জীবন্ত সত্তার পরিদর্শন

বুড়িগঙ্গা নদী পরিদর্শন
লাবণী মণ্ডল
প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৮:৫৫ | আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৯:১০
১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের চতুর্থ রোববার বিশ্ব নদী দিবস হিসেবে পালন করে ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। এরপর ২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সহযোগী সংস্থা দিবসটি পালন করছে। বাংলাদেশে ২০১০ সালে ‘রিভারাইন পিপল’ এ দিবস পালন করে। এ বছর ২২ সেপ্টেম্বর ছিল বিশ্ব নদী দিবস। এ উপলক্ষে ২৪ সেপ্টেম্বর পরিবেশবাদী সংগঠন ‘নোঙর’ আয়োজন করে বুড়িগঙ্গা নদী পরিদর্শন।
সকাল ৯টায় আমরা কয়েকজন বছিলা জাহাজঘাটের উদ্দেশে রওনা দিই। বছিলায় যখন পৌঁছাই, তখন বাজে সকাল সাড়ে ৯টা। নদীতে ডিঙি নৌকা দেখে এগিয়ে গেলাম। আশ্বিন মাস হওয়ায় নদীর পানি অনেকটা টলমলে। টং দোকানে দাঁড়িয়ে রং চা খেতে খেতে নদীদূষণ নিয়ে আমাদের আলোচনা চলছে। ইতোমধ্যে অন্যরা এসে উপস্থিত হলেন। নৌকায় চড়ে কিছুদূর গিয়ে আমরা জাহাজে উঠি।
জাহাজ চলছে। সবাই নদী নিয়ে নানান আলোচনায় মেতে উঠেছে। নদীর দু’পাশে বড় বড় বিল্ডিং, স্থাপনা। যে বিল্ডিং নদীর সৌন্দর্য অনেকটাই ম্লান করেছে। নদী মানেই চারপাশে গাছ থাকবে, সবুজের সমারোহ থাকবে। সেসব ভাবতে ভাবতে ভাবনার জগৎ পৌঁছায় শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, ধলেশ্বরী পেরিয়ে বাংলাদেশের সব নদীর দৃশ্যপটের দিকে।
বছিলা এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের ধর্মগঞ্জ পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা এবং ধলেশ্বরী নদীর মোহনায় গিয়ে আবার সদরঘাটে ফিরে আসে বিআইডব্লিউটিএর জরিপ জাহাজ তুরাগ। বুড়িগঙ্গাকে ঢাকার প্রাণ বলা হলেও আজ তার চিত্রপট পুরো ভিন্ন। বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেও নাক চেপে ধরতে হয়, পানিতে অক্সিজেনের বদলে বিষাক্ত পদার্থের দেখা মেলে।
নোঙরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুমন শামস সবাইকে সেমিনার কক্ষে যেতে বলেন। সেখানে নদী, খাল-বিল এবং প্রাণ-প্রকৃতি-প্রতিবেশ নিয়ে সবাই মতামত তুলে ধরেন। বক্তাদের নানা কথায় ফুটে ওঠে আক্ষেপ, স্মৃতিচারণ এবং হারানোর বেদনা। নদীর সঙ্গে যে আত্মিক সম্পর্ক মানুষের, সে সম্পর্ক এখন অনেকটাই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আগামী প্রজন্মের জন্য এটি হুমকিস্বরূপ।
নোঙরের এ আয়োজনে বক্তারা বলেন, বুড়িগঙ্গার এমন পরিস্থিতির কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ণ। নদীর তীরঘেঁষে বিভিন্ন স্থাপনা এবং নদীতে ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচলের ফলে পোড়া মবিলের কারণে বাড়ছে দূষণ। বক্তারা তাদের কথায় তুলে ধরেন– পৃথিবী একটাই, একে রক্ষা করতে হবে এবং রক্ষা করার বোধ তৈরি করতে হবে। ধ্বংস হওয়ার কারণেই যে রক্ষা করার প্রসঙ্গ আসে, এসব বিষয়ে তাদের নানান খেদ প্রকাশ পায়।
নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে দেখিয়ে আইন বাস্তবায়নের কথা বলা হয়। এ প্রসঙ্গে সুমন শামস বলেন, “বাণিজ্যের জায়গায় বাণিজ্য হোক; কিন্তু পরিবেশের জায়গাটা ঠিক রাখতে হবে। আমরা পরিবেশবান্ধব বাণিজ্য, পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের কথা বলি। কেরানীগঞ্জে যেখান থেকে বুড়িগঙ্গা নদী শুরু হয়েছে, আমরা দেখলাম, আমিনবাজারে ওই পয়েন্টে নদী ড্রেন হয়ে গেল। প্রবহমান নদীকে দখল করে ‘মধুমতি মডেল টাউন’ বানিয়েছে। এর বিরুদ্ধে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মামলাও করেছেন। সেই মামলা এখনও আছে। মধুমতি মডেল টাউন আমিনবাজারে নদীর গলা টিপে ধরে রেখেছে। ওয়াশপুরের ওপরে ১৬ কিলোমিটার বুড়িগঙ্গা নদী এখনও দখল আছে। বুড়িগঙ্গার উৎস ধলেশ্বরী থেকে ওয়াশপুর পর্যন্ত দখল করে মধুমতি মডেল টাউনসহ নানা রকম টাউন তৈরি হয়েছে। সেসব উচ্ছেদ করে আমরা বুড়িগঙ্গা নদী দেখতে চাই।” তিনি আরও বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি দলিলের ২০০৫ সালের সংস্করণে এ নদীর দৈর্ঘ্য দেখানো হয় ৪৫ কিলোমিটার। একই দলিলের ২০১১ সালের সংস্করণে বলা হচ্ছে, তা ২৯ কিলোমিটার। এই ১৬ কিলোমিটার অংশ সরকারি দলিলপত্র থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। এই অংশকে বাদ দেওয়ার জন্য বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি ধলেশ্বরী হলেও বলা হচ্ছে তুরাগ নদ।’
বুড়িগঙ্গা নদী প্রসঙ্গে ‘রিভারাইন পিপল’-এর মহাসচিব শেখ রোকন বলেন, ‘ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিকভাবে বুড়িগঙ্গার সম্পূর্ণ অংশ শনাক্ত ও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। নদীটির প্রকৃত উৎসমুখ ও দৈর্ঘ্য নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল। যেমন পানি উন্নয়ন বোর্ড ২৯ কিলোমিটার, বিআইডব্লিউটিএ ৪৫ কিলোমিটার, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ২৯ কিলোমিটার এবং পর্যটন করপোরেশন ২৭ কিলোমিটার হিসেবে বুড়িগঙ্গার দৈর্ঘ্য উল্লেখ করেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নাগরিকদের সচেতনতা না থাকলে সরকারি প্রতিষ্ঠানই নদী খেয়ে ফেলবে। আমরা নদী দিবসসহ বিভিন্ন কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে নদীতে আসি, কারণ নদীটা সরকারের না; রাষ্ট্রের, নাগরিকের। নদী সুরক্ষার নিশ্চয়তা তখনই পাওয়া যাবে, যখন নাগরিকরা সচেতন হবে এবং সতর্ক থাকবে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিহির বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের ইতিহাসকে যেমন ভুলে যাওয়া উচিত নয়; তেমনি আমরা যে ভবিষ্যৎ নির্মাণ করব না, সেটাও ঠিক নয়। ১৯৯৭ সাল থেকে বুড়িগঙ্গা নদীকে রক্ষা করার জন্য আন্দোলন করছি, তখন একটা লোকও পাশে পাওয়া যেত না। মানুষ এখন সে অবস্থায় নেই। মানুষ এখন বুঝে নদীগুলোকে রক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে নগরের নদীগুলোকে রক্ষা করা জরুরি। কারণ যেসব নগরে নদী থাকে না, সেসব নগরকে পরিচ্ছন্ন বা পরিবেশসম্মত রাখা খুব কঠিন।’
হাওর অঞ্চলবাসী সংগঠনের পক্ষ থেকে জাকিয়া শিশির বলেন, ‘‘একটা প্রবাদ আছে– ‘বর্ষায় নাও শীতে পাও’। হাওর বাঁচাতে হলে আমাকে নদী বাঁচাতে হবে; নদী না বাঁচলে কিন্তু হাওর বাঁচবে না। আমি তিতাসপাড়ের মানুষ, সম্ভবত নদী নিয়ে একটাই গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস বাংলাদেশে আছে– ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, যেটি তিতাসপাড়ের লেখকই লিখেছেন। জীবন থেকে, নদী থেকে তুলে নিয়ে এ উপন্যাস লিখেছেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। আমরা নদীকে শাসন, দখল করতে করতে তার স্বাভাবিক চলার পথ বাধাগ্রস্ত করেছি। এর ফলে নদীগুলো আজ মরে যাচ্ছে। আমাদের নদীকে রাজনৈতিকভাবে রক্ষা করতে হবে।’’