ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

পাহাড়ি গ্রামের পথ ধরে…

পাহাড়ি গ্রামের পথ ধরে…

নেপালে হিমালয়ের কোল ঘেঁষে একটি গ্রাম

 ইকরামুল হাসান শাকিল

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫২ | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৪ | ১৪:৩৩

রাত সাড়ে ৩টার দিকে আমরা নেপালের এক ছোট্ট গ্রাম কাংরিতে পৌঁছালাম। এখানেই আমাদের বাসভ্রমণ শেষ। বাস থেকে নেমে আমাদের জিনিসপত্র বুঝে নিলাম। এই বাস আবার কাঠমান্ডুতে ফিরে যাবে। রাস্তার দুই পাশে মাত্র কয়েকটি বাড়ি। এখানে একটি ছোট রেস্তোরাঁ আছে। আমরা সেখানে বসে অপেক্ষা করছি। এখান থেকে পাহাড়ের দুর্গম পথে উঠে যেতে হবে ফোরহুইলার জিপে করে। জিপও চলে এসেছে আমাদের নেওয়ার জন্য। জিপে মালপত্র ওঠাতে কিছুটা সময় লাগছে। সেই সুযোগে চা খেতে খেতে মোবাইল ফোন চার্জ করে নিচ্ছি। এখানে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। তাপমাত্রা মাইনাসে না গেলেও কাছাকাছিই হবে।

দুই জিপে করে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম। এখান থেকে শুরু হলো এক ভয়ংকর জিপযাত্রা। পাহাড়ের গায়ে খাঁচ কাটা এবং এবড়োখেবড়ো আঁকাবাঁকা রাস্তা উঠে গেছে ওপরে। এখনও দিনের আলো ফোটেনি। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় অন্ধকার ভেদ করে হেলেদুলে এগিয়ে চলছি। কখন যে চোখে ঘুম চলে এসেছে বুঝতেই পারিনি। বড় একটা ঝাঁকুনিতে যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখি গাড়ি সোজা নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে। ভয়ে বুকটা ধুক্ ধুক্ করে উঠল। ভালো করে চোখ মেলে দেখি সরু রাস্তা দিয়ে নামছে। তাকিয়ে দেখি সবাই ঘুমিয়ে আছে। ৭টার দিকে আমরা একটা নদীর পাড়ে এসে থামলাম। দোকানে জিজ্ঞেস করে জানলাম, এই গ্রামের নাম তাকসারা।
গ্রামে ঢুকলাম। অনেক বড় গ্রাম।

এই গ্রামে প্রায় হাজারখানেক মানুষের বসবাস। বেশ বড় একটি খেলার মাঠ গ্রামের শুরুতেই। মাঠের পশ্চিম পাশে একটি স্থায়ী মঞ্চ করা আছে এবং পূর্ব পাশে গাঁও পালিকার কার্যালয়ের অফিস। গাঁও পালিকা হলো আমাদের দেশের ইউনিয়ন পরিষদের মতো। বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড নিয়ে একটি গাঁও পালিকা পরিচালিত হয়। পাহাড়ের ঢালে ছোট ছোট ঘরের ঘনবসতি। ঘরের চালা টালির মতো করে তক্তা বা পাথর দিয়ে করা। নতুন ঘরে টিনের ব্যবহারও চোখে পড়েছে। ঘরগুলো পাথর, কাঠ ও বাঁশের চাঁটাই দিয়ে বানানো। প্রতিটি বাড়িতে ঘরের বাইরে সুন্দর করে গম্বুজ আকৃতি করে ভুট্টা রাখা আছে। ভুট্টাকে নেপালিরা মকাই বলে। গ্রামের মাঝখান দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। ছোট শিশুরা রাস্তায় খেলা করছে। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাপাই কো নাম?’ [তোমার নাম কী?] বাচ্চাটি উত্তর দিল, ‘মেরো নাম সাকশি মাগার।’ [আমার নাম সাকশি মাগার] সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তাপাই কো ঘর?’ বললাম, ‘মেরো ঘর বাংলাদেশ, মেরো নাম শাকিল।’ এভাবেই ভাঙা ভাঙা দু’একটা কথা হলো। ভীষণ কৌতূহল নিয়ে দেখছে আমাদের। কী সুন্দর তাদের চোখের চাহনি!

রাস্তার দুই পাশ রাঙিয়ে বাতাসে দুল খাচ্ছে রঙিন বুনো কসমস ফুল। ফুলে ফুলে রঙিন প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। এত কসমস আমি আগে কখনও দেখিনি। মনে হচ্ছে ঘন কসমস বনের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। আমাদের ডান পাশে উঠে গেছে পাহাড়ের ঢাল। বাম পাশ নেমে গেছে গভীর খাদে একদম নদীতে। নদীর ওপারেই আবার উঠে গেছে আকাশছোঁয়া পাহাড়। পাহাড়ের ঢালে ছোট ছোট কৃষিজমি। এ জমিগুলোতেই চাষ হচ্ছে আলু, ভুট্টা, ধান। মাঝারি গড়নের দেহের একজন ভদ্রলোক কালো রঙের জ্যাকেট পরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন। আমাদের সবার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে পরিচিত হলেন। তাঁর নাম সুরবিন্দ্রা কুমার পুন মাগার। তিনি কান্তিপুর পত্রিকার সাংবাদিক। তাঁর বাড়ি এই মাইকোট গ্রামে। সুরবিন্দ্রা আমাদের নিজের গ্রাম ঘুরে দেখাতে নিয়ে গেলেন। প্রথমেই আমাদের নিয়ে এলেন এই গ্রামের ভেতরে একটি ছোট্ট পুরোনো ভাঙা বাড়িতে। এটা যে একটা রাজবাড়ি সেটা দেখে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে। সরু সিঁড়ি দিয়ে আমরা বাড়ির ছাদে উঠে এলাম। এখানে দাঁড়িয়ে পুরো গ্রাম দেখা যাচ্ছে। এমন কি চারপাশের বহুদূর পর্যন্ত পাহাড়ি এলাকা দেখা যাচ্ছে। কোট হলো রাজবাড়ি। এ অঞ্চলের রাজা এই গ্রামে বাস করতেন। তাই এর নাম মাইকোট। নেপালে এ রকম বেশ কয়েকটি কোট আছে। যেমন মাইকোট, নাগরকোট, সিমিকোট ইত্যাদি। সুরবিন্দ্রা তাঁর বাড়ি দেখিয়ে বলেন, ‘ওই যে নীল টিনের ঘর দেখা যাচ্ছে, ঠিক তার পাশে যে বাড়িটা দেখা যাচ্ছে যেখানে দুটো বাচ্চা খেলা করছে, সেটাই আমার বাড়ি। ওরা আমার বড় ভাইয়ের বাচ্চা। স্ত্রী আর এক সন্তানকে নিয়ে আমি কাঠমান্ডুতেই থাকি।’

গ্রামের ওপরে সাদা রঙের একটি চোরতেন দেখা যাচ্ছে। চোরতেনকে স্তুপাও বলা হয়। এটি বৌদ্ধদের একটি ধর্মীয় স্থাপনা। সেটি দেখিয়ে সুরবিন্দ্রা বললেন, ‘এটি আমাদের এ গ্রামের প্রধান চোরতেন। এখানে আমরা উপাসনা করি। চলো তোমাদের আমার বন্ধুর বাড়ি নিয়ে যাই। তাঁর বাড়িতে অনেক আপেল হয়। সেই আপেলগুলো বেশ মিষ্টি।’ বন্ধু বাড়িতে নেই। কাজে বেরিয়েছেন। বাড়িতে বন্ধুর স্ত্রী ও ছোট বোন জুন আর ১২ মাসের একটা বাচ্চা আছে। আমরা বাড়ির উঠানে যাওয়ার পরই তাঁর বন্ধুর স্ত্রী হাসি মুখে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। সুরবিন্দ্রা জুনকে আপেল পেড়ে দিতে বললেন। জুন একটি লম্বা লাঠি দিয়ে আপেল পাড়ার চেষ্টা করছেন। আমি আর বিপ্লব ভাই এগিয়ে এলাম। আপেল গাছটি বেশ বড়। গাছে আপেল তেমন নেই। জুন বললেন, এই গাছের আপেল বেশ মিষ্টি। অনেক আপেল ধরেছিল। সব শেষ হয়ে গেছে। আমি গাছে উঠে পড়লাম। গাছ থেকে আপেল পেড়ে খাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। গাছ থেকে আপেল ছিঁড়ে আমি নিচে ফেলছি আর বিপ্লব ভাই নিচ থেকে ধরছেন। প্রায় কেজি দুয়েক আপেল হবে। বড় বড় দেখে চারটা আপেল জুনকে দিয়ে মুহিত ভাই বললেন, ভালো করে ধুয়ে ছোট ছোট টুকরা করে নিয়ে আসেন। মুহিত ভাইয়ের কথা বুঝতে তাঁর বেগ পেতে হলো না।

জুন নার্সিংয়ের পঞ্চম সেমিস্টারের ছাত্রী। হোস্টেলে থাকে। ছুটিতে এসেছেন। বেশ হাসিখুশি ও মিশুক। তিনি আমাদের এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। জানান, তাঁর কলেজের বেশ কয়েকজন বাংলাদেশে নার্সিংয়ে পড়ছেন। স্যারদের মুখে শুনেছি। বাংলাদেশে নাকি নার্সিং পড়া ভালো। আমি তাঁকে বললাম, আপনিও পড়তে যেতেন আমাদের দেশে। তিনি মুচকি হেসে একটু আফসোসের সুরেই বললেন, ‘ওরে বাবা, বাংলাদেশে গিয়ে পড়ার টাকা কোথায় পাব? অনেক টাকা লাগে শুনেছি।’ তাঁর কথা শোনার পর আর কিছু বলতে পারলাম না।

বড় একটি কাঁসার প্লেটে আপেলগুলো কেটে এনেছেন। আপেল এত রসালো আর মিষ্টি হতে পারে! এ রকম আপেল আমি আগে কখনও খাইনি। মুহিত ভাই, বিপ্লব ভাই এবং সানভি ভাইও একই কথা বললেন। আপেল খেতে খেতে জুনের ভাবি আমাদের জন্য চা বানিয়ে আনলেন। চা খেতে খেতে মুহিত ভাই সুরবিন্দ্রাকে বললেন, এ আপেলগুলো একটা ব্যাগে দিতে বলেন। এ আপেল আর চায়ের দাম কত দেব? প্রথমে সুরবিন্দ্রা বললেন দাম দিতে হবে না। তবে মুহিত ভাই বললেন, কী যে বল, টাকা কেন দেব না? অনেক আপেল নিচ্ছি। এগুলোর দাম তো দিতেই হবে। সুরবিন্দ্রা জুনের ভাবিকে জিজ্ঞেস করলেন, কত টাকা দেবে? ভাবি সাফ জানিয়ে দিলেন, টাকা নেব কেন? তারা অতিথি, তাদের আপ্যায়ন করেছি টাকা নেওয়ার জন্য? আপনারা আমাদের বাড়িতে এসেছেন এতেই আমরা খুশি। এই দারুণ মানুষের আতিথেয়তা আমাদের মুগ্ধ করল। হিমালয়ের মানুষগুলোর সঙ্গে যতই মেশার সুযোগ পাচ্ছি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা বেড়েই চলেছে। তাদের মনও হিমালয়ের মতোই বিশাল।

আরও পড়ুন

×