জনস্বাস্থ্য
স্মার্ট তামাক কর মডেল যে কারণে জরুরি

শাফিউন নাহিন শিমুল
শাফিউন নাহিন শিমুল
প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৪ | ২৩:৪২ | আপডেট: ৩০ জুন ২০২৪ | ২৩:৪৩
চলতি অর্থবছরের বাজেটে কর ব্যবস্থায় তেমন কোনো কার্যকর ও জনকল্যাণমুখী কর প্রস্তাব দেখা যায়নি। উল্টো বিয়েশাদি ও সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করার শর্ত হিসেবে ট্যাক্স-রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক, অপ্রদর্শিত আয় বৈধ আয়ের চেয়ে কম কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ থাকা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার ঘোষণা ব্যবসায়ী সমাজকেও বিচলিত করার কথা। যা হোক, আলোচ্য নিবন্ধ তামাকের ওপর কর বিষয়ে।
উন্নত কর কাঠামোর জন্য তথ্যবহুল ও স্মার্ট মডেলিংভিত্তিক কর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। তামাকে তা কার্যকর হলে সরকার আরও বেশি রাজস্ব আহরণ করতে পারবে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বরাবরের মতোই চার স্তর (নিম্ন, মধ্য, উচ্চ, প্রিমিয়াম) ঠিক রেখে সিগারেট প্যাকেটের দাম (১০টি) বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে যথাক্রমে ৫ টাকা, ৩ টাকা, ৭ টাকা ও ১০ টাকা। টাকার অঙ্কে দেখলে মনে হতে পারে, বৃদ্ধির হার সঠিক। কিন্তু গত বছরে প্রায় ১০ শতাংশের মতো মূল্যস্ফীতি হয়েছে। সে তুলনায় নিম্নস্তরের সিগারেটে দাম মাত্র ১ টাকা বেড়েছে, শলাকা হিসাব করলে মাত্র ১০ পয়সা। এটা কেবল অপর্যাপ্তই নয়, হাস্যকরও বটে। কিন্তু এটা যদি যৌক্তিক পর্যায়ে বাড়ানো যেত, তাহলে সরকারের রাজস্ব, জনস্বাস্থ্য উভয়েরই কল্যাণ হতো।
তামাক তথা সিগারেটের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে কীভাবে নির্ধারণ করা যায়, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সাধারণত এনবিআর বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে, যার মধ্যে সিগারেট কোম্পানিও আছে। এভাবে মূল্য ও কর নির্ধারণ বিজ্ঞানসম্মত নয়। কোম্পানিগুলো নিশ্চয় চাইবে না, সিগারেটের ব্যবহার কমে যাক। তা চাওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণও নেই। অন্যদিকে সরকার যেহেতু এ খাত থেকে বিশাল রাজস্ব পায়, তাই কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতেও চায় না। উপরন্তু সর্ববৃহৎ তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার থাকায় এবং সরকারের আমলা ওইসব কোম্পানিতে নিয়োগ পাওয়ায় এনবিআর দাম বৃদ্ধি না করতে অনেক চাপেও থাকে। কিন্তু এই দাম নির্ধারণ তথ্যভিত্তিক ও মডেলিং বেজড হলে তা সরকার ও জনস্বাস্থ্য উভয়ের জন্যই ভালো ফল আনতে পারত।
অনেক দেশের এমন মডেলিং ফ্রেমওয়ার্ক থাকে না। তামাক কর নিয়ে বিশ্ববরেণ্য গবেষকরা বাংলাদেশের উপযোগী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক মডেল তৈরি করেছেন, যা জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘টোবাকোনমিক্স’ থেকে প্রকাশিত। সেখানে বাংলাদেশের বর্তমান কর ব্যবস্থা, চাহিদার ধরন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি ও আনুষঙ্গিক বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া যেসব তথ্য এই মডেলিং-এর জন্য ব্যবহার করা হয় তার সবই আবার বাংলাদেশের ডেটা দিয়েই বের করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ চাহিদার বিষয়গুলো বাংলাদেশের মানুষের ওপর কয়েক বছর ধরে চলা জরিপের ফল থেকে প্রাপ্ত, যা বিশ্ববিখ্যাত ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল প্রকাশনার ‘টোবাকো কন্ট্রোল’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা থেকে নেওয়া। মোদ্দাকথা, এ মডেল বাংলাদেশের জন্যই তৈরি এবং বাংলাদেশের তথ্য দিয়েই মডেলিং করা।
এই মডেলিং অনুযায়ী সরকার নিম্ন, মধ্য, উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরে ১০টি শলাকার সিগারেটের দাম যথাক্রমে ৬০, ৮০, ১৩০ ও ১৭০ করা উচিত। চাহিদা, জোগান, এ দেশের ধূমপায়ীদের ব্যবহারের ধরন, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। মডেলিং থেকে কীভাবে সিগারেটের দাম নির্ধারণ করলে তামাক ব্যবহার কমানো এবং রাজস্ব আয় বাড়ানো যায় তা বের করাই ছিল লক্ষ্য। এই রকম মডেলিং বেজড তামাক কর নির্ধারণ করে গাম্বিয়া ও পাকিস্তান বেশ সুফল পেয়েছে। এই মডেলিং বেজড তামাক, মূলত সিগারেটে কর ধার্য করলে বর্তমান বাজেটের তুলনায় সরকারের রাজস্ব ও জনস্বাস্থ্যে কতটা প্রভাব পড়বে তার একটি পর্যালোচনা করা যাক।
রাজস্ব বৃদ্ধি
সরকারি বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী তামাক কর নির্ধারণ করলে বছর শেষে প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হতে পারে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১২ শতাংশ বেশি। তবে মডেলিং বেজড তামাক কর নির্ধারণ করলে এ খাত থেকে সরকার প্রায় ৪৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতে পারবে, যা চলতি বছরের প্রাক্কলিত আয় থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি। আর টাকায় হিসাব করলে বর্তমান অর্থবছর থেকে এই বৃদ্ধি ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মানে, সরকার যদি এ প্রস্তাব গ্রহণ না করে তবে প্রস্তাবিত বাজেটে অতিরিক্ত ৬০০০ কোটি টাকার বেশি হারাবে। এই অতিরিক্ত অর্থ অন্যান্য বিতর্কিত কর থেকে আয় যেমন সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য আয়কর জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা এবং ১৫ শতাংশ কর দিয়েই অবৈধ আয় বৈধ করার ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পারে। তা ছাড়া যখন উন্নয়ন প্রকল্প, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং অবকাঠামোর জন্য প্রতিটি অর্থই গুরুত্বপূর্ণ, তখন এই সম্ভাব্য রাজস্ব উপেক্ষা করা যায় না।
জনস্বাস্থ্যের উন্নতি
মডেলিং বেজড কর আরোপের আর্থিক সুবিধা বা রাজস্ব আয় বৃদ্ধি স্পষ্ট হলেও জনস্বাস্থ্যে এর প্রভাব আমলে নিলে এই করারোপ আরও যৌক্তিক হবে। বর্তমান বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী সিগারেটের ব্যবহার মাত্র শূন্য দশমিক ৫৩ শতাংশ কমার সম্ভাবনা আছে। এর বিপরীতে মডেলিং বেজড কর আরোপ করলে সিগারেটের ব্যবহার কমপক্ষে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ কমানো সম্ভব, যা ৫,৪০,৬৫৬ যুবকের মৃত্যু এবং ১০,৭৮,৬২৪ মোট মৃত্যুকে প্রতিরোধ করতে পারে। কারণ ধূমপান হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসসহ নানা রোগের। তা ছাড়া ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপানের কারণে স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বছরে ব্যয় হয়। তাই এই দাম বৃদ্ধিতে ধূমপান নিরুৎসাহী হলে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয়ও উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে।
অনেকে বলতে পারেন, সিগারেটের উচ্চ মূল্য নিম্ন আয়ের ধূমপায়ীদের ওপর বেশি প্রভাব ফেলতে পারে। তবে জনস্বাস্থ্যে এর সুবিধা আমলে নিলে এবং এর সঙ্গে সঙ্গে এই অতিরিক্ত আয় দিয়ে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কার্যক্রম, ধূমপান ত্যাগে সহায়তার উদ্যোগ ইত্যাদি নিলে দীর্ঘমেয়াদে জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন হবে, যা অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। তা ছাড়া যে দেশে লাগামহীন বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ছে এবং সরকারের তেমন কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না, সেখানে সিগারেটের দাম না বাড়িয়ে গরিব মানুষের উপকারের চেয়ে সিগারেট কোম্পানির উপকারই করছে বলে প্রতীয়মান।
তাই মডেলিং বেজড তামাক কর নির্ধারণ না করে সরকার একটা বিশাল আয়ের সুযোগ হারাচ্ছে। তা ছাড়া এভাবে কর নির্ধারণ করলে সরকারের শুধু অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ই হবে না, জনস্বাস্থ্যেও সুফল বয়ে আনবে। এর ব্যত্যয় ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ গড়ার প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকারের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। তাই এই মডেলিং বেজড তামাক করের সিদ্ধান্ত শুধু স্মার্টই না, নৈতিকও বটে।
সর্বোপরি, এভাবে কর নির্ধারণ করে ভবিষ্যতে অন্য খাতেও সরকার বেশি রাজস্ব আয়ের সংস্থান করতে পারে। বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রকৃত সূত্রপাত রাজস্ব বিভাগ তথা তামাক কর দিয়েই শুরু করা হোক।
ড. শাফিউন নাহিন শিমুল: অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিডিসি ফাউন্ডেশন রিসার্চ ফেলো, জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
[email protected]
- বিষয় :
- জনস্বাস্থ্য