কারাবন্দি নয় তারা শিক্ষার্থী

ওয়ালডেমার কিউবিলা
প্রমিত দেবনাথ
প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৩:২৯
কারাগারে অবস্থিত এক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সেন্ট্রো ইউনিভার্সিটারিও সান মার্টিন (সিইউএসএএম)। এটি আর্জেন্টিনার রাজধানী শহর থেকে প্রায় এক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত। সেখানে কারাবন্দি নারী-পুরুষ এবং কারাগারের কর্মীরা কাছাকাছি অবস্থিত ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সান মার্টিন-এর অনুমোদিত ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাটিয়াস ব্রুনো বলেন, ‘এটি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই। বন্দি ও কারারক্ষীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রমেই অংশগ্রহণ করতে পারেন।’ তবে ব্রুনোর মতো বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে, কারাগারের পেছনে যে অর্থায়ন, সেখানে শিক্ষার জন্য হয়তো সামনের দিনগুলোতে কম বরাদ্দ থাকবে। ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেই ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে কয়েক মাস ধরে এই ভয় আরও বেড়েছে। তিনি খরচ কমানোর অংশ হিসেবে দেশের কারাগার ব্যবস্থাকে বেসরকারীকরণের উদ্যোগ নিয়েছেন।
এদিকে, ওয়ালডেমার কিউবিলার সাফল্যের গল্প এবং সিইউএসএএমের মতো কারাগার শিক্ষা কর্মসূচি সম্ভাবনার প্রতীক হয়ে উঠেছে। কিউবিলা কেবল এই কর্মসূচি থেকে উপকৃত হননি। তিনি তাঁর নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। কিউবিলা যখন প্রথম গ্রেপ্তার হন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। দেশের বৃহত্তম উন্মুক্ত আবর্জনার পাশে নির্মিত একটি অনানুষ্ঠানিক বসতি লা কারকোভায় জন্মগ্রহণ করা কিউবিলা আর্জেন্টিনার সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের সময় বড় হয়েছেন।
১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে দেশটি গভীর অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পড়ে যায়। লা কারকোভার অনেক লোকের মতো কিউবিলাও আশপাশের অন্যান্য কিশোর-কিশোরীদের একত্র হয়ে চুরি করা শুরু করেন। এত কিছুর মধ্যেও কিউবিলা স্কুলে যাওয়া চালিয়ে যান। জানা ও শেখার মধ্যেই নিজের শান্তির আশ্রয় খুঁজে পান। তাঁর স্ত্রী দুই সন্তানের মা জিসেলা পেরেজ। কিশোর বয়সে তাঁর এবং কিউবিলার দেখা হয়। তখনই কিউবিলা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। ব্যাগে বইয়ের পাশাপাশি একটি বন্দুকও বহন করতেন কিউবিলা। ২৩ বছর বয়সে কিউবিলাকে সশস্ত্র ডাকাতির অভিযোগে দু’বার গ্রেপ্তার করা হয়। প্রথমবার কিশোর সংশোধনাগারে পাঠালেও দ্বিতীয়বার পাঠানো হয় সর্বোচ্চ নিরাপত্তার কারাগারে, যেখানে তিনি পাঁচ বছর কাটান। কিউবিলা বলেন, ‘কারাগারে একটি ছোট ঘর ছিল। সেখানে যারা আইন পড়তে চান, তারা পড়ার জিনিসগুলো পেতেন এবং পরীক্ষায় বসতে পারতেন।’ ডিপ্লোমা শেষ করার পর তিনি কারাগারের পরিচালককে আইন নিয়ে পড়াশোনা করার অনুমতি দেওয়ার জন্য রাজি করান। কিউবিলা বলেন, ‘সেখানে আমাদের কোনো শিক্ষক ছিলেন না। আমি সকালে ক্লাস শেষ করতাম এবং বিকেলে আমাকে আইনের বইগুলো পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়। আমি নতুন অনেক কিছু শিখছিলাম এবং এর মধ্য দিয়ে আমি সেলের বাইরে সময় কাটাতে পারতাম।’
২০০৫ সালে যখন কিউবিলা মুক্তি পান, তখন আইনের ডিগ্রি সম্পন্ন করার জন্য একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু অর্থাভাবে তা সম্ভব হয়নি; বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি প্রদানের জন্য তিনি আবারও গাড়ি ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়েন। কিউবিলা বলেন, ‘একদিকে অপরাধের জগৎ এবং অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একই সঙ্গে দুটি জগতে বাস করা অদ্ভুত এক ব্যাপার।’ তবে তাঁর সেই দ্বৈত জীবন বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তৃতীয়বার যখন কিউবিলাকে গ্রেপ্তার করা হয়, তখন তাঁকে একটি নতুন কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে সান মার্টিনের ইউনিট-৪৮ ভবনে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছিল। কিউবিলা ২০১১ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান। বহু বছরের কারাবাসের পর তাঁর নিজ শহর লা কারকোভার জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কঠিন ছিল। তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেকের জীবনই বদলে গেছে। আমাদের নতুন চাকরি ছিল সে সময়, যা আমাদের ব্যস্ত রাখছিল এবং বাচ্চাদের বড় করতে সাহায্য করছিল।’
কিউবিলা সম্প্রতি কারাবাস নেশনস নেটওয়ার্কের সঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক ফেলো হয়ে উঠেছে, যা বিশ্বজুড়ে কারাগারে মানুষের জন্য উচ্চ স্তরের শিক্ষার প্রচারের একটি বিশ্বব্যাপী উদ্যোগ। তিনি বলেন, ‘বিষয়গুলো কঠিন ছিল। আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। এখন পর্যন্ত যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি, তার অনেকগুলোই বিশুদ্ধ অন্তর্দৃষ্টির ওপর ভিত্তি করে। আমরা জানি, শিক্ষাই মুক্তির সর্বোত্তম কৌশল।’ v
- বিষয় :
- কারাবন্দী