ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসন খাতেই অগ্রগতি

মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসন খাতেই অগ্রগতি

হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ

প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০১৯ | ১৩:২১

বাংলাদেশে জিডিপি গ্রোথ রেট এখন ৮ শতাংশের ওপরে (সরকারি হিসাবমতে)। রফতানি আয়ের ৮১ শতাংশই আসে গার্মেন্টস থেকে এবং আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারও অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি। বর্তমান আর্থিক ব্যবস্থাপনায় এ দেশেও ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির তালিকাতেও ১ নম্বরে বাংলাদেশ। ব্যাংকের টাকা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে বিদেশে। সবচেয়ে বেশি আয়-বৈষম্যের দেশের তালিকাতেও বাংলাদেশের অবস্থান ওপরের দিকে। তাই প্রশ্ন জাগে, আমরা কি এই ডাচ্‌ ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে গেছি? কেননা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নও নির্দিষ্ট একটি সেক্টর অর্থাৎ আরএমজি খাতকে নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে। বাংলাদেশের এই খাতে মজুরি অত্যন্ত নিম্নতর হওয়ায় চীনকেও এখন আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে কষ্ট হচ্ছে।

যে কারণে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে অর্ডার আসছে। এভাবে আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের আয় বাড়তে থাকবে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আমাদের এই রফতানি আয়ের সেক্টরের ভবিষ্যৎ কি সুরক্ষিত? কেননা এই সেক্টরটা বেদুইনদের মতো একদেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়ায় এবং এর বেঁচে থাকা নির্ভর করে দুটি বিষয়ের ওপর- লো মার্কিং কস্ট ও লো শিপমেন্ট কস্ট। ইতিমধ্যে চীন আফ্রিকার সমুদ্র-তীরবর্তী অঞ্চল সমৃদ্ধ দেশগুলোর অবকাঠামো, যেমন- বড় বড় ব্রিজ, পাওয়ার পল্গ্যান্ট, সমুদ্রবন্দর, রাস্তাঘাট উন্নয়নের জন্য এ বছর ৫০ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। চীনের ইচ্ছা আফ্রিকার সমুদ্রবন্দর ও সস্তা শ্রম নিয়ে ক্রমান্বয়ে সেখানে গড়ে তুলবে ব্যাপক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ও বস্ত্রশিল্প। চীন মনে করছে, আফ্রিকা থেকে আমেরিকা ও ইউরোপ কাছাকাছি হওয়ায় শিপিং কস্ট কমে যাবে। ফলে ওখানকার বায়াররা বাংলাদেশ থেকে রেডিমেট পোশাক আমদানি না করে আফ্রিকা থেকে আমদানি করবে। ফলে বাংলাদেশের এই রফতানি খাতটি একেবারেই ভেঙে পড়তে পারে। তাহলে এ ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা কী? আমরা জানি, ভিয়েতনাম ইতিমধ্যে হেভি ইন্ডাস্ট্রিতে কনভার্ট হয়ে গেছে। ইন্ডিয়া তথ্যপ্রযুক্তিতে খুবই স্ট্রং জায়গায় চলে গেছে। ওরা ব্যাকআপ তৈরি করেছে। তাই আমাদেরও বিকল্প আয়ের সংস্থান করতে হবে।

এই প্রেক্ষাপটে আমাদের এখন একটি মাত্র খাত তথা আরএমজি খাতের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে অন্যান্য রফতানি আয়ের খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশেষ করে অভিবাসী খাতকে সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যেখানে তৈরি পোশাক খাত থেকে ৩৪.১৩ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে, সেখানে একই অর্থবছরে অভিবাসন খাত থেকে আয় হয়েছে ১৬.৪২ বিলিয়ন ডলার। জিডিপিতে বর্তমানে পোশাক খাতের অবদান বেশি হলেও ফরেন রেমিট্যান্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো। আরএমজি খাত থেকে ৩৪.১৩ বিলিয়ন ডলার আয় হলেও ১০-১২ বিলিয়ন ডলার চলে যায় এ খাতের জন্য ব্যবহূত কাঁচামাল আমদানিতে। তারপরও এ খাতে সরকারি প্রণোদনা দেওয়া হয় হাজার কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৮২৫ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান, শিল্প জোন তৈরি করা, গ্যাস-বিদ্যুৎ সুবিধা প্রদান, করপোরেট কর ও রফতানি শুল্ক্ক কমানো, অবকাঠামোগত সুবিধা প্রদানসহ আরও অনেক প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সুবিধা সরকার থেকে এই সেক্টর পেয়ে থাকে। পাশাপাশি তুলনামূলক বিচারে বাংলাদেশ অভিবাসী খাত এমন একটি খাত, যা বিনা বিনিয়োগে এবং ব্যক্তির নিজস্ব প্রচেষ্টায় উঠে দাঁড়িয়েছে। এ খাতে সরকারের বিনিয়োগ অতি সামান্য হলেও এ খাতের অর্জিত অর্থ টেকসই উন্নয়নে সরাসরি অবদান রাখছে। গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। অন্যদিকে আরএমজি খাতের আয় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রভাব রাখলেও টেকসই উন্নয়নে এর ভূমিকা কতটুকু, তা বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। কেননা শ্রমিক অসন্তোষ, বৈষম্যমূলক মজুরি, নিম্নমানের কাজের পরিবেশ, মানসম্মত অবকাঠামোর অভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি এই আরএমজি খাত। আবার এখানে ঋণখেলাপির সংখ্যা বৃদ্ধি ও বিদেশের বাজার হাতছাড়া হওয়ার চ্যালেঞ্জও রয়েছে। তাই দেশের টেকসই উন্নয়নে এর অবদান ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে।



অন্যদিকে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের এক কোটি ২৫ লাখ মানুষ বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত আছে। আবার প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৫-৬ লাখ লোক বিদেশে গেলেও মাত্র এক-তৃতীয়াংশ প্রশিক্ষিত। বাকিরা আধা দক্ষ ও অদক্ষ হিসেবে বিদেশে যায়। বিশেষ করে জনশক্তি প্রেরণ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত উদ্যোক্তাদের নিজস্ব উদ্যোগে সৃষ্ট কিছু কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ও সরকারের টিটিসি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যতটা সম্ভব দক্ষ কর্মীরা বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। অভিবাসন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউই দক্ষ কর্মী গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা, ট্রেনিং সেন্টার স্থাপনের জন্য বিশেষ অঞ্চল বা জমি বরাদ্দ, ব্যাংক ঋণ সুবিধা ইত্যাদি কোনো ধরনের সরকারি-বেসরকারি সুবিধা পায় না। অভিবাসন খাতটি একটি সম্ভাবনাময় খাত হওয়া সত্ত্বেও এ খাতের প্রতি সরকারের নজর বা পৃষ্ঠপোষকতা তেমন নেই, যা আছে আরএমজি খাতে। অথচ এ খাতটিতে সরকারের সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা যদি আরএমজি খাতের মতো হতো, তাহলে এ খাতটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে আরএমজি খাতকে ছাড়িয়ে যেত। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি মনমোহন প্রকাশ যথার্থই বলেছেন, রফতানি বহুমুখীকরণ কিংবা বিদেশে দক্ষ জনশক্তি প্রেরণ করতে না পারলে অর্থনীতির উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। তাই কোনোভাবেই রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে ভেনিজুয়েলার মতো নির্দিষ্ট একটা সেক্টরকে কেন্দ্র করে আমরা এগোতে চাই না। রফতানির বিকল্প খাতগুলোতেও ব্যাপকভাবে সচল করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রণোদনা বৃদ্ধি করা আশু প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে জনশক্তি রফতানি খাত আমাদের বিকল্প আয়ের একটা বিশাল উৎস হতে পারে। এ খাতটিকে যদি সমৃদ্ধ করা যায় অর্থাৎ দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে বিদেশে প্রেরণ করা যায়, তাহলে এ খাত থেকে আমাদের বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ ফরেন রেমিট্যান্স আয় বেড়ে যাবে। কেননা বিদেশে আমাদের জনশক্তির বিপুল চাহিদা রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, দক্ষ জনশক্তি এক বিশাল জনসম্পদ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের এক জরিপ অনুযায়ী- বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া কর্মীদের ৬২ শতাংশ অদক্ষ, ৩৬ শতাংশ আধাদক্ষ এবং ২ শতাংশ মাত্র দক্ষ। যে কারণে এসব অভিবাসন কর্মীর মজুরিও কম। তাই এই জনগণকে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করতে হলে অবশ্যম্ভাবী আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সব ধরনের টেকনিক্যাল বা কারিগরি, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল ও নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে ডাক্তার, নার্স ও বিভিন্ন কারিগরি জ্ঞানসমৃদ্ধ দক্ষ জনশক্তির বিপুল চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আমরা ওই দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানি করতে পারছি না। আবার কোনোভাবে প্রেরণ করা গেলেও ওই দেশে গিয়ে তাদের একই বিষয় বা কাজের ওপর এক অথবা দুই বছর উন্নত ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণ নিতে হয়।

মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশটি জনসংখ্যার তুলনায় আয়তনে খুবই ছোট। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ এখানে ভারী শিল্পের বিকাশ না ঘটায় জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশকে কোনো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে বিশ্বের অনেক দেশ আছে, যাদের ভূমি, অবকাঠামোগত সুবিধাসহ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত জনশক্তির অভাব রয়েছে। সে ক্ষেত্রে দক্ষ অভিবাসন খাতই পারে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে একমাত্র অবদান রাখতে। তাছাড়া সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যে নতুন এক কোটি ৮৭ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়েছে, সেখানে জনশক্তি খাতের কথা অগ্রগণ্য হিসেবে বিবেচিত হলেও প্রত্যেকটি বাজেটে এর প্রতিফলন দেখা যায় না। বাজেটে কার্যত এ খাতের উন্নয়নে তেমন বরাদ্দ থাকে না, কোনো প্রকার প্রণোদনা বা ইনসেনটিভও আমরা দেখতে পাই না। অথচ এ খাতটি আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি এবং বলা যায়, অর্থনীতির বুনিয়াদ রচনা করেছে। এ খাত থেকে প্রতিবছর অতি সহজে যে পরিমাণ ফরেন রেমিট্যান্স আসে, তা আর কোনো খাত থেকে আসে না। তাই এ খাতের সঙ্গে যারা জড়িত, বিশেষ করে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে প্রাপ্য মর্যাদা, সুযোগ-সুবিধা, আর্থিক প্রণোদনা ইত্যাদি সহযোগিতা যদি সরকার থেকে দেওয়া হতো, তাহলে এই খাতটি বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভবনাকে অধিকতর সমৃদ্ধির জায়গায় নিয়ে যেতে পারত বলে আমরা বিশ্বাস করি।

তবে আমরা আশাহত হতে চাই না। জনশক্তি কর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক সেলিম রেজা এখন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। আমরা জানি, তিনি একজন অত্যন্ত দক্ষ-যোগ্য-ধীশক্তিসম্পন্ন মানুষ। ইতিপূর্বে তিনি জনশক্তি প্রেরণ খাতকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহির জায়গায় আনার প্রচেষ্টা গ্রহণসহ নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতকল্পে অনেক অবদান রেখেছেন। অভিবাসন ব্যবস্থাপনার ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। একই সঙ্গে দীর্ঘ ছয়বার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত সজ্জন, প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক ইমরান আহমেদ প্রথমবারের মতো এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে ইতিমধ্যেই মন্ত্রণালয়ের কাজে স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা আনয়নের নিরলস প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছেন। ভবিষ্যতে মন্ত্রী ও সচিবের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে দক্ষ জনসম্পদ তৈরি ও নিরাপদ অভিবাসন প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত হবে। এমনকি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফরেন রেমিট্যান্স আয়ের ক্ষেত্রে জনশক্তি রফতানি খাতকে এক নম্বর খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নেবেন বলে আমরা আশাবাদী হতে চাই। তাদের হাত ধরেই রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের মতো অভিবাসী খাতটিও এখন থেকে সরকারের সুযোগ-সুবিধা, আর্থিক প্রণোদনাসহ সম্মান-মর্যাদা ও গুরুত্ব নিশ্চিত হবে বলেও বিশ্বাস করতে চাই। আর এভাবেই কেবল অভিবাসী খাতটিই বিকল্প কর্মসংস্থানের উৎস হিসেবে শিল্পের মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং দারিদ্র্য বিমোচনসহ দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য কমিয়ে আনতে সক্ষম হবে। ফলে সমৃদ্ধ হবে সামগ্রিক অর্থনীতি ও বাংলাদেশের জনপদ।

চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি এবং শ্রম অভিবাসন বিশ্নেষক



আরও পড়ুন

×