ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

আদালত, দুদক যেন নিস্কলুষ থাকে

আদালত, দুদক যেন নিস্কলুষ থাকে

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০১৯ | ১৩:৩৭

বিশ্বায়নের সমসাময়িক পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রই গণতন্ত্রকে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত এবং প্রণিধানযোগ্য অনুষঙ্গ হিসেবে অধিকতর গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে। এর ধারাবাহিকতায় অধুনা উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রায় প্রতিটি দল এবং দলীয় সরকারের আদর্শ-উদ্দেশ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ব্যক্তিমানুষের স্বাধীনতা এবং সৃজনশীলতার প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ প্রতিটি রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রের মৌলিক বিষয় হওয়া সত্ত্বেও এর প্রতিফলন কতটুকু বাস্তবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, তা বিচার-বিশ্নেষণের দাবি রাখে। একবিংশ শতাব্দীতে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনায় প্রতীয়মান, মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক শিখরের দ্যোতক বা আইনের শাসন ও ক্ষমতার ভারসাম্যের চিন্তা-চেতনা ও ধারণার সমন্বিত প্রয়াস অনেকাংশে সংকুচিত।

বিভিন্ন স্বৈরতন্ত্রের নীতিমালাকে পর্যুদস্ত করে গণমানুষের ইচ্ছাশক্তি, ঋজুতা ও সৃষ্টিশীলতার প্রায়োগিক ক্ষেত্রে মানবতাবাদের বিজয় নিরন্তর বিপন্ন ও বিপর্যস্ত। তবুও সুশাসনের প্রধান নিয়ামক- সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সমৃদ্ধ বিবর্ধন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সত্যনিষ্ঠতায় প্রচ্ছাদিত করবে- এতে কারও দ্বিমত করার অবকাশ নেই। এটি সুপ্রতিষ্ঠিত যে, মানুষের আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসের বিবর্ত অবস্থানকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নাগরিক স্বাধীনতা ও অধিকার ভোগ করার প্রায়োগিক শিক্ষার আরোপিত উপমা হচ্ছে 'গণতন্ত্র'। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক মনীষী অ্যারিস্টটল বিমোক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গি ও বস্তুবাদী দর্শনের ঐতিহ্যিক জিজীবিষা জীবনের প্রয়োজনে নয়, বরং উত্তম জীবনপ্রবাহের উৎকর্ষের প্রয়োজনে রাষ্ট্রের উৎপত্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। এ জন্যই রাষ্ট্র মানব বিকাশ ও পরিপূর্ণতার জন্য একটি অনিবার্য প্রতিষ্ঠান।

মানুষ, পরিবার ও সমাজের সর্বাঙ্গীণ স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও মঙ্গল প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার সার্থকতা সর্বজনবিদিত। ব্যক্তি, শ্রেণি বা দলীয় স্বার্থ রক্ষার যে ধারণা তথা স্বৈরতন্ত্র, অভিজাততন্ত্রের বিপরীতে মানুষ প্রতিষ্ঠা করেছে জনন্যায়তন্ত্র বা গণতন্ত্র। এখানেই সুসংহত আইনের শাসন, পরিচর্যা ও অনুশীলন অবধৌতিক মহিমায় রাষ্ট্রশাসনকে গৌরবদীপ্ত করে। স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর বিশ্বজনীন ধারণা ও চেতনায় উর্জস্বী ইউরোপের রেনেসাঁ বা ফরাসি বিপ্লব গণতন্ত্রের যে অবিনাশী শক্তির সোপান নির্মাণ করেছে, তারই ভিত্তিতে রাষ্ট্র জনগণের চরিত্র, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আর্থ-সামাজিক পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে মুক্ত সমাজ গঠনের প্রক্রিয়াকে সুস্পষ্ট করেছে। এটিই গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ইতিহাসের অনবদ্য বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য।

অতিসম্প্রতি বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে নষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি, ক্ষমতা ও অর্থের দুর্বৃত্তায়ন এবং সুশাসন পরিচর্যায় দুর্ভেদ্য প্রতিবন্ধকতা জাতি-রাষ্ট্রের নৈর্ব্যক্তিক উন্নয়ন সমৃদ্ধিকে প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ চমকপ্রদভাবে সর্বত্রই প্রশংসিত ও সমাদৃত। বাংলাদেশের সমগ্র নাগরিক বস্তুনিষ্ঠ প্রক্রিয়ায় এসব দুরূহ পদক্ষেপের যথার্থ বাস্তবায়নে প্রযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বা আদালত, দুদকসহ অন্য সব সংস্থার প্রতি গভীরভাবে আস্থাশীল। এখনও দেশের মানুষ নিবিড়ভাবে বিশ্বাস করতে চায়, এসব অভিযান যেন নিপীড়ন-নির্যাতন-হয়রানি-চরিত্র হনন নয়, অনৈতিক প্রভাব; প্ররোচনা বা অর্থলিপ্সায় নিরীহ-নির্দোষ-মার্জিত-অসহায় ব্যক্তিদের ফাঁসিয়ে দেওয়া বা মিডিয়া ট্রাইয়ালের উদ্দেশ্যেই যেন পরিচালিত না হয়।

যথার্থ অর্থেই অভিযোগের সত্যতা নির্ধারণে প্রশিক্ষিত ও পারদর্শী কর্মকর্তাদের অকাট্য প্রমাণ এবং প্রযোজ্য সততার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ রাষ্ট্রযন্ত্রের বাহনগুলোর চৌকস তদন্তকারীদের সমন্বিত নিগূঢ় ও পুনঃক্রস যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় এনে অবশ্যই কঠোর শাস্তির পরিদৃশ্যমান ব্যবস্থা অবশ্যই প্রয়োজনীয়। প্রহসন বা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে অথবা আদালতে পরাভূত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা পরিহার করেই যথাযথ প্রক্রিয়ায় আদালতে মামলা বা অভিযোগপত্র প্রদান একান্ত বাঞ্ছনীয়। নির্ধার্য পরাকাষ্ঠা আদালত বা দুদক কর্তৃক দৃষ্টান্তমূলক স্থাপনে ব্যর্থ হলে দুর্বৃত্তায়নই জয় হবে। সাবলীল ব্যক্তিত্ব, সৃজনশীল প্রতিভা, মানবতাবাদ, বিবেক-ভব্যতা এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সবাই প্রাগ্রসর নৈতিকতায় প্রোৎসাহিত। আইনের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধাশীল জনগোষ্ঠী আইন-আদালতের নৈষ্ঠিক বিচার কার্যক্রমে এখনও পুরোপুরি নির্ভরশীল।

নিঃসন্দেহে বলা যায়, প্রভাবিত আদালত বা অন্যান্য সংস্থা কোনোভাবেই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারে না। জাতিকে যার জন্য কালপরিক্রমায় কঠিন মূল্য দিতে হয়। অতিসম্প্রতি বিশ্বব্যাপী আলোড়িত গণতন্ত্রের প্রাঞ্জল ভূমি যুক্তরাষ্ট্রের ঘটনাটি সঠিক বিচারহীনতার নির্মম অধ্যায় বিবেচনায় নতুন করে সবাইকে বিস্মিত করেছে। ১৯৮৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ম্যারিল্যান্ডের বাল্টিমোর শহরে একটি মাধ্যমিক স্কুলের ১৪ বছরের এক শিক্ষার্থীকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যার অভিযোগে তিনজন কিশোরকে ৩৬ বছর কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। ৩৬ বছর অমানবিক কারাভোগকারীরা বর্তমানে পঞ্চাশের অধিক বয়স অতিক্রম করছে। দীর্ঘ ৩৬ বছর অতিক্রান্ত আদালত সম্পূর্ণ নির্দোষ সাব্যস্ত করে তাদের মুক্ত জীবন ফিরিয়ে দেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভুল তদন্ত ও প্রহসিত সিদ্ধান্ত এই কিশোরদের প্রতি নৃশংসতা এবং তাদের পুরো জীবন-যৌবন ধ্বংস করে প্রৌঢ়তাদানের দায়ভার কে বহন করবে?

বাংলাদেশেও জজ মিয়া নাটকসহ কারণে-অকারণে বহু নিরীহ-নির্দোষ মানুষকে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপ্রবণতায় উন্মাদ নষ্ট ব্যক্তিদের জিঘাংসার শিকারে অপরিসীম যন্ত্রণাকাতর, কারাবরণ বা আত্মনিগ্রহে প্ররোচিত হওয়ার দৃষ্টান্তও কম নয়। অতএব আদালত, দুদক বা অন্যান্য বিচারিক কার্যক্রম যাতে কোনোভাবেই উল্লেখ্য ঘটনার নৈতিক উদাহরণ না হয়; সেদিকে রাষ্ট্রের মনোযোগ আকর্ষিত হওয়া খুবই জরুরি। রবিঠাকুরের 'প্রশ্ন' কবিতার পঙ্‌ক্তি উদ্ৃব্দত করে সমস্বরে যেন আমাদের উচ্চারণ করতে না হয়- 'ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত, পাঠায়েছ বারে বারে/দয়াহীন সংসারে,/তারা বলে গেল 'ক্ষমা করো সবে', বলে গেল 'ভালোবাসো-/অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো'।/বরণীয় তারা, স্মরণীয় তারা, তবুও বাহির-দ্বারে/ আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে।/আমি-যে দেখেছি গোপন হিংসা কপট রাত্রিছায়ে/ হেনেছে নিঃসহায়ে,/আমি-যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে/ বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে।' প্রচলিত ধারণা এই যে, শুধু স্বল্প সংখ্যক দুর্বৃত্তরাই শাস্তিপ্রাপ্ত হয়, বড় মাপের অপরাধীরা কেন জানি বরাবরই অধরায় থেকে যায়।

বিভীষণ বা 'ভূতের মুখে রাম রাম', অবৈধ পেশি ও অর্থশক্তি, বর্ণচোরা, তোষামোদকারী অথবা বিভ্রষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি কথিত গণতন্ত্রের মোড়কে ভয়ংকর দাপট এবং ক্ষমতার বলয় সৃষ্টিকারীদের রুখে দেওয়ার জন্য সরকার বা দেশবাসীকে একতাবদ্ধ হতে হবে। একা সরকারপ্রধানের পক্ষে সব ইতিবাচক উদ্যোগের সফল বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, যদি না জাতি-রাষ্ট্রের সব জনগোষ্ঠীর সমন্বিত শক্তি জোরালো ভূমিকা পালন না করে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৈন্যদশা এমন এক ডানপিটে পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যা পরম শ্রদ্ধেয় কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর বক্তব্যে সুস্পষ্ট উপস্থাপিত হয়েছে। সম্ভবত তার কোনো লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন, 'আগে রাজনীতিকরা দলের নেতা হতেন, এখন হন ব্যবসায়ীরা। এখন মুৎসুদ্দি পুঁজির বিকাশ ঘটেছে দেশে। রাজনীতিতেও তাদেরই দাপট। রাজনীতিকরা দলে বছরের পর বছর কাজ করে নেতৃত্বের আরেকটি ধাপ অতিক্রম করতেন। এখন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা দলে যোগ দিয়েই নেতা হতে চান। তারা টাকা দিয়ে এমপি আসন কেনেন। দলের নেতৃত্বেও আসীন হন। তাদের দাপটে রাজনীতিকরা বিতাড়িত হচ্ছেন।' বাংলাদেশে এর কোনো পুনরাবৃত্তি না হোক- এই প্রত্যাশাই ব্যক্ত করছি।

শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


আরও পড়ুন

×