ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

লালনের ২৫০তম জন্মবার্ষিকী

ধ্রুপদি লালনের গানের ভুবন

ধ্রুপদি লালনের গানের ভুবন

লালন শাহ জন্ম : ১৭ অক্টোবর ১৭৭৪ মৃত্যু : ১৭ অক্টোবর ১৮৯০

আবুল আহসান চৌধুরী

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৪ | ২৩:১৭

বাউল গান বাংলার একটি প্রধান লৌকিক ধর্ম-সম্প্রদায়ের সাধনসংগীত। তাঁদের অধ্যাত্ম-সাধনার গূঢ়-গুহ্য পদ্ধতি কেবল দীক্ষিত শিষ্য-সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচারের উদ্দেশ্যেই এই গানের আত্মপ্রকাশ। শিল্প-সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস এখানে অনুপস্থিত। লালনও তাই বিশুদ্ধ শিল্প-প্রেরণায় গান রচনা করেননি, বিশেষ উদ্দেশ্য সংলগ্ন হয়েই তাঁর গানের জন্ম। তবে উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনকে অতিক্রম করে লালনের গান অনায়াসে শিল্পের সাজানো বাগানে প্রবেশ করেছে স্বমহিমায়। লালনের গান তাই একাধারে সাধনসংগীত, দর্শন কথা ও শিল্পশোভিত কাব্যবাণী। তত্ত্বসাহিত্যের ধারায় চর্যাগীতিকা বা বৈষ্ণব পদাবলি সাধনসংগীত হয়েও যেমন উচ্চাঙ্গের শিল্পসাহিত্যের নিদর্শন, তেমনি বাউল গানের শ্রেষ্ঠ নজির লালনের গান সম্পর্কেও এই একই কথা প্রযোজ্য।
দীর্ঘজীবী লালন প্রায় পৌনে এক শতাব্দ ধরে গান রচনা করেছেন। তাঁর গানের সঠিক সংখ্যা কত, তা নির্ণয় করা না গেলেও কেউ কেউ অনুমান করেন তা হয়তো হাজারের কোঠা ছাড়িয়ে যাবে। লালন ছিলেন নিরক্ষর, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সুযোগ তাঁর হয়নি। কিন্তু তাঁর সংগীতের বাণীর সৌকর্য, সুরের বিস্তার, ভাবের গভীরতা আর শিল্পের নৈপুণ্য লক্ষ্য করে তাঁকে শিক্ষাবঞ্চিত নিরক্ষর সাধক বলে মানতে দ্বিধা থেকে যায়। প্রকৃতপক্ষে লালন ছিলেন স্বশিক্ষিত; অন্নদাশঙ্কর রায়ের কথায়– ‘দীর্ঘ শতবর্ষ ধরে ইনি জীবনের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেছেন।’ ভাবের সীমাবদ্ধতা, বিষয়ের পৌনঃপুনিকতা, উপমা-রূপক-চিত্রকল্পের বৈচিত্র্যহীনতা ও সুরের গতানুগতিকতা থেকে লালন ফকির বাউল গানকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে তাঁর সমকালেই তাঁর গান লৌকিক ভক্তমণ্ডলীর গণ্ডি অতিক্রম করে শিক্ষিত সুধীসমাজকেও গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। উত্তরকালে লালনের গান দেশের সীমা অতিক্রম করে বিদেশেও স্থান করে নিয়েছে। তাঁর গান উচ্চ শিল্পমানের পরিচায়ক বলেই এই অসামান্য সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। লালনের গান আজ সংগীত-সাহিত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত। বাউল গানের রসজ্ঞ বোদ্ধা রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) প্রসঙ্গক্রমে একবার বলেছিলেন : “অধিকাংশ আধুনিক বাউলের গানের অমূল্যতা চলে গেছে তা চলতি হাটের সস্তা দামের জিনিস হয়ে পথে পথে বিকোচ্চে। অনেক স্থলে বাঁধি বোলের পুনরাবৃত্তি এবং হাস্যকর উপমা তুলনার দ্বারা আকীর্ণ, অনেকগুলোই মৃত্যুভয়ের শাসনে মানুষকে বৈরাগী দলে টানবার প্রচারকগিরি। এর উপায় নেই, খাঁটি জিনিসের পরিমাণ বেশি হওয়া অসম্ভব, খাঁটির জন্য অপেক্ষা করতে ও তাকে গভীর করে চিনতে যে ধৈর্যের প্রয়োজন তা সংসারে বিরল। এইজন্য কৃত্রিম নকলের প্রচুরতা চলতে থাকে। এইজন্য সাধারণত যেসব বাউলের গান যেখানে-সেখানে পাওয়া যায়, কী সাধনার কী সাহিত্যের দিক থেকে তার দাম বেশি নয়।
সাধারণ বাউল গানের এই যে বৈশিষ্ট্য তার সঙ্গে লালনের গানের তুলনা করলেই লালনগীতির স্বাতন্ত্র্য ও উৎকর্ষ অনায়াসে ধরা পড়বে। লালনের মতো একজন নিরক্ষর গ্রাম্য সাধককবির শিল্পভুবনে প্রবেশ করলে তাঁর অসাধারণ প্রতিভা বিস্ময় জাগিয়ে তোলে।
লালনের গানে শিল্পের প্রসাধন কীভাবে সেই গানের লালিত্য ও সৌন্দর্য প্রকাশ করেছে, এখানে আমরা তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় গ্রহণ করব।
কেবল সংখ্যায় নয়, শিল্পগুণেও লালনের গান বাউলসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। ভাব-ভাষা-ছন্দ-অলংকারবিচারে এই গান উচ্চ শিল্পমানের পরিচায়ক এবং তা তর্কাতীতরূপে কাব্যগীতিতে উত্তীর্ণ।
শব্দের জিয়নকাঠিই কবিতা কিংবা গানের শরীরে প্রাণপ্রবাহ সঞ্চার করে থাকে। কুশলী শিল্পীর হাতে প্রচলিত শব্দ নতুন ব্যঞ্জনা ও তাৎপর্য নিয়ে ধরা দেয়। প্রয়োগ-নৈপুণ্যে আটপৌরে শব্দও যে কীভাবে নতুন অর্থ-ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে লালনের গানে তার উজ্জ্বল উদাহরণ বিদ্যমান। লালন ছিলেন শব্দ-কুশলী ও শব্দ-সচেতন শিল্পী। ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর সেথা এক পড়শি বসত করে’ লালনের একটি প্রাতিম্বিক গান। এখানে পরম আকাঙ্ক্ষিত অচিন এক পড়শির সঙ্গে মিলনের ব্যাকুলতা প্রকাশিত। সেই অধর মানুষের পরশ লাভ করলে লালনের ভব-বন্ধন-জ্বালা যেত ঘুচে। কিন্তু ‘সে আর লালন একখানে রয়,/ তবু লক্ষ যোজন ফাঁক রে’। এখানে ‘যোজন’ শব্দটির প্রয়োগ লক্ষণীয়। দূরত্ব-নির্দেশক ‘যোজন’ শব্দটি এখানে যেভাবে সুপ্রযুক্ত, দূরত্ব-জ্ঞাপক আর অন্য কোনো শব্দই এর যোগ্য বিকল্প হতে পারে না। ‘যোজনে’র পরিবর্তে অন্য কোনো শব্দ এখানে ব্যবহৃত হলে শুধু এই পঙ্‌ক্তিটিই নয় সম্পূর্ণ গানটিরই শিল্প-আঁটুনি শিথিল হয়ে যেত।
কে কথা কয় রে দেখা দেয় না’– লালনের এই গানটিতেও নিকটে অবস্থিত অথচ স্পর্শ ও দর্শনের অতীত এক সত্তার অন্বেষণে সাধকের ব্যাকুলতা প্রকাশিত। এই গানের একটি পঙ্‌ক্তি– ‘ক্ষিতি জল কি বায় হুতাশন’। এই পঙ্‌ক্তির ভিন্নরকম বিন্যাস কিংবা বিকল্প শব্দের প্রয়োগ অচিন্তনীয়।
শব্দের শুদ্ধরূপের বিচ্যুতি বা তার আঞ্চলিক রূপের প্রয়োগও যে লালনের গানে কত সুন্দর মানিয়ে যায় তার দৃষ্টান্ত প্রচুর যেমন, ‘গাহেক’ (গ্রাহক) “খুলবে কেন সে ধন ও তার গাহেক বিনে’, কিংবা ‘গেরাম’ (গ্রাম) ‘গেরাম বেড়ে অগাধ পানি’ আবার ‘পাগলা খিজি’, ‘কোনা-কানছি’, ‘তোড়ানি’, ‘সই হবা’, ‘কপনি ধ্বজা ইত্যাদি। তাঁর এই শব্দপ্রয়োগের নৈপুণ্য প্রসঙ্গে মুহম্মদ আবদুল হাই (১৯১৯-১৯৬৯) বলেছেন :
“সহজ সরল বাংলা শব্দের মধ্যে কত যে রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে তাঁর গানের শব্দপ্রয়োগ ও অনায়াসে বয়নকুশলতায় সে সাক্ষ্য বহন করছে। এমন ঝরঝরে নির্ভার তদ্ভব শব্দ প্রয়োগের কারুকলা আর কোনো লোককবির গানে দেখা যায় না। লালন তাঁর সমসাময়িক এবং পূর্ব ও পরবর্তীকালের অন্যান্য লোককবি থেকে এখানেই বিশিষ্টতার দাবি করেন। সেইজন্য লালন শ্রেষ্ঠ বাউল ও লোককবি।
আবার তাঁর তৎসম শব্দের যথোপযুক্ত ব্যবহার বিস্ময়ের সৃষ্টি করে এবং এই নিরক্ষর গ্রাম্য সাধককবির প্রতি পাঠক-শ্রোতার শ্রদ্ধা ও মনোযোগ বাড়িয়ে দেয়। যেমন– বাঞ্ছা, স্বয়ম্ভূ, ভাস্কর, নিরঞ্জন, স্কন্ধ, লক্ষ, অন্তিমকাল, অমর্ত্য, নিষ্ঠা, মৈথুন, ত্বরা, অনন্ত, ভুজঙ্গনা, মীন, ব্রহ্মাণ্ড, নপুংসক, জ্যোতির্ময়, বিভূতি, ধূপ, দর্পণ, ত্রিভুবন, সৌদামিনী, চিদানন্দ, শরণ, কিঞ্চিৎ, দিব্য, নির্বিকার, অন্বেষণ। এই উদাহরণ অনায়াসে আরও দীর্ঘ হতে পারে। লালন তাঁর গানে সমার্থক একাধিক শব্দ (আরশি, আয়না, দর্পণ) ব্যবহার করে ভিন্ন ভিন্ন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন; যেমন ক. ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’, খ. ‘আয়নামহল তায়’, গ. ‘জানো না মন পারাহীন দর্পণ’।

আরবি-ফারসি শব্দের সুষম ব্যবহার লালনের গানকে আরও আকর্ষণীয় ও শ্রীমণ্ডিত করে তুলতে সাহায্য করেছে। কয়েকটি প্রয়োগ-উদাহরণ লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে বাংলা শব্দের সঙ্গে তিনি এইসব শব্দের কী গভীর আত্মীয়তা-যোগ ঘটিয়েছেন এসব ক্ষেত্রে। আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার যে কত প্রাসঙ্গিক, অকৃত্রিম ও স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে তার উদাহরণ লালনের এই গানটি :
“বাকির কাগজ মন তোর গেল হুজুরে।
কোনদিন তোর আসবে শমন সাধের অন্তঃপুরে যেদিন ভিটায় হয় বসতি
দিয়েছিলে মন খোকवলতি
তুমি হরদম নাম রাখবে স্থিতি এখন ভুলে গিয়েছ তারে ॥ আইন-মাফিক নিরিখ দে না
ও মন, তাতে কেন তোর ইতরপনা
যাবে রে মন যাবে জানা
জানা যাবে আখেরে ॥
সুখ পা’লে হও সুখ-ভোলা
দুখ পা’লে হও দুখ-উতলা
লালন কয় সাধনের বেলা
অন্যত্র পাওয়া যায়:
মন তোর কিসে জ্বৎ ধরে
ক. গঠেছেন সাঁই মানুষ-মক্কা কুদরতি নূর নিয়ে
খ. এলাহি আলামিন গো আল্লা বাদশা আলামপানা তুমি
গ. সেই মোয়াহেদ দায়মাল হবে
ঘ. কুল্লে শাইইন মুহিত খোদা
ঙ. ফেরেবি ফকিরি দাড়া, দরগা নিশান ঝাণ্ডা গাড়া।
লালন তাঁর গানে ইংরেজি শব্দও কিছু কিছু ব্যবহার করেছেন; যেমন ‘গড, কোর্ট, জুরি, বেরাদর (ব্রাদার), ম্যাজিস্টারি (ম্যাজিস্ট্রেট), পক্সো (পক্স) ইত্যাদি। এর থেকে সহজেই অনুমান করা চলে যে নিরক্ষর লালনের শব্দভান্ডার কত সমৃদ্ধ ছিল। আশ্রাফ সিদ্দিকী (জ. ১৯২৭) লালনগীতির শব্দ-মটিফিম নিয়ে যে-আলোচনা করেছেন তাতে লালনের শব্দ-ব্যবহারের বিশেষ প্রবণতা ও তাৎপর্যের আভাস দিয়েছেন।
বাউলগানের রসগ্রাহী রবীন্দ্রনাথ লালনের গানের ছন্দ-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করে এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি লালনের ‘আছে যার মনের মানুষ আপন মনে/ সে কি জপে মালা’ এবং ‘এমন মানবজনম আর কি হবে এই গান দুটি উদ্ধৃত করে মন্তব্য করেন : “এই ছন্দের ভঙ্গি একঘেয়ে নয়। ছোটো-বড়ো নানা ভাগে বাঁকে বাঁকে চলেছে। সাধুপ্রসাধনে মেজে ঘষে এর শোভা বাড়ানো চলে, আশা করি এ কথা বলবার সাহস হবে না কারো রবীন্দ্রনাথ দৃঢ় প্রত্যয়ে অভিমত পোষণ করেছেন যে, ‘এই খাঁটি বাংলায় সকল রকম ছন্দেই সকল কাব্যই লেখা সম্ভব। এই প্রবন্ধেরই অন্যত্র *বাঙালির দিবারাত্রির ভাষায় রচিত লালনের একটি গানের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে মন্তব্য করেছেন : ‘প্রাকৃত-বাংলাকে গুরুচণ্ডালী স্পর্শই করে না। সাধুছাদের ভাষাতেই শব্দের মিশেল সয় না।’
ছন্দের শাসন লালনের গানকে একটি নিটোল শিল্পে পরিণত করেছে। তাঁর ছন্দবোধ অনুশীলনের ফসল নয়, বরঞ্চ তা তাঁর স্বভাবেরই অন্তর্গত শিল্প-ধারণা থেকে উৎপন্ন। অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত বাংলা ছন্দের এই ত্রিবিধ মাধ্যমেই তাঁর সার্থক পরিক্রমণ লক্ষ্য করা যায়। অলংকার-প্রয়োগের ক্ষেত্রেও লালনের নৈপুণ্য বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। উপমা-রূপক-চিত্রকল্প-উৎপ্রেক্ষা লালনগীতিকে শ্রীমণ্ডিত করে তুলেছে। উপমা ও চিত্রকল্পের যুগল ব্যবহার লালনের গানকে কেমন দীপ্তিময় করে তুলেছে এখানে তার উদাহরণ পেশ করা হলো :
কিংবা,
“মাকাল ফলের বরণ দেখে
যেমন ডালে এসে নাচে কাকে তেমনি আমার মন চটকে বিমন সার পদার্থ নাহি চেনে
“মেঘের বিদ্যুৎ মেঘে যেমন
আবার,
লুকালে না পায় অন্বেষণ
কালারে হারায়ে তেমন
ও রূপ হেরিয়ে স্বপনে
এক নিরিখে দেখ ধনি, সূর্যগত কমলিনী দিনে বিকশিত কমলিনী, নিশীথে মুদিত রহে।
তেমনি জেন ভক্ত যে জন, এক রূপে বাঁধে হিয়ে
বাউলগান রূপকাশ্রিত, তাই লালনের গানে অনিবার্যভাবে রূপকের বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন নিচের এই গানটি :
“লাগল ধুম প্রেমের থানাতে
মন-চোরা পড়েছে ধরা রসিকের হাতে। ও ধরেছে চোরকে হাওয়ায় ফাঁদ পেতে ॥
ভক্তি-জমাদারের হাতে
দু’দিন চোর জিম্মা থাকে
তিন দিনের দিন দেয় সে চালান
আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ॥
অন্যত্র পাওয়া যায় : ‘কুলের বউ’, ‘মনের লেংটি’, ‘মানের তরণী’, ‘মন-কাম’, ‘পাপ-সাগর’, ‘মানুষ-মক্কা’, ‘আরশিনগর’, ‘প্রেম-ফাঁদ’, ‘ভব-কারাগার’, ‘দয়ালচাঁদ’, ‘আবহায়াত-নদী’ ইত্যাদি। প্রচলিত ইঙ্গিতধর্মী প্রবাদ-প্রবচন-সুভাষণের ব্যবহার তাঁর কাব্যগীতিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তাঁর বক্তব্যের যৌক্তিক ভিত্তি-অর্জনের জন্য এই প্রয়োগ বিশেষ সহায়ক হয়েছে। লালনগীতিতে ব্যবহৃত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রবাদ-প্রবচন-সুভাষণ : 
ক. কাক মারিতে কামান-পাতা
খ. সুঁই-ছিদ্রে চালায় হাতী
গ. পিঁড়ের বসে পেঁড়োর খবর
ঘ. গুড় বললে কি মুখ মিঠে হয় 
ঙ. দীপ না জ্বাললে কি আঁধার যায়
চ. মারে মৎস্য না ছোঁয় পানি
ছ. . ঠাকুর গড়তে বাঁদর হলো রে
জ. যজ্ঞের ঘৃত কুত্তায় খেলো রে
ঝ. হাওয়ার চিড়ে কথার দধি ফলার হচ্ছে নিরবধি
ঞ. হাতের কাছে হয় না খবর, কি দেখতে যাও দিল্লি-লাহোর । অনুপ্রাসের ব্যবহার লালনের গানকে বিশেষ ধ্বনি-ব্যঞ্জনায় মণ্ডিত করেছে যেমন :
ক. গুরু, তুমি তন্ত্রের তন্ত্রী
গুরু, তুমি মন্ত্রের মন্ত্রী
গুরু, তুমি যন্ত্রের যন্ত্রী
না বাজাও বাজবে কেনে ॥
খ. যার যেখানে ব্যথা নেহাত, সেইখানে হাত ডলামলা।
গ. ধর রে অধরচাঁদেরে অধরে অধর দিয়ে।
ঘ. কারুণ্য তারুণ্য এসে লাবণ্যে যখন মিশে
ঙ. আঁখির কোণে পাখির বাসা।
লালনের অতুলনীয় কবিত্ব-শক্তির পরিচয় তাঁর অনেক গানেই বিধৃত। বিশেষ করে তাঁর ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়’, ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’, ‘কোথা আছে রে দীন দরদি সাঁই’, “এ-দেশেতে এই সুখ হলো’, ‘কে কথা কয় রে দেখা দেয় না’, ‘আমার ঘরের চাবি পরের হাতে’, ‘পাখি কখন উড়ে যায়’, ‘আমার আপন খবর আপনার হয় না’, ‘আমার এ ঘরখানায় কে বিরাজ করে’, মানব-জনম আর কি হবে’, ‘মিলন হবে কত দিনে আমার মনের মানুষের সনে’, ‘আরকি বসবো এমন সাধুর বাজারে’, ‘গুরু দোহাই তোমার মনকে আমার লও গো সুপথে’, ‘কবে সাধুর চরণধূলি মোর লাগবে গায়’, ‘এলাহি আলামিন আল্লা বাদশা আলমপনা তুমি’, ‘তোমার মত দয়াল বন্ধু আর পাব না’, ‘ঘরে কি হয় না ফকিরি’, ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে’, ‘পার কর হে দয়ালচাঁদ আমারে’ প্রভৃতি শিল্পসৌকর্যমণ্ডিত গান আজ বাংলা সাহিত্যের পরম মূল্যবান সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত ও গৃহীত। বহুল উচ্চারিত তত্ত্বকথা ও সীমাবদ্ধ বিষয়ের অনুবর্তন সত্ত্বেও লালন তাঁর সংগীতে সেই গতানুগতিকতাকে অতিক্রম করে নতুন ভাব-ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেছেন। তত্ত্বকথার দুরূহ ও ক্লান্তিকর বদ্ধ আবহে এনেছেন শিল্প-সৌন্দর্যের সুবাতাস। তাই বাংলার মরমি কবিদের মধ্যেই যে কেবল তিনি শ্রেষ্ঠ তাই নয়, বাংলার সংগীত-সাহিত্যের ইতিহাসেও তিনি এক কালোত্তীর্ণ স্মরণীয় শিল্পী ব্যক্তিত্ব।
মূলত লালনের গানের অসামান্য শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য, উচ্চাঙ্গের দর্শন ও আন্তরিক মানবিকতাবোধের জন্যই বাংলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য-মনীষা রবীন্দ্রনাথ থেকে অন্নদাশঙ্কর রায় এবং বিদেশে ধীমান সাহিত্য-সমালোচক Edward C. Dimock থেকে Carol Salomon লালনের গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন।
বাউলগানের রসজ্ঞ মরমি বোদ্ধা রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক কবিতায় বলেছিলেন : 
“সাহিত্যের ঐকতানসংগীতসভায়
একতারা যাহাদের তারাও সম্মান যেন পায়–
[ঐকতান : জন্মদিনে]
–তাঁর এই আন্তরিক প্রত্যাশা বাংলা সাহিত্যের দরবারে লালন ফকিরের স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সার্থকভাবে পূরণ হয়েছে। 
বাউলগানের ধ্রুপদি স্রষ্টা লালন ফকিরের সার্ধদ্বিশত জন্মবর্ষে (১৭৭৪-২০২৪) মৃত্তিকা-সংলগ্ন সংস্কৃতির অনুরাগী বাঙালির অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি তাঁকে। v
 

আরও পড়ুন

×