ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

আরাবির মৌয়াল জীবন

আরাবির মৌয়াল জীবন

আরাবি ও তাঁর মৌমাছিরা

 ইমতিয়াজ আহমেদ

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৩:২০

কয়েকদিন ধরেই রোদের উত্তাপ বেড়েছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার আগে আকাশে বিদ্যুৎ চমকায়। বৃষ্টির অপেক্ষায় বৃক্ষরাজি। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ভোররাতেই ঝুমবৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যেই ৩০০ মৌমাছির বাক্স নিয়ে পলিথিনে মোড়ানো তাঁবুতে ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার নাওগাঁও ইউনিয়নে অবস্থিত সন্তোষপুর রাবার বনে কোনোরকমে মাথা গুঁজেছে আরাবি। সকাল হতেই দেখে নিচ্ছে মাছির বাক্সগুলোকে, কোনো ক্ষতি হলো কিনা। এরই মধ্যে কয়েকটা শিশু হাত পেতে বসে আছে, কখন আরাবি মধুর কন্টি থেকে তাদের তালুতে একটুখানি মধু ঢেলে দেবে, তা চেটেপুটে খেতে খেতে বাড়ির দিকে রওনা হবে তারা। তবে এখনও রানী মাছির সঙ্গে আলাপ শেষ হয়নি তার। প্রতিদিন এরকম সকাল-বিকেল, দুপুর, রাতে মৌমাছিদের সঙ্গে কথা হয় আরাবির। কখন মৌমাছিরা রেগে যায়, মন খারাপ করে, কখন আনন্দে মাতোয়ারা হয়, তাদের গুঞ্জনেই সব বুঝে নেয় ১৬ বছরের এই কিশোর। কেননা, গত সাত বছর ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, ফসলের মাঠে, বনবাদাড়ে মৌমাছির সঙ্গেই কেটেছে আরাবির জীবন।
সন্তোষপুর রাবার বাগানে ১৫ দিন ধরে তাঁবু গেড়েছে সে। সকালে মৌমাছিগুলো উড়িয়ে দেয়; ঠিক সন্ধ্যার আগেই মধু সংগ্রহ করে ফিরে আসে তারা। সাম্প্রতিক বৈরী আবহাওয়ায় বিভিন্ন ফসলের ফুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই মধু সংগ্রহ করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন কচি রাবার পাতার মধু সংগ্রহ করতেই এ বনে এসেছে। 
কৃষক পরিবারের মা-বাবার একমাত্র সন্তান আরাবি। আরাবি তখন অনেক ছোট। পথ চেয়ে থাকে কখন তার বাবা সারাদিন মাঠে মজুরখাটা শেষে বাড়ি ফিরে আসবে। বাজারে নিয়ে গিয়ে জিলাপি কিনে দিয়ে বলবে, ‘এবার বাড়ি যাও বাজান…’। তখন সরিষা ফুলের মৌসুম। আরাবি প্রতিদিনের মতোই পথ চেয়ে আছে তার বাবার ফিরে আসার। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল বাবা আর ফেরে না। অবশেষে সন্ধ্যার ঠিক আগে আরাবির বাবা ফিরল; তবে লাশ হয়ে। কাজে গিয়ে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। সেই থেকে নাওয়া-খাওয়া ফেলে ঠায় চেয়ে থাকে সরিষা ফুলের দিকে। একদিন সকালবেলা দেখে এক লোককে ঘিরে আছে গ্রামের সব ছেলেমেয়ে। কাছে গিয়ে খেয়াল করে কিছু বাক্স ভরা মৌমাছি নিয়ে লোকটি বসে আছেন; সেখান থেকে মাছিগুলো উড়ে যাচ্ছে মাইলের পর মাইল। বেশ সখ্য হয় আরাবির সঙ্গে মৌয়ালের। সেই মৌয়ালের বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশালে। তাঁর নাম আনিসুর রহমান। সেখানে থাকেন মাসখানেক। গল্প গুজব আর সময় কাটানোর একটা সঙ্গী পেল আরাবি। আনিসুর রহমানও খুব অল্প সময়ে আরাবিকে আপন করে নেন। তিনি যখন মধু সংগ্রহ শেষে বাড়ির দিকে ফিরে যাচ্ছিলেন খুব মন খারাপ হয় আরাবির। মৌয়াল আর মাছিগুলোর জন্য তাঁর খুব মায়া হয়। তাই মাকে কিছু না বলেই ওই মৌয়াল আনিসুরের সঙ্গে রওনা হয় ৯ বছরের আরাবি। তার প্রিয় গ্রাম টাঙ্গাইলের নাগরপুর। মনে মনে স্থির করে নেয়, সেও মৌয়াল হবে। সেই থেকে ঘর ছাড়া আরাবি। সাত বছর ধরে আনিসুরের মৌমাছির বাক্স এবং মধু সংগ্রহের কাজ করেন আরাবি। মৌমাছির বাক্স নিয়ে ঘুরে বেড়ান ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, রাজশাহী, দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায়। তার অধীনে থাকা ৩০০ বাক্সের মধ্যে এখন পর্যন্ত ২০টি বাক্সের মালিক সে নিজে।
আরাবি বলে, ‘মৌমাছি নিয়াই আমার সংসার। বনবাদাড়ে ঘুইরা বেড়াই। বছরে ১-২ বার মায়ের কাছে যাই। মায়ের জন্য টেকা পাঠাই, খুব মনে পড়ে মায়ের কথা। কী করমু বাড়ি গেলে মৌমাছিরা রাগ করে। অগরে দেখনের তো কেউ নাই। আমিও টেকা জমাইতাছি আরও মৌমাছির বাক্স কিনুম। লাবের সব টেকা মায়ের হাতে তুইলা দিমু। আমি ছাড়া মায়ের আর কেউ নাই দুনিয়ায়। প্রতিবছর এ মৌমাছি থেইকা মালিক ৫-৭ লাখ টাকার মধু বেচতে পারে। দিনে দিনে মধুর ব্যাপক চাহিদা বাড়তাছে। বড় বড় কোম্পানিরা আইসা আমগর কাছ থেইকা মধু কিনা নিয়া যায়। তয় মধু অহন কম পাওয়া যাইতাছে।’
আরাবির মতে, মাঠে এখন সরিষা, তিল, কালিজিরাসহ বিভিন্ন ফলের চাষ কমে যাচ্ছে দিনকে দিন। মৌমাছি পরাগায়ন করে; যার ফলে ওই জমিতে ফসল ভালো হয়। যেই জমিটিতে একজন কৃষক ৫০ শতাংশ ফসল ঘরে তুলতে পারবেন বলে আশা– তার আশপাশে যদি মৌমাছি থাকে, তবে সেখানে ফসল হবে ৭৫ শতাংশ। সরিষা, আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, মাল্টা, লেবু, বড়ই ফুলের মধুর চাহিদা বেশি। আরাবি মনে করে সবাই যদি বিভিন্ন ফলের গাছ লাগায়, পরিচর্যা করে তাহলে একদিকে যেমন উৎপাদন বাড়বে, অন্যদিকে মধুর উৎপাদনও বাড়বে।
আরবি বলে, ‘বিনা সুদে আমাদের মতো মৌয়ালদের ঋণ সুবিধা দিলে আমরা আরও আগায়ে যেতে পারমু। আমার খুব ইচ্ছা এক সময় আমার নিজের কয়েক হাজার বাক্স মৌমাছি থাকবে। মণকে মণ মধু বেচব, দেশে-বিদেশে আমার মধুর নামডাক হইব। অনলাইনে মধু বিক্রি করার ফলে বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি ক্রেতাগর কাছ থেইকা। বর্ষাকালে মধু সংগ্রহ বন্ধ থাকে, ওই সময় মৌমাছিকে খাবার কিনে খাওয়াইতে হয়।’
এখন সন্তোষপুর বাগান থেকে অন্য কোথাও চলে যাবে আরাবি। 
মাতাল মৌমাছির ঘ্রাণ শুঁকে শুঁকে পৌঁছে যায় মধুর সন্ধানে। মৌয়ের ডানায় হয়তো পৌঁছায় আরাবিও। আদতে আরাবির চোখ ভরা থাকে সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের গল্প। গভীর ঘুমেও শস্য-শ্যামল ফুলে ফুলে ঢলে পড়া একটা বাংলাদেশের মানচিত্রই সে আঁকে। আরাবির স্বপ্নগুলো বেঁচে থাক। v
 

আরও পড়ুন

×