হারানোর পথে ঢাকা শহরের প্রজাপতি

.
আশিকুর রহমান সমী/ দিপ্ত বিশ্বাস
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:০৫ | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ১৪:৩৩
বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে প্রাপ্ত প্রজাপতির সংখ্যা ১৮ হাজারেরও বেশি এবং ভারতীয় উপমহাদেশে এদের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৫০০। আইইউসিএন বাংলাদেশের ২০১৫ সালের বিশ্লেষিত তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রজাপতির সংখ্যা ৩০৫। আর ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অন্যতম খ্যাতিমান প্রাণিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেনের তথ্যমতে এই প্রজাতিগত সংখ্যাটি ৪২০-এর ওপর।
প্রকৃতিতে প্রজাপতির গুরুত্ব অপরিসীম। পরাগায়ন থেকে শুরু করে খাদ্যশৃঙ্খলে এদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কবিতা-সাহিত্য থেকে ইকো-ট্যুরিজম সবখানেই এদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। পরিবেশের বিভিন্ন নিয়ামক, যেমন– তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, মাটির গুণাগুণ, আলোক তীব্রতা, উদ্ভিদের উপস্থিতির সামান্যতম পরিবর্তনের ওপরও তারা সংবেদনশীল।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আজ বাড়ছে নগরায়ণ; যার ফলে পুরো পৃথিবীতে বনের সবুজ আর জীবন্ত নীল জলাশয় আজ কনক্রিটের আস্তরণে ঢেকে যাচ্ছে। এই নগরায়ণের দূষণ থেকে ঢাকা ব্যতিক্রম নয়। ১৭০০ সালের শুরুর দিকে ঢাকা ছিল বুড়িগঙ্গাকেন্দ্রিক। আজ সে ৩০৫ বর্গকিলোমিটারের এক নগরী। কালের স্রোতে সবুজ বনানীর ঢাকা আজ পৃথিবীর বসবাস অযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষে। বিলুপ্ত হয়েছে অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন এবং গুরুত্বপূর্ণ বন্যপ্রাণী। বড় প্রাণীদের হিসাব থাকলেও ছোট পতঙ্গের হিসাব আজ একেবারে উপেক্ষিত।
পৃথিবীতে প্রজাপতির সংখ্যা প্রতিনিয়তই কমে যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বনভূমি উজাড়, এদের পোষক উদ্ভিদের সংখ্যা কমে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে এদের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা শহরে এদের অবস্থা আরও শোচনীয়। বিশিষ্ট প্রজাপতিবিদ শাওন চৌধুরীর গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৪-২০১৬ এই তিন বছরে ঢাকা শহরের অবশিষ্ট সবুজে ঘেরা এলাকাগুলো (রমনা পার্ক, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ১৩৭ প্রজাতির প্রজাপতির আবাসস্থল ছিল, যা দেশের প্রাপ্ত মোট প্রজাপতির ৪৫ শতাংশ। আইইউসিএনের তালিকা অনুযায়ী, দেশে প্রাপ্ত মোট প্রজাপতির প্রজাতি সংখ্যা ৩০৫। এ ছাড়াও তাঁর গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, ঢাকা শহরে তখন অর্ধশতাধিক প্রজাপতি পাওয়া যেত, যা বাংলাদেশের বিশ্লেষিত তথ্যমতে হুমকির মুখে রয়েছে।
আমাদের সমসাময়িক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, প্রজাতিগত এ সংখ্যা এখন অর্ধেকেরও কম, ৭২-এ এসে দাঁড়িয়েছে এবং হুমকির মুখে থাকা প্রজাপতির সংখ্যা কমে গিয়ে ৩০-এর আশপাশে দাঁড়িয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম একটি প্রজাপতি পরিবারের নাম রিয়োডিনিডাই; যার সারাদেশে প্রাপ্ত তিনটি প্রজাতির মধ্যে দুটি পাওয়া যেত ঢাকায়। কিন্তু দুঃখজনক হলো– এর একটিও এখন আর পাওয়া যায় না ঢাকা শহরে। হুমকির মুখে থাকা কিছু প্রজাপতি হলো– প্লেইন পাফিন, মালায়ান, স্মল কিউপিড, ফ্যালকেট ওকব্লু, কমন হেজ ব্লু, ব্ল্যাক রাজা, নাইট, ড্যানএইড এগফ্লাই, ডাবল ব্যান্ডেড ক্রো, স্পটেড প্লামফ্লাই, ট্রি ফ্লিটার, রেড হেলেন, ক্রিমসন রোজ ও প্লামজুডি। এসব প্রজাপতি ৬-৭ বছর আগে ঢাকা শহরে পাওয়া গেলেও এখন আর এদের পাওয়া যায় না। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এদের সংখ্যা কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ প্রজাপতির দেশীয় পোষক উদ্ভিদের সংখ্যা কমে যাওয়া। বৃক্ষ নিধন, দেশীয় প্রজাপতির পোষক উদ্ভিদ সম্পর্কে ধারণা না থাকা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অত্যধিক জনসংখ্যার চাপ– এসব পোষক উদ্ভিদের সংখ্যা কমার অন্যতম কারণ। ফলে প্রজাপতি তার প্রজনন সুযোগ হারাচ্ছে। ঢাকা শহরে প্রাকৃতিক ঝোপঝাড় আজ একেবারে নেই। ময়লা বা আগাছা তকমা দিয়ে প্রাকৃতিক এই প্রতিবেশ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ফলে এই প্রতিবেশ ব্যবস্থায় টিকে থাকা প্রজাপতিরাও হারিয়ে যাচ্ছে।
শহরে কমছে সবুজ আচ্ছাদনের পরিমাণ। সিইজিআইএসের তথ্যমতে, সবুজ আচ্ছাদনের পরিমাণ ১১ শতাংশ হলেও প্রকৃতপক্ষে এখন দেশি বুনোলতা, গুল্ম, বৃক্ষে কতটুকু প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ সবুজ জায়গা টিকে আছে তা আজ আমাদের মনে এলেই শঙ্কা জাগায়। ঢাকার উদ্যানগুলো আজ বিদেশি গাছপালায় পূর্ণ শুধু সৌন্দর্যবর্ধনের নামে; যার ফলে দেশি গাছ ও প্রজাপতির সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে। শুধু প্রজাপতি নয়, এর প্রভাব পড়ছে পুরো ইকোসিস্টেমে। পরিবেশের ভারসাম্য ভয়াবহভাবে বিনষ্ট হবে এই ছোট প্রাণীদের অনুপস্থিতিতে।
সেই সঙ্গে অতিরিক্ত দূষণ, তাপমাত্রার পরিবর্তন, কলকারখানার বিস্তার, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে আজ প্রজাপতি হুমকির মুখে। কারণ একটি প্রজাপতি পরিবেশের বিভিন্ন নিয়ামকের ওপর সংবেদনশীল; যার ফলে কোনো একটির পরিবর্তন পরিবেশে প্রজাতির ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলে।
২০২১ সালে প্রকাশিত আমাদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রজাপতির প্রজাতির একটি বড় অংশ সংরক্ষিত বনের বাইরে বিলুপ্তির প্রহর গুনছে। তাই শহরে সবুজায়ন জরুরি। ছাদকৃষিতে শহরে প্রজাপতিবান্ধব গাছের কথা চিন্তা করা যেতে পারে। পাশাপাশি প্রতিটি বাড়ির বারান্দায় যদি এই গাছ শোভা পায়, তাহলে প্রজাপতি সংরক্ষণ আরও বেশি বেগবান হতে পারে।
প্রকৃতির অনন্য এক অংশ বিভিন্ন প্রজাতির প্রজাপতি, যারা শুধু তাদের রং বাহারি সৌন্দর্যে প্রকৃতিকে মোহনীয় করেনি, পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষা তথা মানবজাতি এবং পৃথিবীর কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তাদের হারিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য অশনিসংকেত।
আশিকুর রহমান সমী: বন্যপ্রাণী গবেষক
দিপ্ত বিশ্বাস: বন্যপ্রাণী বিষয়ে গবেষণারত শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়