ঢাকা সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ

পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ

আব্দুল বায়েস

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০১৯ | ১৩:০৫

সম্ভবত অনেকের অজানা যে, প্রতি বছর একটা বিশেষ দিন দারিদ্র্য বিমোচনের প্রতিশ্রুতি ও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত একটা প্রতিপাদ্য নিয়ে হাজির হয়। আজ সেই দিন, ১৭ অক্টোবর; বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য 'দারিদ্র্য বিমোচনে শিশু, পরিবার ও সমাজের সঙ্গে একযোগে কাজ করি'। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) সর্বত্র সর্বপ্রকার দারিদ্র্য বিমোচনের তাগিদ দেয়। আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবসের একটা ছোট ইতিহাস না বললেই নয়। ১৯৪৮ সালে প্যারিসের যে স্থানে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছিল; ১৯৮৭ সালের ১৭ অক্টোবর একই জায়গায় লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটেছিল। সমাবেশের উদ্দেশ্য ছিল চরম দারিদ্র্য, সহিংসতা ও ক্ষুধার শিকার মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, এই প্রথমবারের মতো ওই সমাবেশ থেকে ঘোষণা আসে- দারিদ্র্য হচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘন। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ 'একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে দারিদ্র্য ও বৈষম্য বিমোচনে সকলে ঐক্যবদ্ধ হই'- এ স্লোগান নিয়ে সব সরকার ও বেসরকারি সংস্থাকে নিজ নিজ রাষ্ট্রের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানায়।

দুই
বাংলাদেশের গর্ব করার মতো যে ক'টা বিষয় আছে, তার মধ্যে আয়-দারিদ্র্য বিমোচন অন্যতম। এখনও সরকারি পরিকল্পনায় আয়-দারিদ্র্য হ্রাস প্রধান লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত। এক হিসাবে দেখা যায়, সার্বিক দারিদ্র্য প্রকোপ ২০১৫ সালের ২৫ শতাংশ থেকে বর্তমানে ২০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে। একই সময়ে চরম দারিদ্র্য কমে এসেছে ১৩ থেকে ৯ শতাংশে। সরকারের লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যের সম্পূূর্ণ অবসান ঘটানো এবং ২০৪১ সালের মধ্যে মাঝারি দারিদ্র্য ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। তবে এই কৃতিত্ব ও সরকারি অভিলাষ সত্ত্বেও স্বীকার করতে হয়- ক. এখনও এ দেশের দুই কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছে এবং খ. সময়ের বিবর্তনে দারিদ্র্য বিমোচনের হার কমে আসছে। অর্থাৎ যে গতিতে গত দশকে দারিদ্র্যের প্রকোপ কমেছে, ইদানীং সেই গতি কিছুটা শ্নথ হয়ে আসছে বলে প্রতীয়মান।


তিন
সন্দেহ নেই, দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের নেওয়া কর্মসূচি ব্যাপক অবদান রেখেছে। তার পাশাপাশি ক্ষুদ্রঋণ ও সম্পদ হস্তান্তরের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসে এনজিওগুলোর ভূমিকা খাটো করে দেখা উচিত নয়। জীবিকা অর্জনে বাজারমুখী নানাবিধ দক্ষতা প্রশিক্ষণ, আয়মূলক কর্মকাণ্ড সৃজন ও প্রসারে ক্ষুদ্রঋণসহ বিভিন্ন সহযোগিতার মাধ্যমে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো দারিদ্র্য নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে। তবে ক্ষুদ্রঋণ এবং জীবিকা উন্নয়নে মূলধারার কর্মকাণ্ড যে চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপকার করতে পারছে না, তা সংশ্নিষ্টদের বুঝতে খুব একটা দেরি হয়নি। বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে এই সমস্যা সমাধানে সম্ভবত প্রথম এগিয়ে এসেছিল ব্র্যাক। সংস্থাটি ২০০২ সালে আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচি শুরু করে। এ কর্মসূচির আওতায় জন্ম নেয় আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন মডেল। টেকসইভাবে চরম দারিদ্র্য বিমোচনে মডেলটি আজ পৃথিবীজুড়ে প্রশংসিত। এটি ৪০টিরও বেশি দেশে আজ বাস্তবায়িত হচ্ছে। মডেলটির আওতায় সম্পদ বিতরণ (অর্থাৎ এসব পরিবারের আগ্রহ ও সামর্থ্য এবং স্থানীয় অর্থনীতির সুযোগ-সুবিধার ওপর ভিত্তি করে গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, নৌকা ইত্যাদি সম্পদ দেওয়া হয়, যা দিয়ে তারা আয় করতে পারেন), সঞ্চয়ের অভ্যাস তৈরি, কারিগরি প্রশিক্ষণ ও হাতে-কলমে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নিবিড় তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে চরম দরিদ্র পরিবারগুলোকে ভঙ্গুর আর্থ-সামাজিক অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করা হয়। মডেলটির কাঠামো ও কার্যকারিতা প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ এসআর ওসমানীর কথা মনে করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, চরম দারিদ্র্যের উৎপত্তি শুধু সম্পদের স্বল্পতা নয়, বরং দরিদ্রের কাছে থাকা সম্পদ কাঠামো ও তাদের সামনে থাকা সুযোগ-কাঠামোর মধ্যকার অসামঞ্জস্য দারিদ্র্যের অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে। ব্র্যাকের অতিদরিদ্র কর্মসূচির মাধ্যমে গত দেড় যুগে দেশের ৪৭ জেলার ২০ লাখ খানার প্রায় ৮০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে এসেছে। কর্মসূচিটির মূল্যায়ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের ৯৫ শতাংশ কর্মসূচি শেষ হওয়ার চার বছর পরও ধারাবাহিকভাবে নিজেদের অবস্থার উন্নয়ন করে চলেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পৃথিবীর আটটি দেশে এই মডেলের কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণা করেছেন এবারের নোবেল বিজয়ী অভিজিৎ ব্যানার্জি এবং এস্তার ডুফলো। তারা দেখিয়েছেন যে, মডেলটি টেকসই দারিদ্র্য দূরীকরণে ভূমিকা রাখে।



চার
দারিদ্র্য ডিসকোর্সে শিশুর প্রসঙ্গ এযাবৎকাল আলাদা করে গুরুত্ব পায়নি। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ হচ্ছে ০-১০ বছর বয়সী শিশু। এদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ খর্বকায়, কম ওজনের ও অপুষ্টির শিকার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের পুষ্টি সংক্রান্ত উন্নতি লক্ষ্য করা গেলেও বিগত কয়েক বছর ধরে পরিস্থিতি অনেকটাই অপরিবর্তনীয়। শিশুদের মধ্যে মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট বা অনুপুষ্টি ঘাটতির হার প্রকট। বিশেষত ভিটামিন এ, আয়রন, আয়োডিন এবং জিংক-স্বল্পতা বেশি পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়।

অন্যদিকে, শিশুর মায়ের শরীরে পুষ্টিস্বল্পতা শিশুর পুষ্টিতে অবধারিত প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে মায়েদের পুষ্টিজনিত অবস্থা যে সন্তোষজনক নয়, তা বলাই বাহুল্য। পুষ্টির ঘাটতি যেমন দারিদ্র্যের কারণ, তেমনি এর পরিণতিও। পুষ্টির অভাবে শিশুর শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়ে ভবিষ্যৎ উৎপাদনশীলতায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। শরীরে শক্তির অভাবের দাম পরবর্তীকালে দিতে হয়। তবে দিতেই যে হয়, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

পাঁচ
যদি বলি, আমরা আয়-দারিদ্র্য পরিমাপে 'আসক্ত' হয়ে পড়েছি, তাহলে খুব একটা ভুল বলা হয় না। তা ছাড়া উপায়ও নেই। ধরে নেওয়া হয়, আয় কম থাকলে ভোগ কম হয়, যা প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে। এর ফলে মজুরি কম হয়। প্রকারান্তরে যা আয় নিচে নামিয়ে ভোগ কমায়। কিন্তু দেখা গেছে, অপুষ্টির ব্যাপারটা শুধু দরিদ্রের দণ্ড নয়, ধনীরও দণ্ড। প্রায়োগিক পর্যবেক্ষণ বলছে, পুরো পৃথিবীতে ধনী-গরিব পরিবার নির্বিশেষে অপুষ্টির অনুপ্রবেশ ঘটছে। পার্থক্য এটুকুই যে, প্রয়োজনের তুলনায় কেউ কম খেয়ে আর কেউ বেশি খেয়ে অপুষ্টির শিকার হয়। সুতরাং আয় বৃদ্ধি পেলেই পুষ্টি তথা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে, এমন কথা হলফ করে কেউ বলতে পারে না। আয় বৃদ্ধি পুষ্টি বৃদ্ধির জন্য দরকারি শর্ত- যথেষ্ট শর্ত নয়। আর তাই বোধহয় আয় দিয়ে দারিদ্র্য পরিমাপের চিন্তা আপাতত বাদ দিয়ে পুষ্টিকে প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে; যেখানে আয় ছাড়াও পুষ্টির নিয়ামক হচ্ছে সচেতনতা, খাদ্যগুণ, খাদ্যপণ্যের দাম, লভ্যতা ইত্যাদি। তাহলে পুষ্টি-দারিদ্র্যের ব্যাখ্যা এ রকম দাঁড়ায় :কম পুষ্টি মানে উৎপাদনশীলতা কম, যা মজুরি হ্রাসের মাধ্যমে আয় নিম্নমুখী রেখে দারিদ্র্য উস্কে দেয়। বাংলাদেশে যে হারে মাথাপিছু আয় বাড়ছে, ঠিক সেই হারে পুষ্টি গ্রহণ বাড়ছে বলে মনে হয় না।


ছয়
দারিদ্র্য বিমোচন শুধু দয়াদাক্ষিণ্য দিয়ে হয় না। হয় না শুধু সরকার কিংবা এনজিওর মাধ্যমে। পুরো প্রক্রিয়ায় সমাজ ও পরিবারের ব্যাপক ভূমিকা বিবেচ্য বিষয় হওয়ার দাবি রাখে। এদের সম্পৃক্ততায় সৃষ্টি হয় 'সামাজিক পুঁজি', যা দারিদ্র্য নিরসনে ভৌত কিংবা আর্থিক পুঁজির চেয়ে কম শক্তিশালী নয়। সরকার যদি দারিদ্র্য বিমোচন নাটকের নায়ক হয়, তা হলে এনজিও, সমাজ ও পরিবার সহনায়কের ভূমিকায় থাকছে। কম বা বেশি, সবার গুরুত্ব উপলব্ধি করা জরুরি; সবাইকে একযোগে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হতে হবে।

সাত
তারাপদ রায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতার একটি 'দারিদ্র্যরেখা'। কবিতার শেষ পঙ্‌ক্তিগুলো এ রকম : 'কিন্তু,/ ক্রমশ,/ আমার ক্ষুধার অন্ন এখন আরো কমে গেছে,/ আমার লজ্জা নিবারণের কাপড় আরো ছিঁড়ে গেছে,/ আমার মাথার উপর আচ্ছাদন আরো সরে গেছে।/ কিন্তু ধন্যবাদ,/ হে প্রগাঢ় হিতৈষী, আপনাকে ধন্যবাদ।' আশা করা যায়, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় একজন দরিদ্র, মাঝারি কিংবা চরম, আর ওই কথা বলবেন না। সময়ের বিবর্তনে দেশটিতে শুধু আয়-দারিদ্র্য হ্রাস পায়নি; আয়বহির্ভূত আর্থ-সামাজিক নির্দেশকগুলোর ক্ষেত্রেও উন্নতি হচ্ছে। তবে আত্মতুষ্টির অবকাশ একেবারেই নেই। দারিদ্র্যকে অতীতের বিষয়ে পরিণত করতে এখনও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।
 
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক উপাচার্য
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়



আরও পড়ুন

×