সোলানিন, দুর্ভিক্ষ: ইতিহাস ও বাস্তবতা

আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে দুর্ভিক্ষের প্রতিকৃতি
জায়েদ ফরিদ
প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৫ | ০০:৩৬ | আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২৫ | ১৪:২২
বাজার থেকে আলু কেনার সময় হালকা সবুজের আভা ছিল কিন্তু রোদ পড়ায় সেগুলো অধিকতর সবুজ হয়ে উঠেছে। দেখতে অদ্ভুত লাগলেও আদতে এই রং বহন করছে বিষাক্ততার ইঙ্গিত। সবুজ আলুর ভেতর থেকে স্মৃতিপটে ভেসে উঠল জ্বরাব্যাধি দুর্ভিক্ষের ইতিহাস– ডালনার আলুগুলো ফেলে দিতে হলো।
সবুজ আলু, জখমি আলু, ব্লাইট ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত অসুস্থ আলুতে সোলানিনের পরিমাণ মাত্রাহীনভাবে বেড়ে যায়; যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর ক্ষতিকর হতে পারে। এতে মাথাব্যথা, পেটব্যথা, বমি-ডায়রিয়া থেকে শুরু করে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম ড্যামেজ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। মানুষ দুঃখ-কষ্ট ভুলে যেতে চায়, কষ্টকর দিনের কথা মনে রাখতে চায় না; আমরাও ভুলে যাচ্ছি জগৎজোড়া দুর্ভিক্ষজনিত মৃত্যুর করুণ ইতিহাস। যুদ্ধ চলাকালে সাধারণ মানুষ ও সৈনিকদের খাদ্যের যে রেশন দেওয়া হয় তাতে কখনও কখনও পচা আলু থাকে, যা খাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না তাদের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে এমনটা ঘটেছিল জার্মান সৈনিকদের ভেতর। একযোগে ৫৬ জন সৈনিক হঠাৎ অসুস্থ হয়ে কেউ মারা যান। ১৯৫২ সালে যুদ্ধের সময় উত্তর কোরিয়ায় আলু খেয়ে মারা গেলেন ২২ জন। রোগাক্রান্ত আলু খেয়ে অসুস্থ হওয়ার এমনি অসংখ্য ঘটনা আমাদের অজ্ঞাত রয়ে গেছে। আলুর ব্লাইট রোগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারত-উপমহাদেশের এক বিপুল উৎসর্গের ইতিহাস– সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে নারীদের। আয়ারল্যান্ডে ১৮৪৫-৪৯ সাল পর্যন্ত কয়েক বছর লাগাতার প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ ছিল আলুর উৎপাদন ভয়ানকভাবে কমে যাওয়ার জন্য। এই মন্বন্তরে প্রায় ১০ লাখ লোক মারা গিয়েছিল আর ২০ লাখ লোক দেশান্তরী হয়েছিল।
রোগটি প্রাথমিকভাবে বিস্তার লাভ করেছিল মেক্সিকো অঞ্চলে। আমেরিকা থেকে রোগটি গিয়েছিল ইউরোপে। গোটা ইউরোপ, আমেরিকা ও বিশ্বের বহু দেশে এর বিস্তার দেখা গেলেও আয়ারল্যান্ডে ছিল সবচেয়ে বেশি। কারণ মাত্র একটিই আলুর জাত ‘আইরিশ লাম্পার’ উৎপাদিত হতো সেখানে। অন্যান্য দেশে বিভিন্ন জাত থাকায় যেসব জাত ব্লাইটের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ছিল; সেগুলো চাষ করা হয়েছে, ক্ষতিটা তেমন ভয়াবহ হতে পারেনি। ১৮৪৫ সালে আয়ারল্যান্ডে দুর্ভিক্ষ শুরু হলে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিল বিশ্বের অনেক দেশ। বাঙালি নারীরা খুলে দিয়েছিলেন তাদের হাতের বালা, গলার মালা। ভারত-বাংলাদেশে সবুজ আলু সম্পর্কে কিছু অজ্ঞতা থাকলেও ব্লাইট সম্পর্কে নেই। ব্লাইট রোগ দেখা যায় নাইটশেড পরিবারের উদ্ভিদগুলোয়– যেমন আলু, টমেটো, বেগুন ইত্যাদি। দুই ধরনের ব্লাইট রোগ–আর্লি ব্লাইট ও লেট ব্লাইটের মধ্যে লেট ব্লাইট বা নাবি ধসা রোগই আলুর জন্য সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ। এ রোগে প্রথমে আলু গাছের পাতার কিনারে সাদা-বাদামি দাগ দেখা দেয়; যা বিস্তৃত হতে হতে গাছ নষ্ট হয়। এরপর এই ছত্রাক মাটিতে প্রবেশ করে আলুও নষ্ট করে ফেলে। আলু চাষ শেষ হয়ে গেলেও এরা বেঁচে থাকে মাটিতে ও সংরক্ষিত আলুর ভেতরে।
লেট ব্লাইট রোগটি কমপক্ষে ১৫০ বছরের পুরোনো। এর চিকিৎসা করা হয় ৬৪ শতাংশ ম্যানকোজেব এবং ৮ শতাংশ মেটালেক্সিল মিশিয়ে। সুস্থ আলুগাছের পাতা-কাণ্ড-শিকড়ে প্রচুর সোলানিন থাকলেও আলুতে থাকে হালকা পরিমাণ; যা সহনীয় মাত্রার, মাত্রা বেড়ে গেলেই বিপদ। গাছ আত্মরক্ষার জন্য যে ‘সোলানিন টক্সিন’ তৈরি করছে তা ক্ষতিকর হয়ে পড়ছে মানুষের জন্য। অতএব কাটা আলু, সবুজ আলু, ব্লাইট ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত আলুকে কিছুতেই খাদ্যের উপযোগী বলে মেনে নেওয়া যায় না। একেবারে গার্ডেন-ফ্রেশ না হলে আলুর ছালে যতই ভিটামিন থাকুক, বর্তমান দিনকালে ছাল না খুলে আর আলু না কেটে কখনও তা খাদ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।