ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

১৪ দলে টানাপোড়েন: আদর্শ বনাম অপ্রাপ্তিযোগ

রাজনীতি

১৪ দলে টানাপোড়েন: আদর্শ বনাম অপ্রাপ্তিযোগ

সাইফুর রহমান তপন

সাইফুর রহমান তপন

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৪ | ০২:৪৮ | আপডেট: ২১ মার্চ ২০২৪ | ০৮:১০

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ‘আদর্শিক’ জোট ১৪ দল কি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে? প্রশ্নটা তোলার কারণ হলো, জোটের প্রধান দলের সঙ্গে অন্যদের– বিশেষত বাম শরিকদের মধুচন্দ্রিমা বহু আগেই শেষ হয়েছে; এখন নাকি তারা এমনকি বিচ্ছেদের কথাও ভাবছে। 

সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আলাপচারিতায় শরিক দলগুলোর নেতা কেউ কেউ স্বীকার করেছেন, রাজনীতিতে তাদের প্রভাব কমে আসছে। আওয়ামী লীগও শরিকদের গুরুত্ব দিচ্ছে না। তাই প্রথম আলো রোববার যেমনটা লিখেছে, “শরিকেরা নিজেরা আগবাড়িয়ে বলবে না যে তারা ১৪-দলীয় জোটে নেই; বরং নিজেদের মতো করে ‘জনবান্ধব’ ইস্যুতে কর্মসূচি পালন করবে। পাশাপাশি অন্য শরিকদের সঙ্গে ঐক্যের বিষয়টি এগিয়ে নিয়ে যাবে।” এমনকি একই প্রতিবেদনমতে, ওয়ার্কার্স পার্টি আগের ১১ দলীয় জোটকে সক্রিয় করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

২০০৫ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল গঠনের আগে ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি, বাসদসহ দেশের মূলধারার প্রায় সব বাম দল এবং উদারপন্থি বলে পরিচিত ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম ও গণতন্ত্রী পার্টি মিলে ১১ দল নামে একটি জোট ছিল। সিপিবি ও বাসদ বাদে ওই জোটের সবাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মেনে ১৪ দল গঠন করে।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলের অন্য শরিকদের সম্পর্ক অন্তত ২০১৮ সাল অবধি বেশ ভালোই ছিল। জোট শরিকদের মধ্যে চারজন মন্ত্রিত্বের স্বাদ পান– ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া। শাসক দলের বদান্যতায় বিগত তিনটি সংসদে বিশেষত ওয়াকার্স পার্টি ও জাসদের সংসদ সদস্য সংখ্যাও ছিল সম্মানজনক। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের বাইরে ১৪ দলে শুধু এই দুই দলেরই রাজনীতির মাঠে মোটামুটি দৃশ্যমান তৎপরতা আছে। তাই বরাবরই শাসক দলের কাছে এদের খাতির একটু বেশিই দেখা গেছে।

তবে ২০১৮ সালে এককভাবে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ জোট সদস্যদের বলে বিরোধী দলে বসতে। প্রধান শরিকের প্রায় অযাচিত এ পরামর্শের বিরুদ্ধে ওয়াকার্স পার্টি ও জাসদ প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করে। মূলত তখনই বোঝা যাচ্ছিল, আওয়ামী লীগের কাছে ১৪ দলের প্রয়োজন ফুরিয়ে আসছে। যে কারণে বলা যায়, অন্তত গত সরকারের প্রায় পুরো মেয়াদে জোটটি নিষ্ক্রিয় ছিল। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে– তাও শরিকদের চাপাচাপিতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জোটের একটা বৈঠক হয়। শুধু তাই নয়, আগের নির্বাচনগুলোতে জোট শরিকরা আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ১২-১৬টি আসনে ছাড় পেয়ে গড়পড়তা ছয়-সাতটি আসনে জিতলেও, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে মাত্র ছয়টি আসনে ছাড় পায় এবং জয় পায় মাত্র দুটো আসনে। রাশেদ খান মেনন ও জাসদের কেন্দ্রীয় নেতা এ কে এম রেজাউল করিম ছাড়া সবাই হেরেছেন। 

শাসক দলের ‘ডামি’ প্রার্থীর কাছে হেরে বলা যায়, কিল খেয়ে কিল হজম করে শরিক দলগুলো আশা করেছিল, হয়তো সান্ত্বনাস্বরূপ অন্তত দু-একজন নেতাকে মন্ত্রিপরিষদে ঠাঁই দেওয়া হবে। সেটা তো হয়ইনি; সংরক্ষিত মহিলা আসন ভাগে পাওয়ার তাদের তদবিরও পাত্তা পায়নি। যদিও আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ১৪ দলের শরিক গণতন্ত্রী পার্টির একাংশের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কানন আরা সংরক্ষিত মহিলা এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এতে ‘বড়’ শরিকদের সন্তুষ্টির কোনো জায়গা নেই।
সংবাদমাধ্যমগুলো লিখেছে, শরিক দলগুলোর কেউ কেউ মনে করছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ দলের একটা বৈঠক ডাকলে জোট শরিকদের ক্ষোভ প্রশমিত হবে। ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক এবং আওয়ামী লীগের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমুও বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী হয়তো শিগগিরই তাদের ডাকবেন। কিন্তু তাতে কি দলগুলোর নেতাকর্মীর ক্ষিদে মিটবে?

যে সংকটজনক প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ ১৪ দল গঠন বা ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিল, সে সংকট দলটি ইতোমধ্যে উতরে গেছে। এ পরিস্থিতিতে নিজে থেকে জোট শরিকদের খাতির-যত্ন করার তাগিদ তার থাকবে না– এটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ শরিকদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে হবে আওয়ামী লীগের শর্তে। শাসক দলটির নেতারা প্রকাশ্যেই বলছেন, সহযোগিতা পেয়েও ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা ‘নিজেদের পায়ে’ দাঁড়াতে পারেনি। মোদ্দা কথা, মুখে চামচ তুলে শরিকদের খাওয়াতে আওয়ামী লীগ আর গরজ বোধ করছে না। 

স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছর ৭ জানুয়ারি সমকালে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে মেনন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমাদের কর্মীরাও সরকারি ক্ষমতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে।’ এভাবে কোনো দলই রাজনীতিতে নিজস্ব জমিন তৈরি করতে পারে না। অথচ এ দেশে এমনও উদাহরণ আছে, যেখানে বড় দলের সঙ্গে জোট বেঁধে অপেক্ষাকৃত ছোট দল নিজের ভিত আরও শক্ত করেছে, এমনকি রাষ্ট্রীয় নানা নীতি নির্ধারণে ওই ছোট শরিক বড় শরিককে ব্যাপক প্রভাবিতও করেছে। আমি বিএনপি-জামায়াত জোটের কথা বলছি।

অনস্বীকার্য, ১৪ দল আমাদের রাজনীতিতে উদারনৈতিক শক্তির বিকাশে কতটা কার্যকর ভূমিকা রেখেছে তা তর্কের বিষয় হলেও, অন্তত ধর্মীয় উগ্রপন্থি শক্তিগুলোকে অনেকাংশেই দমাতে পেরেছে। এতে উদারমনা মানুষেরা একটু হলেও স্বস্তি পাচ্ছে। কিন্তু এই ভূমিকা রাখতে গিয়ে বিশেষত সামরিক স্বৈরতন্ত্র এবং ঘাতক-দালালবিরোধী রাজনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী বাম দলগুলো কেন ক্ষয়ে যাবে?

তাই বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিশেষত ১৪ দলভুক্ত বাম দলগুলোর উচিত ছিল আত্মানুসন্ধান চালানো; আওয়ামী লীগের মতো আপাতবিপরীত শ্রেণির একটা বৃহৎ দলের সঙ্গে জোটচর্চা করতে গিয়ে নিজেদের দুর্বলতা এবং শক্তি চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু দলগুলো সে পথে হাঁটছে বলে মনে হচ্ছে না। তাই অন্তত সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ ১৪ দলের শরিক দলগুলোর অভ্যন্তরে জোটে থাকার প্রয়োজনীয়তা এক প্রকার ‘প্রাপ্তিযোগ’-এর ভিত্তিতেই আলোচিত হচ্ছে। আমরা দেখেছি, অতীতে এমন পরিস্থিতিতে ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ ভেঙেছে। আবারও যে এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, তা কে বলতে পারে?

এদিকে মূলত এই বিব্রতকর পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার পুরোনো কৌশল হিসেবেই দল দুটির অত্যন্ত অভিজ্ঞ শীর্ষ নেতারা রাজপথে নামার ঘোষণা দিয়েছেন। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, এখন তারা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও দুর্নীতির মতো সর্বগ্রাসী ইস্যুতে রাজপথে কর্মসূচি নিয়ে জোরালোভাবে মাঠে নামবেন। কিন্তু ইতোমধ্যে এমন এক কর্মসূচিতে যে ভাষা ও ভঙ্গিতে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বক্তব্য রেখেছেন, তা অন্তত সচেতন মানুষের মধ্যে এক প্রকার বিবমিষাই জন্ম দেবে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল এক ভিডিওতে যেমনটা দেখা গেছে, খেজুরের মূল্যবৃদ্ধি এবং শিল্পমন্ত্রীর এ সংক্রান্ত পরামর্শের প্রতিক্রিয়ায় ওই সমাবেশে তিনি উক্ত মন্ত্রীকে রীতিমতো হুমকি দিয়েছেন।

একজন প্রবীণ ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিকের একই জোটভুক্ত আরেক প্রবীণ রাজনীতিকের প্রতি এহেন আক্রমণ সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আদৌ কি সহায়ক হবে?

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল

আরও পড়ুন

×