেকের মতে, তাঁর কবিতার অন্তস্তলকে বিকাশের পথে বাধাপ্রদায়ী, কারণ তিনি তাঁর অহম্কে ভাষাশ্রয়ে অবলীলায় ঢুকিয়ে দিতেন কবিতায় যা কবিতায় এক বহিরাগতের মতো ক্ষত সৃষ্টি করতে চাইত। সে যা-ই হোক, প্রকৃতপক্ষে কবিতাকে তিনি করতে চেয়েছেন প্রজ্ঞাময়, সৌন্দর্যপ্রধান—বহুবিস্তারী এক শিল্পিত মাধ্যম; জীবনের ক্ষেত্রে কবিতার প্রয়োজনকে চিহ্নিত করেছেন এভাবে : “কবিতা জীবনের বাস্তব ও অবাস্তবের শিল্পিত প্রকাশের জন্যে।” “কবিতা কী ও কেন” প্রবন্ধে তিনি আরও বলেছেন কবিতার উপযোগিতা সম্পর্কে নিজ সারগর্ভ কথা :
‘‘কবিতা কোনো নারী বা নরকে ভালোবাসার জন্যে, কবিতা ইন্দ্রিয়কে মথিত করার জন্যে, সুখের দুঃখের উল্লাসের জন্যে, কবিতা ধ্যানের জন্যে, স্তবের জন্যে, গানের জন্যে, লোকোত্তর শ্লোকের জন্যে; কবিতা ঘৃণার জন্যে, শোকের জন্যে; প্রবেশের জন্যে, পলায়নের জন্যে, কবিতা মিলিত হওয়ার জন্যে, কবিতা বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্যে, কবিতা শোভার জন্যে, সুন্দরের জন্যে, মুগ্ধ হওয়ার জন্যে; কবিতা উত্তেজিত হওয়ার জন্যে; এমন আরো অজস্র এক একটি কারণে—কবিতা পৃথিবীর প্রান্তে-প্রান্তে প’চে-যাওয়া সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পরিবর্তিত করার জন্যে, প্রগতির দিকে এগিয়ে দেওয়ার জন্যে; দানবদের বিনাশ ক’রে মানবিকতাকে বহমান রাখার জন্যে।’’
আরেকটি লেখায় কবিতার বৈচিত্র্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন : ‘‘আমি কবিতার বৈচিত্র্যে বিশ্বাসী—কারণ ওই বৈচিত্র্য মানবিক। তাই কবিতা আশার হ’তে পারে, হতাশার হ’তে পারে; হ’তে পারে প্রেমের, বেদনা সুখের, হ’তে পারে নিমগ্ন ধ্যানের, হ’তে পারে কলরোলিত রাজনীতির। কোনো বৃত্তে বন্দী নয় কবিতা। যতোই মহান হোক-না-কোনো, যদি তা কবিতা হ’তে উৎসাহী হয়, এবং ব্যর্থ হয়, তাহলে তার কোনো মূল্য নেই।’’
২০০৪ সালে প্রকাশিত তাঁর জীবিতাবস্থায় প্রকাশিত শেষ কবিতাবই পেরোনোর কিছু নেই-এ ভাষার এক জাতীয় নৈর্ব্যক্তিকীকরণ দেখা যায়। দেখা যায়, হারানো সময়ের সন্ধানে তিনি তন্ময় হয়ে পড়েছিলেন। সময় হারিয়ে যায়, স্মৃতি হয়ে যায়, আর এই সময় ও স্মৃতি দুটিই অদৃশ্য এবং বিমূর্ত। সময় হারায়, কেননা তা চলে যায়, তার চরম ও মহত্তম মুহূর্তগুলো পলাতক হয়ে যায় অতীতে, আর তার তীব্রতা পুনরর্জনের বাইরেই থাকে, মর্মে প্রতিভাত হয় মাত্র। আবার, সময় হারিয়ে যায়, কারণ তা অপব্যয়িত, ক্ষয়িত—নানা মিথ্যা দৈনন্দিনতায় অকার্যকর ও অর্থহীন অভীষ্টতায়। কিন্তু কেন হারানো সময়ের অনুসন্ধান? একি এক ধরনের নৈরাত্ম্যভাবনা যা তাঁর এতদিনকার অহমের যোজনকে বিদারিত করতে চাইল?
হুমায়ুন আজাদ মুখোমুখি হন এই বিস্মরণের, অথবা চারপাশের অবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি বসেন নিজের কাছে, একান্ত ও অনুভবময়, নিজেকে আশ্লিষ্ট করে :
... পুরো একা ব’সে থাকি,
কিছু ভাবি ও ভাবি না; নিজেকেই সঙ্গী করে রাখি।
[কষ্ট পেলে : পেরোনোর কিছু নেই]

সময়ের অপস্রিয়মাণতায় তিনি অনুভব করেন তাঁর মথিত অস্তিত্বকে; তিনি উপলব্ধি করেন জীবন কোনো গন্তব্য নয় বরং অসংখ্য অন্ধবিন্দুর সাথে অসংখ্য মুক্তবিন্দুর, অসংখ্য দৃশ্যবিন্দুর সাথে অসংখ্য অদৃশ্যবিন্দুর অসংখ্য স্থাপিত ঝুলন্তসেতু। আর সময়ও নয় শুধু বিস্মরণের জন্মদাতা, বরং তা সৃষ্টি করে অনেক স্মরণবিন্দুর; যা ব্যক্তিকে পুনঃস্থাপিত করে তার অন্তর্গত জগতে, এবং ব্যক্তি এভাবেই তলিয়ে যাওয়া থেকে উদ্ধার পায়। সুতরাং উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি, অস্তিত্ব ও শূন্যতা, স্মৃতি ও বিস্মরণ, সময় ও স্থান পরস্পরগামী এবং আত্মউদ্ধারক। বস্তুত কোনো কিছুই হারায় না, থেকে যায় অন্যভাবে, ভিন্ন অবিভাবে, নানাবিধ রূপ-রূপান্তরে; রবীন্দ্রনাথের ভাষায় : “রাতের সব তারাই আছে/দিনের আলোর গভীরে।” হুমায়ুন আজাদও বলেন :
শুধু পাবো, এটা রীতি নয়; হারানোও প্রকৃতির রীতি
হারানোর পরও পাওয়া যায় ...
...   ...    ...
শূন্যতাও শূন্য নয়, অঘ্রানে ঘাসের মতো দল মেলে জাগে
নতুন সাজে।
[ওই : ওই]
বোঝা যায় জীবন এবং পার্থিবতা-বিষয়ে এক উদাসীনতা আর নিষ্ক্রিয় দার্শনিকতা তাঁকে ভর করেছিল। তিনি মৌলিক-অর্থে হতাশাবাদী ছিলেন না, তবু কবিসত্তার এক সাধারণ উৎসারের মতো তাঁর মধ্যেও দেখা দিয়েছিল মৃত্যুবোধ। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন : ‘‘এখন অভিজ্ঞ হয়েছি, জীবনের সারকথা অনেকটা বুঝেছি, এখন মৃত্যুর কথা ভাবলে সভ্যতা শিল্পকলা বিজ্ঞানকে হাস্যকর মনে হয়। তবু নিরর্থকতাকে অর্থময় করতে চাই শব্দে ও বাক্যে। ... আমরা শূন্যতার মধ্যে আছি, শূন্যতার দিকে এগোচ্ছি, যেখানে ‘পশুর পায়ের দাগ আর ফুল একই অর্থবহ।’’’ কিন্তু এই নিষ্ক্রমণ চিন্তা, মৃত্যুবোধ তাঁর কাফনে-মোড়া অশ্রুবিন্দু কবিতাগ্রন্থেও অধিবাসের মতো প্রতিধ্বনিত হয়েছিল:
খুব প্রিয় মনে হচ্ছে মৃতদের আজ। সেই সব মৃতদের যাদের দেখেছি
এবং দেখি নি। তাদের হাঁটতে দেখি দূরে কাছে, একা একা, কণ্ঠস্বর
শুনি খুব কাছে থেকে বুকের ভেতরে। যারা এসেছে এবং আমি গেছি
সেই সব মৃতদের কাছে, যখন সবুজ পাতার মতো উজ্জ্বল অক্ষর
ছিলো তারা। কেউ লাল জামা গায়ে মাঠে যাচ্ছে, কালো মুখে কেউ
ফিরে আসছে আসছে ঘরে, কবিতা পড়ছে কেঁপে কেঁপে, রূপে বহু রূপে
দেখি প্রিয় মৃতদের, আমাকে দোলায় ঠান্ডা কালো সমুদ্রের ঢেউ।
আমার ভেতরে ঢুকে কী যেন খুঁজছে তারা ম্লান মুখে খুব চুপে চুপে।

আরও পড়ুন

×