এভারেস্ট রেকর্ড ও বিতর্ক

ফাইল ছবি
ইকরামুল হাসান শাকিল
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৫ | আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:২৮
একাত্তর বছর আগে ১৯৫৩ সালের ২৯ মে ঠিক বেলা ১১টা ৩০ মিনিটের সেই ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণে অজয় অক্ষয় পৃথিবীর সর্বোচ্চ উচ্চতার পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের (৮ হাজার ৮৪৮.৮৬ মিটার বা ২৯ হাজার ৩১.৭ ফুট) শিখরে পা রাখলেন এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগে। সব প্রতিবন্ধকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মানুষের জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে বীরের বেশে তারা নেমে এলেন এভারেস্ট আরোহণের বিস্ময়কর গল্প নিয়ে। শিখর আরোহণ করে নেমে আসার পর যে মানুষটির সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল তিনি ছিলেন এই ঐতিহাসিক অভিযানের আরেকজন সদস্য জর্জ লোয়ে।
জর্জ লোয়ে ছিলেন হিলারির ঘনিষ্ঠ বন্ধু। হিলারি ও তেনজিংয়ের জন্য গরম স্যুপ হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন জর্জ লোয়ে। বন্ধুকে দেখে হিলারি কাছে এসে বলেছিলেন, ‘Well, George, we knocked the bastard off.’ তাঁর এ কথাটি এখন ঐতিহাসিক অনুভূতি প্রকাশ হিসেবে অমর হয়ে আছে।
হিলারি ও তেনজিংয়ের এভারেস্ট আরোহণের ঠিক আগের বছর ১৯৫২ সালের শুরুতে এক সুইস অভিযাত্রী দল এভারেস্ট অভিযান করে। প্রচণ্ড খারাপ আবহাওয়ার কারণে তারা চূড়া থেকে মাত্র ৮০০ ফুট নিচ থেকে ফিরে এসেছিলেন। ১৯৫৩ সালে শুরু হলো ব্রিটিশ অভিযান। জন হান্টের নেতৃত্বে এ অভিযাত্রী দলের সদস্য হিসেবে ছিলেন টম বুর্দিল, চার্লস ইভান্স, আলফ্রেড গ্রেগরি, জর্জ লোয়ে, এডমন্ড হিলারিসহ আরও অনেক বিখ্যাত সব পর্বতারোহী। এ অভিযান ছিল সব দিক থেকেই ঐতিহাসিক। ২০ জন শেরপা, ৩৬২ জন কুলি, চার শতাধিক অভিযাত্রী এবং তাদের জন্য দশ হাজার পাউন্ড মালপত্র নিয়ে ছিল এ বৃহৎ অভিযান। ২৬ মে প্রথম শৃঙ্গজয়ের চেষ্টা করেন টম বুর্দিল ও চার্লস ইভান্স। কিন্তু ইভান্সের অক্সিজেন সিলিন্ডারে সমস্যা দেখা দিলে চূড়ার ৩০০ ফুট নিচ থেকে ফিরে আসেন। এরপর চূড়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ান হিলারি ও তেনজিং। তারাই ইতিহাস রচনা করে ফিরে আসেন।
এভারেস্টে প্রথম অভিযান হয় ১৯২১ সালে। তারপর ১৯২২ ও ১৯২৪ সালে আরও দুটি অভিযান হয়। এ তিনটি অভিযানেই অংশ নেন বিখ্যাত ব্রিটিশ পর্বতারোহী জর্জ ম্যালোরি। তিনি পৃথিবীর সব পর্বতারোহীর পথিকৃৎ ও অনুপ্রেরণাদানকারী। এভারেস্টে তাঁর তৃতীয় অভিযানের সময় ১৯২৪ সালের ৮ জুন দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে তাঁকে ও সঙ্গী অ্যান্ড্রু আরভিনকে শেষবারের মতো দেখা যায় শিখর থেকে ৮০০ ফুট নিচে। মাত্র ৩৮ বছর বয়সে এভারেস্টের চিরশ্রেষ্ঠ প্রতিদ্বন্দ্বী চিরতরে হারিয়ে যান সেই এভারেস্টেই।
এভারেস্ট জয়ের খবরে হিলারি ও তেনজিং হয়ে উঠলেন জাতীয় বীর। অভিযানের দলনেতা জন হান্ট ও হিলারিকে ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ ‘নাইটহুড’ উপাধিতে ভূষিত করলেন। তেনজিং নোরগে ব্রিটিশ উপনিবেশের নাগরিক না হওয়ার কারণে ‘নাইটহুড’ উপাধি পেলেন না। তবে বিদেশিদের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান ব্রিটিশ এম্পায়ার মেডেল বা জর্জ মেডেল লাভ করেন। এরপর শুরু হলো নতুন বিতর্ক– হিলারি না তেনজিং এভারেস্টে কে আগে আরোহণ করেছেন?
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে এডমন্ড হিলারি বলেন, ‘১৯৫৩ সালের ২৯ মে সকাল থেকেই, যখন তেনজিং ও আমি প্রথমবারের মতো পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ আরোহণ করতে সক্ষম হলাম, আমাকে এক মহান অভিযাত্রী হিসেবে বর্ণনা করা হতে থাকে। কিন্তু আমি আসলে স্রেফ এক পোড় খাওয়া কিউয়ি, যে জীবনের বহু প্রতিকূলতা উপভোগ করেছে মনেপ্রাণে।’ হিলারি নিজের আত্মজীবনী ‘হাই অ্যাডভেঞ্চারস’ এবং আরেকটি বই ‘ভিউ ফ্রম দ্য সামিট’-এ লিখেছেন, ‘আমরা একসঙ্গে শীর্ষে পৌঁছালাম।’
এ প্রশ্নের উত্তর যে শুধু হিলারিকেই দিতে হয়েছে তা কিন্তু নয়। এক হিলারির উত্তরে এ বিতর্কের অবসান ঘটল না। তেনজিংকেও এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে অসংখ্যবার। তেনজিং একটা সময় বিরক্ত হয়ে জবাব দেন, ‘যদি এভারেস্টে হিলারির এক কদম পেছনে থেকে দ্বিতীয় মানুষ হিসেবে আরোহণ কোনো লজ্জাজনক বিষয় হয়ে থাকে, তাহলে এ লজ্জা নিয়েই আমাকে বাকি জীবন অতিবাহিত করতে হবে।’ তিনি তাঁর আত্মজীবনী ‘ম্যান অব এভারেস্ট’ বইতেও এ বিষয়ে স্পষ্ট করেই বলেন, ‘‘হিলারিই প্রথম শিখর জয় করেছিলেন এবং সেই ৪০ ফুট উঁচু আপাত-অসম্ভব পাথুরে দেওয়ালটি, যার নামকরণ পরবর্তী সময়ে করা হয় ‘হিলারি স্টেপ’; তা অতিক্রমের উপায় হিলারিই খুঁজে বের করেছিলেন এবং আমি তাঁকে কেবল অনুসরণ করে শিখরে পৌঁছেছিলাম।’’
এভারেস্টের চূড়ায় হিলারির কোনো ছবি নেই। এ ছবি নিয়েও অনেক প্রশ্ন ওঠে। তার জবাবে তেনজিং বলেন, ‘আমি হিলারির ছবি তুলে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু অজ্ঞাত কোনো কারণে হিলারি নিষেধ করেন এবং বলেন, শিখরে কে আগে উঠেছে সেটি কাউকে না বলতে।’
হিলারি শুধু একজন এভারেস্টজয়ী পর্বতারোহীই ছিলেন না, এভারেস্টের মতোই বড় তাঁর মন। প্রচারবিমুখ মানুষ এ হিলারিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ‘থার্ড পোল’ বা ‘তিন মেরু’ অর্থাৎ পৃথিবীর তিন মেরু– উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু এবং এভারেস্ট জয় করেন। উত্তর মেরু জয়ের সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন চাঁদে পা দেওয়া প্রথম মানুষ নিল আর্মস্ট্রং।
এভারেস্ট অভিযানে বাংলাদেশের পর্বতারোহীরাও পিছিয়ে নেই। পর্বতারোহী এমএ মুহিত ২০১১ ও ২০১২ সালে এভারেস্ট আরোহণ করেন। দেশের প্রথম নারী হিসেবে ২০১২ সালে এভারেস্ট আরোহণ করেন নিশাত মজুমদার এবং দ্বিতীয় নারী হিসেবে একই বছর এভারেস্ট আরোহণ করেন ওয়াসফিয়া নাজরীন। ২০১৩ সালে পর্বতারোহী সজল খালেদ এভারেস্ট আরোহণ করে নেমে আসার পথে মৃত্যুবরণ করেন। এ বছর ২০২৪-এর ১৯ মে সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে ডা. বাবর আলী এভারেস্টের শিখরে আরোহণ করেন।
- বিষয় :
- এভারেস্ট জয়
- পর্বত
- বিতর্ক
- রেকর্ড