২০০ বছরের পুরোনো হাট

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়া ইউনিয়নে কাইকারটেক হাট
হাসান মাহমুদ রিপন
প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৪ | ০০:০৫
মফস্বল শহরের ছোট্ট গ্রামের বিশাল হাট কাইকারটেক। কালের বিবর্তনে আধুনিকতা আর শিল্পায়নের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে হাটের জৌলুস। তবে প্রায় ২০০ বছর ধরে ঐতিহ্য ধরে রেখেছে কাইকারটেক হাট। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের মোগরাপাড়া ইউনিয়নে হাটটির অবস্থান। ‘পুতা’ নামের এক ধরনের বিশেষ মিষ্টির জন্য বিখ্যাত এ হাট। তবে কাইকারটেক হাটে পাওয়া যায় না, এমন কোনো পণ্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। প্রতি সপ্তাহের রোববার এখানে হাট বসে। কাছে দূরের অনেকে আসেন তাদের পসরা নিয়ে। সেই ভোরে হাট শুরু হয়ে শেষ হয় সন্ধ্যাবেলা। লিখেছেন হাসান মাহমুদ রিপন
টাটকা শাকসবজি থেকে শুরু করে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি, বিভিন্ন মসলা, মাছ, মাংস, মাছ ধরার জাল, জাল তৈরি সুতা, বাঁশ, কাঠ, নৌকা, লোহা ও বাঁশের তৈরি সামগ্রী, গৃহনির্মাণের কাঠ, পোশাক, বই-খাতা কী নেই এখানে! পুরোনো দিনের হাটের সব ঐতিহ্য এখনও বজায় রেখেছে সোনারগাঁ উপজেলার মোগরাপাড়া ইউনিয়নের কাইকারটেক গ্রামে অবস্থিত দুইশ বছর বয়সী কাইকারটেক হাট। আদি ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে হাটটির চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ খুবই অপরূপ। এ প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝে হাটটি প্রাচীন ঐতিহ্য গৌরবের সঙ্গে বুকে লালন করে চলেছে। এ হাটের প্রাচীন নিদর্শন কড়ই এবং হিজল গাছগুলো যেন হাটের বয়সকালের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গত এক বছর আগে হাটের মাঝে পাতাঝরা প্রাচীন কড়ই গাছটি ভেঙে পড়ে গেলে, তা কেটে ফেলা হয়।
২০০ বছর ধরে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যকে ধারণ করা বিশাল এ কাইকারটেক হাট। লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে– একসময় এই হাটে হাতি-ঘোড়াও নাকি বেচাকেনা হতো! ছিল রাজা-বাদশাহদের আনাগোনাও।
হাটের পাশেই ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে কাইকারটেক ব্রিজ। যেখানে প্রতিদিন বিকেলে শত শত লোকজন বেড়াতে আসেন। ব্রিজ থেকে চারদিকে তাকালে সবুজ বাংলার কথা মনে পড়ে যায়। ব্রিজের ওপরে পাওয়া যায় ফুচকা, চটপটি, ঝালমুড়ি; যা মানুষের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে তোলে। আদি ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে এ হাট বসায় দূরদূরান্ত থেকে নদীপথে অনেক ব্যবসায়ী এ হাটে আসেন কেনাবেচা করতে। তবে হাটের প্রবীণ বাসিন্দারা জানান, আগে শুধু বেচা বিক্রিই নয়, হাটের মধ্যে মনোরঞ্জনের জন্য সাপের খেলা, বানরের নাচ, জাদুর ভেলকিসহ নানা আয়োজন হতো।
প্রবীণরা জানান, আগে অনেক গানবাজনা হতো, কুড়া, কার্ড বিস্কুট এখন আর নেই। ঐতিহাসিক নামকরা গরুর হাট ছিল কাইকারটেক। প্রায় ৪০ বিঘা জমি বিস্তৃত এ হাটের পরিসর অনেক কমে এসেছে। কেটে ফেলা হয়েছে অনেক পুরোনো কড়ই গাছ। প্রতি রোববার এই হাটটি বসে বলে একে রোববারের হাটও বলা হয়।
এখানে বিক্রি হয় হাসেম মিয়ার বিশেষ ঝালমুড়ি, বুট, পিঁয়াজু, নিমকি, চানাচুর, মোয়াসহ নানা ধরনের লোকজ খাবার। এ ছাড়াও অনেক পদের মাছের শুঁটকিও এখানে খুব নামকরা। অনেকেই চ্যাপা ও ইলিশ শুঁটকি কিনতে এ হাটে আসেন। এখানে সুই-সুতা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্য পাওয়া যায়। নদীর মাছ, পান-সুপারি, কাঁচা তরকারি, ফলমূল সবই পাওয়া যায় এ হাটে। এখানে বাঙ্গালী, শিবাজী, ময়ূরপঙ্খীসহ দামি দামি কবুতরও পাওয়া যায়। কোষা নৌকা, পোতা মিষ্টি, কাঠ, বাঁশ ও কৃষিজাত পণ্যের জন্য কাইকারটেক হাট সুপরিচিত।
বিখ্যাত পুতা মিষ্টি
এই হাটের অন্যতম আকর্ষণ এক ধরনের বিশেষ মিষ্টি। ওজন আর পরিমাপে অন্যান্য মিষ্টির তুলনায় এই মিষ্টি চার থেকে পাঁচ গুণ বড়। এর ওজন এক থেকে দুই কেজি হয়ে থাকে। অনেকটা শিলপুতার মতো দেখতে এই মিষ্টির নাম দেওয়া হয়েছে ‘পুতা মিষ্টি’। পুতা মিষ্টি ছোট-বড় সবার কাছে জনপ্রিয়; যার স্বাদ মুখে লেগে থাকার মতো। এ হাটের মতোই পুতা মিষ্টির ঐতিহ্যও অনেক পুরোনো। রোববারের এই হাটে শুধু এ মিষ্টির স্বাদ নেওয়ার জন্য দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন অনেক মিষ্টিপ্রেমী। তবে এ মিষ্টি কবে, কে, কীভাবে তৈরি শুরু করেন, এ ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্য দিতে পারেননি এখানকার মিষ্টি তৈরির কারিগর ও ব্যবসায়ীরা। ২০০-২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় পুতা মিষ্টি।
পুতা মিষ্টির বাইরে তালের রসা, কালোজাম, রসগোল্লা, জিলাপি, মোহনভোগ, লালভোগ, বালুশাহসহ নানা পদের মিষ্টি থেকে শুরু করে দই, থাবড়া পরোটা-ভাজি, ডালসহ নানা পদ এখানে পাওয়া যায়। মিষ্টি ছাড়াও এখানে বিক্রি হয় টকদই ও আখের গুড় দিয়ে বানানো লাচ্ছি।
হাটের দোকানি রাজীব ঘোষ বলেন, ‘পুতা মিষ্টি আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকে বানাই। শুধু হাটে বেচাকেনা করলে তো পেট চলব না। আমরা সোনারগাঁয়ে বহু বছর ধরে এই মিষ্টি বানাই। কাইকারটেক ছাড়াও সোনারগাঁয়ের আনন্দ বাজার হাটে এ মিষ্টি বিক্রি হয়। অনেক নতুন ব্যবসায়ী ইদানীং এই মিষ্টি বানানো শুরু করছেন। কিন্তু আমাগো দাদার আমল থেকে এই মিষ্টি বানানো হয়। আমাগো পারিবারিক ব্যবসা বলতে পারেন।’
নৌকার হাট
কাইকারটেক হাটের আরেকটি বিশেষ পণ্য কোষা বা নৌকা। বর্ষা মৌসুমে কম দামে ভালো মানের এই কোষা বা নৌকা বিক্রয় করা হয়। বর্ষায় খাল-বিলে পানি বাড়ে। নিচু এলাকা তলিয়ে যায়। চলাচলের জন্য লাগে নৌকা। মাছ ধরতে দরকার হয় নৌকার। অনেকেই নতুন নৌকা কেনেন। বছরজুড়ে হাট বসলেও বাংলা সনের আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন– এই চার মাস হাটে নৌকার দেখা মিলে। কম দামে ভালো মানের কোষা নৌকা বিক্রির জন্য কাইকারটেক হাটে নৌকা কিনতে ভিড় জমায় নারায়ণগঞ্জের আশপাশের জেলার শত শত ক্রেতা। হাটটির অবস্থান ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী হওয়ায় সেখান থেকে নৌকা ক্রয় করার পর নদের জলে ভাসিয়ে যার যার গন্তব্যে পৌঁছানো অনেকটাই সহজসাধ্য ব্যাপার।
সরেজমিন হাটে গিয়ে দেখা গেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছু পাওয়া যায় এ হাটে। হাটে প্রবেশ করলে প্রথমেই দেখা মিলবে সবাই উৎসবমুখর পরিবেশে বেচাকেনায় ব্যস্ত। দোকান বসেছে, পসরা সাজানো হয়েছে হাটে। দলে দলে লোকজন আসছে কেনাকাটা করতে। খাবার জিনিস থেকে শুরু করে ঘর বানানোর আসবাব। পাওয়া যায় ডিঙ্গি নৌকা। কিংবা সবুজ বনায়নের জন্য গাছগাছালি। আরও পাওয়া যায় অনেক শখের জিনিস। হাটে মাছ ধরার জাল, বড়শি, টেঁটা ছাড়াও রয়েছে শাকসবজি, খাল ও নদীর মাছ, মসলা, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, কবুতর, কাস্তে, দা, বঁটি, কুড়াল, জামাকাপড়, কলমের গাছ, বাঁশ, কাঠসহ নিত্যব্যবহার্য নানা কিছু।
হাটে নৌকা বিক্রি করতে আসা গজারিয়া উপজেলার হোসেন্দী গ্রামের রজ্জব আলী মিয়া বলেন, ‘হাটে প্রথমে আমার দাদা, পরে বাবা আর ৩৫ বছর ধরে আমি নিজে নৌকা বিক্রি করছি।’ বাঁশ বিক্রেতা মোতালেব হোসেন জানান, ময়মনসিংহ থেকে বাঁশ নৌপথে এখানে আসে। সোনারগাঁ, চেঙ্গারচর, মুন্সীগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ক্রেতাগণ এখানে আসেন। বর্ষা মৌসুমের শেষ দিকে তাদের বাঁশের কেনাবেচা ভালো হয়।
কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, এই হাটটিতে সব জিনিসপত্র পাইকারি দামে পাওয়া যায়। এখানে এমন কোনো জিনিস নেই যে, পাওয়া যায় না। আবার অনেক ব্যবসায়ী এখান থেকে জিনিসপত্র কিনে তাদের দোকানে বিক্রি করেন। হাটে কেনাকাটা করতে এসেছেন সনমান্দির বড়ইকান্দি গ্রামের রমজান হাসান। তিনি বলেন, ‘এ হাটে আমি ছোটবেলায় দাদা ও বাবার সঙ্গে এসেছি। এ হাটের ঐতিহ্য অনেক। এটি জেলার প্রাচীন হাট। এখানে অনেক লোকজন আসেন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে। দামেও সস্তায় পাওয়া যায় জিনিসপত্র।’
হাটে আসা ষাটোর্ধ্ব রমিজ উদ্দিন মাতবর জানান, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকাল থেকে বাবার সঙ্গে এ হাটে আসা শুরু হয়। আমার বাবাও দাদার সঙ্গে এ হাটে আসতেন।’ রমিজ উদ্দিনের মতো আরও অনেকে যুগ যুগ ধরে এ হাটে আসা-যাওয়া করেন।
কথা হয় ৮১ বছর বয়সী শরবত বিক্রেতা মজিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, এই কাইকারটেক হাটে তিনি পাকিস্তান আমল থেকে আসছেন। তিনি এই হাটে ৬৫ বছর ধরে শরবত বিক্রি করছেন। বয়স হয়ে যাওয়ায় তাঁর ভাগিনা আশরাফ উদ্দীন তাঁকে সঙ্গ দেন। মজিবুর রহমান জানান, তাঁর দোকানে আখের গুড়, লেবু ও বরফের মাধ্যমে সুমিষ্ট শরবত তৈরি করা হয়। তাদের দোকানের শরবতের নামডাক দীর্ঘদিনের। দূরদূরান্ত থেকে যারাই এই হাটে বাজার করতে আসেন, তারা এই দোকানের শরবত না খেয়ে যান না।
কাঠ বিক্রেতা সাইদুর রহমান জানান, তিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে এখানে কাঠ বিক্রি করেন। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের মতো নেই; যার কারণে তাঁর কাঠের ব্যবসা এখন খারাপ যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এই পেশার সঙ্গে তিনি যুক্ত। তাই এই পেশা ছেড়েও দিতে পারছেন না।
মাছ ধরার জাল বিক্রি করছেন মুসা মিয়া। তাঁর
বয়সও ৭০-এর কোটায়। তিনি বলেন, ‘আমার দাদার আমল থেকে এ হাট বসতে দেখে আসছি। এখানে জিনিসপত্র খুবই সস্তায় পাওয়া যায়। তাই দূরদূরান্ত থেকেও মানুষ আসে।’
- বিষয় :
- হাট-বাজার