সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
হাতের ইশারা নয়, ট্রাফিক সিগন্যাল চালু হোক

সুশান্ত সিনহা
সুশান্ত সিনহা
প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২৪ | ২১:৫৭ | আপডেট: ১৯ আগস্ট ২০২৪ | ১২:১৬
ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও পাঁচ শতাধিক প্রাণের বিনিময়ে হার মেনে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে স্বৈরশাসকের। বাংলাদেশের ইতিহাসের মোড় পাল্টে দিয়েছে; নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সব হিসাবনিকাশ পাল্টে দিয়েছে, তখন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখা মোটেও অমূলক নয়। বিশেষ করে পুলিশ, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তিমূলক সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও সুশাসন ফিরিয়ে আনা এবং কাঠামো ও গুণগত পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরি। সরকার নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আসে-যায়। কিন্তু রাষ্ট্র কাঠামো দাঁড়িয়ে থাকে ওপরের মৌল ভিত্তির প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর।
বাংলাদেশের আগে শ্রীলঙ্কায় গণঅভ্যুত্থানে রাজাপাকসে সরকারকে পালিয়ে যেতে হয়। কিন্তু তাদের খুব বেশি সময় লাগেনি দেউলিয়া হওয়া থেকে ঘুরে দাঁড়াতে। তা সম্ভব হয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা, সক্ষমতা ও শক্ত অবস্থানের কারণে। সবাইকে তাক লাগিয়ে তারা তাদের চড়া মূল্যস্ফীতি দ্রুত কমিয়ে এনে জনগণকে স্বস্তি দিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ’৯০-পরবর্তী সব প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে ভেতর থেকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। যার সর্বশেষ কফিনে পেরেক মারা হয়েছে গত ১৫ বছরের শাসনামলে।
সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানসহ রাষ্ট্র পরিচালনায় সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানে দলীয় লোকবল নিয়োগ দিয়ে লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করা হয়েছে। ন্যূনতম জবাবদিহি ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকায় হাজার হাজার কোটি টাকা তছরুপ হয়েছে। বিপরীতে জনগণ আইনের শাসনের বদলে পেয়েছে নিপীড়ন ও শোষণমূলক ব্যবস্থা। দেশে বড় বড় সেতু, মেট্রোরেল, স্যাটেলাইট কিংবা টানেল হয়েছে। কিন্তু টেকসই উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রীয় কাঠামোগুলো দুমড়েমুচড়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে।
বাংলাদেশে দুটি জিনিস কোনো নিয়ম মেনে পরিচালিত হয়নি। তার একটি হলো ব্যাংকিং খাত, অন্যটি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। দুটোই চলেছে রাজনৈতিক নেতা আর হর্তাকর্তা আমলার হাতের অঙ্গুলি হেলনে। গণঅভ্যুত্থানের পর ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছে রাতদিন। এটাই প্রথম নয়; ২০১৮ সালেও ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ দাবিতে সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কাজে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সড়ক ব্যবস্থাপনায় এতটুকু শিক্ষা নেয়নি টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার।
প্রথমত, হাতের ইশারায় নয়, সড়কে রাতদিন ২৪ ঘণ্টা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রিত হবে ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থার মাধ্যমে। এতে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সহজ হবে। কারণ রোদ, গরম ও বৃষ্টিতে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা যেভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করেন, তা অবৈজ্ঞানিক ও অমানবিক।
দ্বিতীয়ত, দুর্ঘটনা রোধসহ সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে লেন মেনে গাড়ি চালানো জরুরি। বর্তমানে সড়কে যে যেভাবে পারে আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নামে। এতে বাড়ে যানজট। অসুস্থ এ প্রতিযোগিতার কারণে গাড়িগুলো বিরামহীনভাবে হর্ন বাজিয়ে শব্দদূষণ ঘটায়। ভয়াবহ ও প্রাণঘাতী শব্দদূষণে সবচেয়ে এগিয়ে সরকারি গাড়িতে ব্যবহৃত সাইরেন হর্ন ও হাইড্রোলিক হর্ন। শব্দদূষণে বধির হওয়ার পাশাপাশি নাগরিকদের মনোজগতের ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে। কর্মদক্ষতা কমিয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে নীরব প্রাণঘাতক শব্দদূষণ শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। সঙ্গে ফিটনেসহীন গাড়ির কালো ধোঁয়ার নির্গমন বন্ধ করতেও উদ্যোগ নিতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে।
তৃতীয়ত, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সে ব্যবহৃত সাইরেন হর্নের বিকট শব্দে কান পাতা দায়। দুর্ঘটনাপ্রবণ এ দেশে কিছুক্ষণ পরপরই রাস্তায় আসা-যাওয়া করে অ্যাম্বুলেন্স। অথচ এসব নিরাপত্তা বাহিনী ও অ্যাম্বুলেন্সের হর্নের সহনীয় মাত্রাও বেঁধে দেওয়া আছে, যা মানছে না কেউই। ফলে শব্দদূষণ বন্ধে এসব গাড়িতেও নিয়ন্ত্রিত সীমার মধ্যে হর্ন দেওয়ার নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে তরুণদের সোচ্চার হতে হবে।
চতুর্থত, বহুজাতিক গবেষণা সংস্থা নামবিওর প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৮ অনুযায়ী, ভারতের কলকাতার পরই দ্বিতীয় শীর্ষ যানজটের নগরী উপাধি পেয়েছিল ঢাকা। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে রাস্তায় যানজটে কাটাতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এতে একদিকে নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা, অন্যদিক পুড়ছে জ্বালানি তেল ও গ্যাস। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে, অসহনীয় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এতে আর্থিক ক্ষতি দাঁড়ায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। সঙ্গে পুড়ছে ১১ হাজার কোটি টাকার জ্বালানি। ফলে যানজট কমাতে পারলে দু’দিক থেকেই এগিয়ে যেত বাংলাদেশ।
দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজের কারণে ঢাকার ৩৫টি সড়কে পার্কিং ইজারার মাধ্যমে দলীয় লোকজনকে তোলাবাজির সুযোগ দেওয়া যানজটের এ শহরে আরও যানজট বাড়িয়েছে। অবিলম্বে রাস্তায় গাড়ি পার্ক করার সিদ্ধান্ত বাতিল করে সড়কে যান চলাচলের গতি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
প্রতিটি বাণিজ্যিক ভবনের নিচতলা ও আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্যের মালপত্র রাখার গুদাম বা অফিস হিসেবে ব্যবহার করেন ভবন মালিকরা। আবার যাদের পার্কিং চালু আছে, সেখানেও পর্যাপ্ত গাড়ি রাখা হয় না। তাই ভবন মালিকদের বাধ্য করতে হবে ভবনে পর্যাপ্ত পার্কিং নিশ্চিত করার।
অনেকে বলেন, রাস্তায় গাড়ি না থাকলে থাকবে কোথায়? উত্তরে বলা যায়, দিনের বেলায় সড়কে থাকা গাড়িগুলো রাতে থাকে কোথায়? নিশ্চয় রাতে রাস্তায় কেউ গাড়ি পার্ক করে রাখে না? তাহলে রাতে যেখানে থাকে, সেখানে দিনেও থাকতে পারে। রাস্তায় গাড়ি পার্কিং বন্ধ হলে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা সম্ভব হবে। বর্তমানে ঢাকার রাস্তায় ৩৩ শতাংশই ব্যক্তিগত গাড়ি। প্রতিদিন মোটরসাইকেলসহ প্রায় ১৩শ গাড়ি রাস্তায় নামছে নতুন করে। ফলে আগামীর স্বার্থে, সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যেতে বাংলাদেশে সড়ক ব্যবস্থাপনায় গাড়ি পার্কিং এবং যাত্রী তোলা বন্ধ করতে হবে।
ধরা যাক, আপনি একটা জিরাফ কিনেছেন। এখন সেই জিরাফ আপনার বাসায় রাখতে চান। জিরাফের লম্বা গলা, তাই জিরাফকে আপনার বাসায় কীভাবে রাখবেন সে দায়িত্ব নিশ্চয় ভবন মালিক বা বাড়িওয়ালার নয়, আপনার! ফলে আপনাকে জিরাফ রাখতে চাইলে ওই মাপেরই বাসা ভাড়া যেমন নিতে হবে; ঠিক তেমনি গাড়িগুলো পার্কিং ভবনে রাখতে হবে অথবা ভবনের পার্কিংয়ে। যানজট কমানোসহ আধুনিক সড়ক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ওপরের গুণগত পরিবর্তনগুলো আনতে শিক্ষার্থীসহ সবারই সোচ্চার হওয়ার বিকল্প নেই। একই সঙ্গে দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ট্রাফিক ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন করতে হবে।
সুশান্ত সিনহা: সাংবাদিক ও জনস্বাস্থ্য গবেষক
[email protected]
- বিষয় :
- ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ