ঢাকা মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫

‘পৃথিবীকে আগের চেয়ে স্বচ্ছভাবে দেখতে পাই’

‘পৃথিবীকে আগের চেয়ে স্বচ্ছভাবে দেখতে পাই’

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী [জন্ম: ২৩ জুন ১৯৩৬]

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫ | ০০:১০ | আপডেট: ২০ জুন ২০২৫ | ০০:২৩

আগামী ২৩ জুন ২০২৫ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ৯০তম বছরে পদার্পণ করবেন। জন্মদিনকে সামনে রেখে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিল কালের খেয়া। কথা বলেছেন হামিম কামাল 

কালের খেয়া: স্যার, কেমন আছেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: বয়স বাড়ছে। বয়সের বোঝা বহন করা একটু কঠিন হয়ে উঠছে। তবে মানসিকভাবে আমি শক্তই আছি এবং একটা বিষয় আমি উপলব্ধি করেছি– আমার ভেতরের যে দৃষ্টিশক্তি, তা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে, এখনও বাড়ছে। পৃথিবীকে আমি আগের চেয়ে স্বচ্ছভাবে দেখতে পাই। স্বচ্ছভাবে দেখতে পাওয়ার বিষয়টি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চলছিল এবং এখনও বজায় আছে। এখন আগের চেয়েও ভালোভাবে বুঝতে পারি। 
l পেছনের দিকে তাকালে নিজের জীবনের কোন প্রবণতা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে?
ll প্রবণতা প্রশ্নে, দুটো বিষয় আমি আমার ভেতর দেখেছি। একটি স্পর্শকাতরতা আমার ভেতর আছে। আবার সংবেদনশীলতাও আছে। স্পর্শকাতরতা আমাকে সংকীর্ণ করে, ধাক্কা দেয়। সংবেদনশীলতা আমাকে প্রসারিত করে। ক্রমশ আমার ভেতর সংবেদনশীলতাই বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে স্পর্শকাতরতার তুলনায়। এমনিতে আমি স্বভাবের দিক থেকে একটু লাজুক প্রকৃতির ছিলাম। এখনও আছি। মানুষের সঙ্গে সহজে মিশতে খুব একটা পারি না। আমার বাবা ভাবতেন, শিক্ষকতার কাজ আমি পারব না। কিন্তু পেরেছিলাম। কী করে পারলাম সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। সংবেদনশীলতা আমাকে ক্রমশ সামাজিক করেছে, সজীব করে রেখেছে, সচল রেখেছে আমার লেখা ও সাংস্কৃতিক কাজ। লেখাকে আমি সাংস্কৃতিক কাজের অংশ হিসেবে দেখেছি এবং সেই সাংস্কৃতিক কাজ একটা সামাজিক কাজও বটে। 
শিক্ষকতার কাজ আমি কী করে করতে পারলাম, তার কারণ খুব সম্ভব এই যে–ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক কাজে আমি যোগ দেওয়ায় গণের সামনে আমি বোধহয় স্বচ্ছন্দ ছিলাম। আমাদের পাড়াতে নাটক করেছি। আজিমপুর কলোনিতে বড় হয়েছি আমরা। নাটক, আবৃতি, বিতর্ক করেছি, কলেজেও আমি নাটক করেছি–তখন নটর ডেম কলেজে পড়ি। দ্বিতীয় বর্ষে শেকসপিয়ারের মূল টেমপেস্ট (ইংরেজি) নাটকে অভিনয় করেছি আমরা। আরেকটা কাজ আমি উপভোগ করতাম। এখন যেখানে বোরহানউদ্দিন কলেজ, সেখানে ছিল রেডিও স্টেশন। রেডিও স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। সেখানে যারা প্রযোজক ছিলেন তাদের বয়স আমাদের থেকে কিছু বেশি ছিল, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। রেডিওতে অনেক অনুষ্ঠান করেছি। যখন টেলিভিশন শুরু হলো, সেখানেও অনেক অনুষ্ঠানে আমি অংশ নিয়েছি। অর্থাৎ গণের সামনে উপস্থিত হতে আমার কোনো সমস্যা হয়নি। ব্যক্তিগত পর্যায়ের লোকের সঙ্গে পরিচিত হতে আমার ভেতরে কেমন সংকোচ কাজ করত, এখনও করে।
l বেড়ে ওঠার কালে আপনার কাছে আদর্শ কিংবা বিশেষ প্রিয় লেখক কারা ছিলেন?
ll আমার তিনজন প্রিয় লেখক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের প্রতি অনুরাগ তো সাধারণ। এর বাইরে তিনজন প্রিয় লেখকের প্রভাব আমার ওপর পড়েছে, বিশেষ করে আমার রচনারীতির ওপরে। তারা প্রমথ চৌধুরী, বুদ্ধদেব বসু ও শিবরাম চক্রবর্তী। আমি সেইন্ট গ্রেগরি স্কুলে পড়েছি। সেখানে আমাদের একজন শিক্ষক ছিলেন, বাংলার, সতীশ চক্রবর্তী। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে সতীশ চক্রবর্তী ছিলেন বুদ্ধদেব বসুর সমসাময়িক, সহপাঠী। তিনি বাংলায় পড়েছিলেন, অপরদিকে বুদ্ধদেব বসু ইংরেজিতে। সাহিত্যপাঠে তিনি আমাদের উদ্বুদ্ধ করতেন। বসুর লেখা তিনি আমাদের পড়ে শোনাতেন। ঢাকার ওপরে লেখা, আত্মজৈবনিক লেখা, ছোট ছোট প্রবন্ধ। সেসব লেখার যে ভাষা ও ভঙ্গি সেটা তখন রপ্ত হলো। এরপর প্রমথ চৌধুরীর যে বাগবৈদগ্ধ সেটিও আমাকে আকর্ষণ করেছে। শিবরাম চক্রবর্তীর লেখাও আমাকে আকর্ষণ করেছে। তাঁর রসবোধ আমাকে আকৃষ্ট করেছে। এই তিন লেখক কিন্তু একরকম নন, তাদের আবার পরস্পরবিরোধীও বলা যায়। বুদ্ধদেব বসুকে আমি পুরো গ্রহণ করেছি তা না, তাঁর সমালোচনাও আমি করেছি। কারণ তাঁর যে জীবনদৃষ্টি সেটি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তাঁর সাহিত্যরীতি আমাকে উপকৃত করেছে। 
l এমন কোনো গ্রন্থ আছে কী যা এখনো লিখে ওঠা হয়নি, কিন্তু প্রতিনিয়ত তাড়না অনুভব করছেন?
ll এখন আমি ভেতর থেকে তাড়না অনুভব করছি আত্মজীবনী লেখার। এ নিয়ে চারপাশ থেকেও বেশ চাপের মুখে আছি বলা যায়। আমার একটি অসুবিধা হচ্ছে, তরুণ বয়েসে দিনলিপি আমি তেমন লিখিনি। তবে আশার কথা হচ্ছে, অনেক আত্মজৈবনিক রচনা আমার আছে, স্বনামে ও ছদ্মনামে লেখা। গাছপাথর, নাগরিক প্রভৃতি ছদ্মনামে। সেগুলো কিছুটা বিক্ষিপ্ত, তবে আছে। আর আছে সাক্ষাৎকার। এই যেমন তোমাকে দিচ্ছি। এমন সাক্ষাৎকার আমাকে অনেক দিতে হয়েছে। পত্রিকা ও গ্রন্থাকারে সেসব প্রকাশিত হয়েছে। অনেকেই আশা করছেন, আমার জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো আমি ধারাবাহিকভাবে জানাব। আমি কী দেখলাম, কী বুঝলাম, তা আমিও ব্যক্ত করতে চাই, এবং সেই কাজ শুরুও করেছি। স্মৃতিশক্তি দুর্বল আমার এমনিতেই। এখন আরও দুর্বল হয়েছে। অনেক কিছুই এখন আর মনে করতে পারি না। এবং কোনো ঘটনা আমার সমসাময়িক যাদের সঙ্গে আলাপ করে যাচাই করে নিতে পারি, তেমন অনেকেই এখন আর নেই। তবু আমার ভরসার জায়গা এরইমাঝে প্রকাশিত লেখা ও সাক্ষাৎকারগুলো। আমার বিশ্বাস ওখানে আমি অনেক তথ্য ও সূত্র পাব। সময়সাপেক্ষ কাজ হবে। পত্রিকাতে আমি ধারাবাহিকভাবে লিখব। আসছে সংখ্যা থেকেই শুরু করছি। আমি অন্য কাজ কমিয়ে এখন সেই কাজেই বেশি মনোযোগ দিয়েছি। 
l স্যার এবার একটা প্রিয় ও বিষণ্ন প্রসঙ্গে যেতে চাই। আপনার সহধর্মিণী নাজমা জেসমিন চৌধুরীর প্রসঙ্গ। ওনার দেওয়া প্রেরণা আপনি এখনও যেভাবে বহন করে চলেন, তা নিয়ে শুনতে চাইছি।
ll অনেক বছর আগে ও আকস্মিকভাবে মারা যায় (১৯৮৯)। তখন তার বয়স পঞ্চাশও হয়নি। নাজমার সঙ্গে যে বিষয়টিতে আমার মিল হয়েছিল, সেটি ছিল মতের মিল। নাজমা একটি পিএইচডি গবেষণা করেছিল, বাংলা উপন্যাস ও রাজনীতি বিষয়ে। পড়তে গিয়ে লেখকদের লেখা, ভাষ্য বিশ্লেষণ করে একটি উপলব্ধিতে পৌঁছেছিল। তা হলো–মানুষের মধ্যে মনের মিল জরুরি, কিন্তু তার চেয়েও জরুরি মতের মিল। এবং মতের মিল না হলে মনের মিল বজায় থাকে না। সেই যে মতের মিল, সেটি তার সঙ্গে আমার ছিল। ওর মৃত্যুর পর আমি একটি বই লিখেছিলাম, বন্ধুর মুখচ্ছবি। সেখানেই ওই কথাটিই বলেছি। আরেকটি বিষয়। আমার অভিজ্ঞতার জগৎটি খুব সংকীর্ণ। সে কারণেই আমার শিক্ষকতার, প্রতিবেশ ও পরিপাশের শিল্প-সংস্কৃতির মানুষের ভেতরই আমার বৃত্ত আবদ্ধ। এর বাইরে যে একটি জগৎ আছে, সামাজিক জগৎ, নারীর জগৎ এবং সাংসারিক মানুষের জগৎ– সেই জগতের সঙ্গে আমার পরিচয় সামান্য। নাজমা সেই জগৎকে জানত। তার লেখার ভেতর সেগুলো আছে। বেশি লিখতে পারেনি। অল্প বয়েসে চলে গেছে। গল্প, উপন্যাস, টেলিভিশন নাটক, শিশুদের জন্য নাটক– সবকিছুতেই সেই সামাজিক জগৎটা ফুটে উঠেছিল, যে জগৎ আমার বৃত্তের বাইরে। নাজমার অভিজ্ঞতা ও কৌতূহল ছিল, এবং সেই অভিজ্ঞতা ও কৌতূহল আমার মাঝেও সঞ্চারিত হয়েছে, আমি সমৃদ্ধ হয়েছি। 
l স্পর্শকাতরতা থেকে সংবেদনশীলতার দিকে যে যাত্রা, সেখানে তাঁর ভূমিকা অনুভব করতে পারছি। 
ll অবশ্যই তার ভূমিকা আছে। এবং আরেকটি বিষয়, বিয়ের আগে আমি তো ছিলাম আমার পারিবারিক বলয়ে। যেখানে আমার মা বাবা ভাই বোন ছিলেন। বিয়ের পর পরিবারের বাইরের একজন মানুষের সঙ্গে পরিবার রচনা করা, বিষয়টিতে সংবেদনশীলতার একটি জন্ম-অধ্যায় হয়েছে। 
l এবার আমরা ভাবাদর্শের দিকে যেতে চাই স্যার। জানতে চাই কখন আপনার মনে সমাজতান্ত্রিক চৈতন্য জন্ম নিয়েছিল?
ll  আমরা কিন্তু সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ নিয়ে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাইনি। তখন আমরা ওই ধরনের সাহিত্যও পাঠ করিনি। নিজেদের স্বদেশীয় সাহিত্যের জগতেই নিবিষ্ট ছিলাম। তখন ব্যক্তির বিকাশের প্রসঙ্গটি মনে জাগত। আমার প্রথম গ্রন্থের নাম অন্বেষণ। ১৯৬৫ সালে বেরিয়েছে। ওই গ্রন্থের প্রথম লেখাটি হচ্ছে, স্বাতন্ত্র্যের দায়। আমার তখন মনে হতো, একজন মানুষকে সবার আগে স্বতন্ত্র হতে হবে। কিন্তু স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করাই তো কঠিন। এখানে সবাই সংকীর্ণ হয়ে যাই। স্বতন্ত্রকে আক্রমণ করে। বলা হয়, খাপ খাইয়ে নিতে হবে। এখানেই ছিল আমার সঙ্গে বিরোধ। আমি খাপ খাইয়ে নেওয়া, মিশে যাওয়া পছন্দ করতাম না। আমার জীবনের বাঁক বদলের মুহূর্তটি এলো যখন আমি ইংল্যান্ডে গেলাম। আমি গিয়েছি ১৯৫৯ সালে। 

এমফিল পাস করেছি ৫৬ সালে, এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করাকালেই ব্রিটিশ কাউন্সিলের মধ্যস্থতায় দশ মাসের জন্য বৃত্তি নিয়ে গেলাম লিডস শহরে। লিডস তখন বামপন্থি বিপ্লবীদের জায়গা। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন বামপন্থিদের তৎপরতা ছিল এবং সর্বোপরি তখন ছিল ‘অ্যাংরি ইয়াংম্যানদের’ যুগ। পঞ্চাশ দশকের শেষ ও ষাটের দশকের শুরুতে একটা আন্দোলনই দেখা দিয়েছিল ইওরোপজুড়ে। ছাত্রদের একটি জাগরণকাল ছিল সেটি। সেই অ্যাংরি ইয়াংম্যানরা সারাবিশ্বের পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিল। চারদিকে নানান কথা হচ্ছে, আলাপ হচ্ছে। আবার ওদিকে লেবার পার্টি শক্তিশালী হচ্ছে। তখন একটি পত্রিকা প্রভাবশালী ছিল ওখানে, নিউ স্টেটসম্যান। সাপ্তাহিক পত্রিকা, তখন আমি নিয়মিত পড়তাম। সেখানে ওই যে অ্যাংরি ইয়াংম্যানদের একটি আবহাওয়া, সেটি আমাকে প্রভাবিত করল। অ্যাংরিরা সমাজতন্ত্রী ছিল না, কিন্তু ওরা প্রচলিত ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষিপ্ত ছিল। সেই সময়ে চীনের মতামতগুলো আসছে, এবং আমার ইংল্যান্ডের বন্ধু-বান্ধব যারা, তারা সেগুলো তখন অনুসরণ করছে। তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় আমি সমৃদ্ধ হয়েছি। এবং সেই ধারণা নিয়ে আমি ফিরে এসেছি। আমি যখন দেশে এলাম, এখানে তরুণরা, যেমন ধরি কণ্ঠস্বর দলটি, তারাও সেই প্রতিবাদী আবহ গ্রহণ করেছে। মনে হয়েছিল, পুঁজিবাদবিরোধিতা তারা পেয়েছিল, কিন্তু পথের সন্ধান তখনও পায়নি। 
আমি কিন্তু লিডসের অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি, শুধু অ্যান্টি-ক্যাপিটালিস্ট হলে চলবে না, সমাজতন্ত্রী হতে হবে। তখন আমি বুঝেছিলাম, সেই যে প্রথম জীবনে স্বাতন্ত্র্যের কথা বলতাম, ভাবতাম, সেই চিন্তাটি সম্পূর্ণ ছিল না। সম্পূর্ণ ছিল না এই অর্থে, স্বাতন্ত্র্য ব্যক্তি আলাদা ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। স্বাতন্ত্র্য আনতে হলে সমাজকে বদল করতে হবে। অন্যথায়, সমাজ (প্রচলিত) স্বাতন্ত্র্যের শত্রু। ব্যক্তিকে বিকশিত হতে দেবে না, এবং ব্যক্তির সামষ্টিক মুক্তিকে প্রতিহত করে যাবে। সেই মুহূর্তে, ব্যক্তির মুক্তি যে সমষ্টির মুক্তির মধ্যে নিহিত, সেটি আমি তখনই উপলব্ধি করি। তখন, নাগরিক ছদ্মনামের লেখাগুলোয় আমাদের সমসাময়িকদের আমি বেশ আক্রমণ করতাম। এটা ঠিক না। এই দ্বন্দ্বটাও আমার মধ্যে তৈরি হয়ে গেল। তখন এটা নিশ্চিত হয়েছি, ব্যক্তি-মালিকানা চলবে না। সামাজিক মালিকানায় যেতে হবে। এটাই বিশ্বাস ও ব্যক্ত করেছি। আমি আর এই লাইন থেকে কখনও বিচ্যুত হইনি। ক্রমাগত দেখেছি আমি, পুঁজিবাদ কীভাবে ফ্যাসিবাদে রূপ নিচ্ছে। শুরুতে যেটা বলছিলাম, পৃথিবীকে দেখার চোখ আমার আরও স্বচ্ছ হয়েছে, সেই কথার সূত্রে বলা যায়, স্বচ্ছ হয়েছে এই ধারণটাই যে–ব্যক্তি-মালিকানার যুগ শেষ হয়েছে, এখন সামাজিক মালিকানার যুগ। তাকে আহ্বান করছি। 
l  বর্তমানের প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক পন্থায় আমাদের দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব?
ll গণতান্ত্রিক পদ্ধতি সারা বিশ্বেই এখন বিপন্ন হয়ে গেছে। হিটলার-মুসোলিনির যে ফ্যাসিবাদ তা এখন ভীষণভাবে পুনরুজ্জীবিত। তবে পার্থক্য হলো, সেই সময় হিটলারের বিরুদ্ধে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোও প্রতিবাদ করেছে। এখন তা দেখা যাবে না। সমস্ত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এখন পুরোপুরি হিটলারের আদর্শ অনুসরণ করেছে; যার প্রকট দৃষ্টান্ত–ইসরায়েলের কার্যক্রম। নেতানিয়াহু যা করেছে ফিলিস্তিনে ও ইরানে তা হিটলারের কাজ। সেই কাজই সে করছে; যা একদিন হিটলার তাদের ওপর করেছিল, এবং তা বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে করে চলেছে। এই সংকট পুঁজিবাদেরই সংকট। যে কারণে, এ মুহূর্তে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বলতে যা বোঝায় তার মাধ্যমে পৃথিবী বদলানোর উপায় কোথায়। গণতন্ত্র বলতে যে তন্ত্র বোঝানো হয়, সেটি আসলে সংসদীয় গণতন্ত্র। এই সংসদীয় গণতন্ত্রে যারা নির্বাচিত হবে, তারা পুঁজিবাদীদের মতোই হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বার্নি স্যান্ডার্স সমাজতন্ত্রের প্রতিনিধি হিসেবে প্রেসিডেন্ট হতে চেয়েছিলেন। মনোনয়নই পেলেন না। এখন তো তাঁর কণ্ঠস্বরও শোনা যায় না। এখন চলছে ট্রাম্পের রাজত্ব। ট্রাম্প কিন্তু নির্বাচিত হয়েই এসেছে। নির্বাচিত হওয়ার সীমাবদ্ধতা এখানে উন্মোচিত হয়। ভারতে একটি অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল সরকার ধর্ম-বর্ণবাদিত্বের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে, তারাও নির্বাচিত। ইতালিতে ফ্যাসিস্ট নামধারীরাই নির্বাচিত হচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয়, এই নির্বাচনী পদ্ধতিতে সমাজবদল হবে না। সমাজবদল করতে হলে আন্দোলন প্রয়োজন হবে, এবং আন্দোলন শেষ পর্যন্ত পরিণত হবে অভ্যুত্থানে। তবে এই পর্যায়ে একটি শিক্ষণীয় বিষয় আলোচ্য হয়ে ওঠে, তা হলো– এক দেশে বা একটি অঞ্চলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে তা টিকবে না। সমাজতন্ত্রের তো একটি দেশ ছিল। টিকল না। কেননা একটি ভূখণ্ডে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মাত্র। সমস্ত পৃথিবীতেই আজ সামাজিক বিপ্লব দরকার। সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়েই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে আমরা মুক্তি পাব, এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে। সমাজ বিপ্লবের দুটি শর্ত– এক. এটি আন্তর্জাতিক হতে হবে। দ্বিতীয় শর্তটি বড় শর্ত। তাহলো, এর জন্যে সাংস্কৃতিক প্রস্তুতি দরকার। জ্ঞানের অনুশীলন ছাড়া যা সম্ভব নয়। বুর্জোয়াদের চেয়েও বেশি জ্ঞানের অধিকারী হয়ে ওঠা চাই। মানুষকে সেই জ্ঞানের দিকে আকৃষ্ট করতে হবে। 

আরও পড়ুন

×