ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

গাছ ও পাখির বন্ধু ফজলে রাব্বী

গাছ ও পাখির বন্ধু ফজলে রাব্বী

.

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৫ | ০০:২৭

বন্যপ্রাণীর প্রতি অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে জাতীয় পুরস্কার ২০২৫’ (ব্যক্তি পর্যায়) পেয়েছেন নাটোর জেলার নলডাঙ্গা উপজেলার পূর্ব মাধনগরের মো. ফজলে রাব্বী। লিখেছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

নাটোরের গ্রামগুলোতে একটা সময় ছিল যখন পাখি শিকারের ধুম পড়ে যেত। বন্দুক, ফাঁদ, জালসহ নানাভাবে বক, শামুকখোল, বেলেহাঁস শিকারে মেতে উঠত একদল মানুষ। বন্যপ্রাণীর প্রতি ছোটবেলা থেকেই রাব্বীর অনেক মায়া। তাই পাখি শিকার দেখে তাঁর খুব মন খারাপ হতো। শিকার করতে নিষেধ করলে কে শোনে তাঁর কথা! বড় হয়ে তাই শুধু নিজে একা নয়; গ্রামবাসীকে নিয়ে সব ধরনের শিকার বন্ধ তো করলেনই, উপরন্তু আশপাশের অনেক গ্রামবাসী রাব্বীর তৎপরতায় সচেতন হয়ে উঠেছেন। সময়টা ছিল ২০১১ সাল। তখন থেকে তিনি লিফলেট, মাইকিংসহ নানাভাবে মানুষের কানে পৌঁছাতে চেষ্টা করেছেন যে বন্যপ্রাণী শিকার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এ পর্যন্ত রাব্বী কয়েকশ বন্যপ্রাণী শিকার রোধ করেছেন। ফাঁদ তুলে নষ্ট করেছেন। আহত পাখি সুস্থ করে ছেড়ে দিয়েছেন অসংখ্য। অসুস্থ পাখির প্রাথমিক চিকিৎসায় যা যা করতে হয়, তা রাব্বী শিখে নিয়েছেন এ বিষয়ে অভিজ্ঞদের কাছ থেকে। 
পাখি শিকার একরকম বন্ধ হয়েছে বটে; কিন্তু গাছ কাটার যে হিড়িক চলছে– তাতে পাখিরা বাসা বাঁধবে কোথায়? এই ভাবনা থেকে গাছ লাগানোর নেশা তাঁকে পেয়ে বসে। অবশ্য বাবা গাছ লাগাতেন। তাঁর থেকে তো অনুপ্রেরণা পেয়েছেনই। পথের ধারে একটুখানি ফাঁকা জায়গা দেখলেই গাছ লাগিয়ে দিতেন রাব্বীর বাবা। গাছ আর বন্যপ্রাণীর প্রতি মমতা থেকে যে পথচলা, তা একসময় রাব্বীকে এনে দাঁড় করায় এক অনন্য পরিচয়ের মুখোমুখি। স্নাতক শেষ হওয়ার আগেই মানুষ তাঁকে চিনতে শেখে ‘গাছ ও পাখির বন্ধু’ নামে– প্রকৃতির এক নির্ভরযোগ্য সাথি হিসেবে। যারা একসময় তাঁর কাজগুলো ভালো চোখে দেখত না, তারাই নাকি এখন রাব্বীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পেশাগত জীবনে একটি জাতীয় পত্রিকার স্থানীয় সংবাদদাতার কাজ করছেন রাব্বী। বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ সুরক্ষা নিয়ে তাঁর কলম ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তাঁর সাহসী প্রতিবেদন বোদ্ধামহলের দৃষ্টি কেড়েছে। অনেক সময় তাঁর রিপোর্ট প্রকাশের পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তৎপর হয়েছে। ফলে অপরাধমূলক অনেক কর্মকাণ্ড ঘটার আগেই থেমে গেছে। ২০১৫ সালের মে মাসে নিজের গ্রাম মাধনগরে গড়ে তুলেছেন ‘সবুজ বাংলা’ নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। প্রথমে এর সদস্য ছিল ২১ শিশু-কিশোর। ‘যত গাছ তত পাখি’ স্লোগানে সবুজ বাংলা সংগঠনের সদস্য সংখ্যা এখন শতাধিক। অনেক গ্রামে রয়েছে সংগঠনটির শাখা। এটি বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফেডারেশনের (বিবিসিএফ) সদস্যভুক্ত সংগঠন। এর সদস্যরা বিবিসিএফ ও বন বিভাগের বিভিন্ন কর্মসূচিতেও অংশ নেন। ইতোমধ্যে বন বিভাগের (রাজশাহী) ক্রেস্ট ও সম্মাননা সনদ, সেভ দ্য নেচার, ঢাকা পুরস্কার পেয়েছে সবুজ বাংলা। 
২০২৩ সালে একটি স্টেপ ঈগল নাটোরের হালতি বিলে এক কৃষক খুঁজে পান। পরে এক সপ্তাহের বেশি সময় চিকিৎসার পর পাখিটিকে প্রাকৃতিক পরিবেশে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বন বিভাগ এবং স্থানীয় পাখিপ্রেমী সংগঠন ‘সবুজ বাংলা’র সহায়তায় এই শিকারি পাখিটিকে উদ্ধার করা হয়েছিল। বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে রাব্বীকে পেরোতে হয়েছে নানা বাধা-বিপত্তি। তিনি বলেন, ‘ভালো কাজ করতে গেলে বাধা আসবেই। এতে ভয় পেয়ে থেমে গেলে পরিবর্তন আসবে কীভাবে?’
রাব্বীর প্রতিষ্ঠিত সবুজ বাংলা সংগঠনটির কাজের পরিধি বেড়েছে। তাদের কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ হলো– বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গণসচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা, বন্যপ্রাণী উদ্ধার অভিযান পরিচালনা, বন্যপ্রাণী শিকারে ব্যবহৃত সরঞ্জাম উদ্ধার, বন্যপ্রাণী অপরাধ নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ইত্যাদি।
দিনবদলের নিরলস কারিগর রাব্বীর প্রচেষ্টা ও সচেতনতার ফলে এখন শুধু তাঁর নিজ গ্রাম নয়, আশপাশের বহু গ্রাম হয়ে উঠেছে বন্যপ্রাণীর জন্য এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল। পানকৌড়ি, শামুকখোল, সাদা বক, নিশিবক, কানিবক, রাতচরা, ডাহুক, ঘুঘু, মাছরাঙা, শালিক, ফিঙ্গেসহ হাজারো পাখি নিশ্চিন্তে বসবাস করছে এই সবুজ পরিবেশে। শুধু পাখিই নয়, সাপ, বেজি, শেয়াল, কচ্ছপের মতো নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণীও এখন সেখানে অবাধে দিনাতিপাত করছে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সহাবস্থানের এক অনন্য দৃষ্টান্ত গড়ে তুলেছেন তিনি–নিঃশব্দে, নিরবচ্ছিন্নভাবে। এসব বন্যপ্রাণীর নিরাপদ অবস্থান এ অঞ্চলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ব‍্যাপক অবদান রেখে চলেছে। v

আরও পড়ুন

×