ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে অভিভাবকের অংশগ্রহণ

প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে অভিভাবকের অংশগ্রহণ

প্রতীকী ছবি

শাহাদাত হুসেইন

প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৪ | ২৩:৫৩

শতভাগ শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়নে এখন আমাদের মোটা দাগে দুটি জায়গায় কাজ করতে হবে। এক. প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করা; দুই. প্রাথমিক স্তরে মানসম্মত শিক্ষা প্রদান। এই বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সমাজের একাধিক প্রতিষ্ঠান ও অংশীজনের সর্বাত্মক ও সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সরকারের পাশাপাশি আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রথমত, আমরা যখন মানসম্মত শিক্ষা এবং প্রাথমিক স্তরে শতভাগ ভর্তির কথা বলি, তখন শিক্ষকদের পাশাপাশি অভিভাবকদের ভূমিকাকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। অভিভাবকরা শিশুদের সর্বপ্রথম শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক। শিশুরা বাড়িতে তাদের মা-বাবার কাছ থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে প্রথম পাঠ গ্রহণ করে। বর্তমান সমাজে মা-বাবার এই ভূমিকা কমেনি, বরং বেড়েছে। 

এ কারণেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিখন প্রক্রিয়ায় অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সময়ের চাহিদা পূরণে মা-বাবার সম্পৃক্ততা আরও বেশি জোরদার করার কোনো বিকল্প নেই। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুদের শেখার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করার অনেক সুবিধা আছে। যেমন শেখার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি, শিশুদের অধিক কৃতিত্ব অর্জন, উন্নত ফল ও সামাজিক বন্ধন বৃদ্ধি কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক, যা শিক্ষার মানোন্নয়নে শক্তিশালী অবদান রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডাল্ট কন্টিনিউয়িং এডুকেশনের গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অর্জন ১৫ শতাংশ ত্বরান্বিত করা যেতে পারে এবং একটি শিশুর পড়ার বয়স ছয় মাস পর্যন্ত এগিয়ে নিতে পারে।

সহজভাবে বলতে গেলে, অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা মানে সন্তানদের শিখন ও শেখার প্রক্রিয়ায় মা-বাবা বা অভিভাবকদের অংশগ্রহণকে বোঝায়। প্রথাগতভাবে বাংলাদেশের অভিভাবকরা সাধারণত তাদের সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যান এবং ক্লাস শেষে বাসায় নিয়ে আসেন। এ ক্ষেত্রে স্কুলে ব্যয়িত সময়কালে শিশুদের শিক্ষা এবং এর গুণমান বৃদ্ধিতে মা-বাবার একটি বিশাল ভূমিকা পালন করার সম্ভাবনা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মা-বাবা নিয়মিত ক্লাসে তাদের সন্তানদের অগ্রগতি এবং শিখন ফল সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে পারেন। মা-বাবার উচিত তাদের সন্তান সম্পর্কে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলা এবং তারা কীভাবে বাড়িতে সহায়তা করতে পারেন, তা শেখা। সন্তানদের হোমওয়ার্ক, পরীক্ষার ফল, স্কোরশিট এবং স্কুলে করা সামগ্রিক মূল্যায়ন যাচাই করে তাদের সন্তানদের কর্মক্ষমতা সম্পর্কে একটি দরকারি অন্তর্দৃষ্টি ও উপকারী জ্ঞান অর্জন করতে পারেন, যা সন্তানদের শিক্ষাক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। যদি তাদের সন্তানের ফল আশানুরূপ না হয়, তবে অভিভাবকদের উচিত শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলা। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক ও বিদ্যালয়ের উচিত অভিভাবকদের অংশগ্রহণকে উষ্ণভাবে স্বাগত জানানো, মতামত ও মূল্যবান পরামর্শকে সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ এবং শিক্ষাদান পদ্ধতিতে তার প্রতিফলন ঘটানো।
অমর্ত্য সেন তাঁর ‘শিশুশিক্ষার ভূমিকা’ বইয়ে বেশ জোর দিয়ে বলেছেন, কার্যকরী শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এবং সার্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। 

স্কুলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে অভিভাবকরা ভূমিকা রাখতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ মা-বাবা স্কুলশিক্ষকদের সন্তানের পছন্দ-অপছন্দ, দুর্বলতা, শক্তি এবং অন্যান্য বিষয়ে অবহিত করবেন। একইভাবে স্কুলও শিশুদের বিকাশ ও অগ্রগতি সম্পর্কে অভিভাবকদের অবহিত করবে। একবার অভিভাবকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রতিষ্ঠিত হলে তারা পরিকল্পনা, তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শিশুদের শিখন প্রক্রিয়ায় গঠনমূলক অবদান রাখতে পারবেন। শিক্ষকদের উচিত অভিভাবকদের মতামত শোনা এবং তা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা। এই অভিভাবক-শিক্ষকের সম্পর্ক অবশ্যই একটি সাধারণ লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হবে। আর তা হলো শিশুদের একাডেমিক অগ্রগতি। এ লক্ষ্য তখনই অর্জিত হবে যখন অভিভাবক-শিক্ষকের সম্পর্ক একটি সহযোগিতামূলক ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠিত হবে। 
প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা এবং অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে একটি বিষয় পরিষ্কার– প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি, নাগরিক সমাজ, মা-বাবা-সন্তানসহ অভিভাবক সমাবেশ শিশুদের শিক্ষার মানোন্নয়নে একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। এ রকম সমাবেশে খোলামেলা সংলাপের মাধ্যমে অভিভাবকরা শিক্ষকদের সঙ্গে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে বিভিন্ন অংশীজনের কাছ থেকে কার্যকরী মতামত ও পরামর্শ পাওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া এ ধরনের খোলামেলা সংলাপ অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে বিশ্বাস বাড়িয়ে তুলবে, যা শিশুদের শেখার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

শতভাগ প্রাথমিকে ভর্তি ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করাই আমাদের শিক্ষানীতির কেন্দ্রবিন্দু। সরকারের এই নীতি ও রূপকল্প আলোর মুখ দেখবে যদি সময়োপযোগী প্রাথমিক শিক্ষা কার্যকারিতার সঙ্গে প্রদান করা যায়। কাজটি বাস্তবায়নে অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে সহযোগিতা এবং সমন্বয় প্রয়োজন। এ দুই অংশীজন যদি হাতে হাত রেখে তাদের দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে আমরা উজ্জ্বল ও উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারি।

শাহাদাত হুসেইন: উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কালিহাতী, টাঙ্গাইল

আরও পড়ুন

×