ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

নগর জীবন

পানির মিটার বিভ্রাট ও নাগরিক ভাবনা

পানির মিটার বিভ্রাট ও নাগরিক ভাবনা

সাজ্জাদ জহির

সাজ্জাদ জহির

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৪ | ০০:০৫

বেশ ক’মাস ধরে ওয়াসা থেকে পানির মিটার পাল্টানোর তাগিদ আসছে। অ্যাপার্টমেন্টের কেয়ারটেকারের কাছে খোঁজ নিয়ে আমার বন্ধু জানতে পারল, মিটারের কাচের ভেতর জলীয় বাষ্প জমাট বাঁধায় বাইরে থেকে রিডিং নেওয়া দুষ্কর। তবে মিটারের সামনে ঘণ্টাখানেক আলো জ্বালিয়ে রাখলে তাপে ধোঁয়াশা ভাব চলে যায় এবং দিব্যি রিডিং নেওয়া যায়। যিনি রিডিং নিতে আসেন, তাঁর পক্ষে আগে থেকে সময় বা দিন ধার্য করা সম্ভব নয়। সে কারণে কোনো এক আঙ্কিক বিধানে সৃষ্ট গড় বিল প্রতিমাসে আসতে থাকে, যেখানে মিটার রিডিংয়ের উল্লেখ থাকে না। এসব তথ্য নজরে এলে আমার বন্ধু দুই দফায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে। সেই আলোচনার প্রাসঙ্গিক কিছু দিক এবং সেসবের সম্ভাব্য অর্থ নিম্নে উল্লেখ করছি।

ঘটনা-অ
নতুন মিটার নিতে নির্দিষ্ট দালানের ব্যবস্থাপনা কমিটির আপত্তি ছিল না। তবে যেটা পাল্টানোর কথা উঠেছিল, তা বছর দুয়েক আগে কেনা। তাই নতুন মিটার নেওয়ার আগে তারা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে মিটারটির ব্যবহারযোগ্যতার নিশ্চিতপত্র পেতে চায়। এ ধরনের আবদার কর্মকর্তাটি আগে কখনও শোনেননি। তাঁর এখতিয়ারে না থাকা সত্ত্বেও তিনি তিন মাসের নিশ্চয়তা বিধানে রাজি হলেন। কিন্তু মাত্র তিন মাস পর কাচ ঘোলাটে হলে আবারও ২০ হাজার টাকা খরচ করতে আমার বন্ধু ও দালানের অন্যরা রাজি হলো না। বাজার থেকে যাচাই-বাছাই করে মিটার কেনার সুযোগ আছে কিনা, জানতে চাইলে বলা হয়, সে অনুমোদন দিতে এ অফিস রাজি নয়। অর্থাৎ ওয়াসা অফিসের মিটারই কিনতে হবে।

ভাবনা-১
ঘটনা শোনার পর জানলাম, মিটারের বিতরণ পর্যায়ের বাজারটি একচেটিয়া। অর্থাৎ একক সরবরাহকারী নিয়ন্ত্রিত। এ ক্ষেত্রে দ্রব্যের মান ও দাম নজরদারির কোনো দায়িত্ব কি ভোক্তা অধিকার দপ্তরের নেই? সেই দপ্তরের কোনো কোনো কর্মকর্তাকে উদ্যোগী ভূমিকায় ইউটিউবে দেখা যায়; যদিও মিটার বাজারের খোঁজ সম্ভবত তারা রাখেন না। শহরের লাখ লাখ নাগরিক কি এ ব্যাপারে সরব?

ঘটনা-আ
আমার মন্তব্যের সূত্র ধরে দ্বিতীয় দফার আলোচনায় আমার বন্ধু ওয়াসা প্রতিনিধিকে প্রশ্ন করে জানল, মিটারটি বিদেশ থেকে আমদানীকৃত। এই পণ্য বাজারজাত করতে কোনো পারিশ্রমিক বা কমিশন দেওয়া হয় কিনা, জানতে চাইলে তাঁর উত্তর মেলেনি। 

ভাবনা-২
নিঃসন্দেহে একটি মিটার অধিককাল ব্যবহার করতে পারলে এই দুর্দিনে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। 

ঘটনা-ই
নতুন মিটার বাজারজাত করার বিকল্প হিসেবে দুটো প্রস্তাব রাখা হলো। প্রথমত, প্রতিমাসে যে দিনে রিডিং নিতে আসবেন, তা আগে জানিয়ে দিলে তাপ বাড়িয়ে কাচের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায়। নানাবিধ ব্যস্ততার কারণে নির্দিষ্ট কোনো দিন আগে থেকে নির্ধারণ করে মিটার পরিদর্শকদের পক্ষে জানানো সম্ভব নয় বলে জানানো হয়।
দ্বিতীয়ত, কারিগরি বিদ্যা প্রয়োগের মাধ্যমে ভেতরের বাষ্প নিষ্কাশনের সম্ভাবনা সম্পর্কে ওয়াসার ইঞ্জিনিয়ার বা গবেষণা বিভাগ কোনো পন্থা বের করেছে কিনা, জানতে চাইলে স্পষ্ট হয়, সে ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ে কোনো ধারণা, তথ্য বা নির্দেশ নেই।

ভাবনা-৩
সেই আশির দশক থেকে বিদেশি ঋণের সঙ্গে প্রযুক্তি বাজারজাত করার সম্পৃক্ততা দেখে আসছি। তাই সন্দেহ জাগে, কোনো এক ঋণ প্রকল্পের অধীনে ঋণ দানকারী দেশ তাদের তৈরি মিটার ওয়াসার মাধ্যমে বাজারজাত করছে কি এবং জনহিতকর সেবা খাতে কমিশনভিত্তিক মার্কেটিং ব্যবস্থা সংযুক্ত হয়েছে কি? পাঠকদের বিষয়টি যাচাই করে দেখার অনুরোধ রইল।

ঘটনা-ঈ
বিল ও মিটার-সংক্রান্ত বিষয়ে অনুসন্ধান করার জন্য উচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা এলে আমার বন্ধু তাঁকে আমার সঙ্গে ফোনে ধরিয়ে দেয়। তিনি শুরুতেই দাবি করলেন, মিটারের রিডিং (ডিজিটাল যুগে চাকা শব্দটি বেমানান) ধীরগতিতে চলছে। কীভাবে সেটা তিনি বুঝলেন, তা জানতে চাইলে তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। কথা না বাড়িয়ে আমি দাবি করলাম, ‘মিটারটি ঠিক আছে– আপনি কীভাবে তা ভুল প্রমাণ করবেন?’ 

সদুত্তর না পেয়ে তিনি মিটারটি খুলে তাদের অফিসের ল্যাবে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। মাঠ পর্যায়ে মিটার যাচাইয়ের কোনো সহজ পদ্ধতি বা ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে চাই। যেমন– পানি মিটারের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর তার পরিমাপ নেওয়া সম্ভব এবং রিডিংয়ের সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখা সম্ভব। অথবা বাইরে ভিন্ন মিটার বসিয়ে যাচাই করার কোনো ব্যবস্থা থাকতে পারে। আলোচনায় মনে হলো, এসব বিষয়ে প্রতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কোনো চিন্তাভাবনা নেই।

ভাবনা-৪
পুরো বিষয় একসূত্রে গেঁথে পুরোনো সংশয় মনে দানা বাঁধল। আমদানি করা যন্ত্রপাতি মেরামত করে আমাদের হাতে শেখার পরিসর এক সময় বিস্তৃত ছিল। সেই সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন এবং এক পর্যায়ে মূল যন্ত্রটি স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করার যোগ্যতা অর্জনের স্বপ্ন ছিল। আজকাল বাজার থেকে আহরণ অধিক আকর্ষণীয়। এর সঙ্গে কমিশন অর্জন জড়িত। সম্ভবত সে কারণেই তথ্য ও যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে নিজ নিজ বলয়ে ক্ষমতার জোরে মন গড়া বা স্বার্থসিদ্ধির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ধারণা অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা সর্বগ্রাসী।

পরিশেষে

ওপরে বর্ণিত মতবিনিময় অনেক কর্মচারীর গোচরে আসে। দালানের কেয়ারটেকার এমন একজন কর্মচারীকে উদ্ধৃত করে আমার বন্ধুকে জানাল, ‘স্যাররা তো দেশের কথা ভাবছেন, আমাদের কথা কে ভাববে?’

সত্যিই তো! আজকের সমাজে অর্থবানরা তাদের অর্থ কীভাবে খরচ বা বিতরণ করছে, তার ওপর সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির অনেক কিছুই নির্ভর করে। কীভাবে অর্থ উপার্জন করছেন, সে আলোচনা এই পরিসরে প্রাসঙ্গিক নয়। এখন পানির গ্রাহক অ্যাপার্টমেন্টবাসী হিসেবে কিছু ভাবনায় আমার 
বন্ধু দ্বিধান্বিত।

ক. কোনো প্রশ্ন না তুলে, নিয়মিত মিটার কিনে, বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে তা বাজারজাত করার বর্তমান ব্যবস্থাকে টিকিয়ে 
রাখা; অথবা

খ. মাঠকর্মীকে আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে নতুন মিটার বসানো বিলম্বিত করে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে ক্ষুদ্র ভূমিকা রাখতে পেরে তুষ্টিতে ভোগা, নাকি

গ. ওয়াসার ভেতর কমিশনভিত্তিক পণ্য বিক্রেতা তৈরিতে উৎসাহ না দিয়ে তাদেরকে যন্ত্র মেরামতে এবং মাঠ পর্যায়ের সমস্যা সমাধানে উদ্ভাবনী চিন্তায় উৎসাহিত করতে প্রায়োগিক বিজ্ঞানচর্চা প্রতিষ্ঠাকল্পে সম্মিলিতভাবে অর্থ প্রদান করা?

সাজ্জাদ জহির: অর্থনীতিবিদ; নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি)

আরও পড়ুন

×