নগর জীবন
ভুল নীতি-কৌশলে জলাবদ্ধতার অভিশাপ

এম আর খায়রুল উমাম
এম আর খায়রুল উমাম
প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:০৩ | আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:০৩
ছয় দশক আগের কথা। সে সময় বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে দেশে বাঁধ, পোল্ডার, স্লুইসগেট নির্মাণ করে পানির স্বাভাবিক গতি নিয়ন্ত্রণ করা শুরু হয় এবং এর সুফল সাধারণ জনগণকে দেখাতে সোনার কাস্তে দিয়ে ধান কাটা হয়। সরকারের সে আশীর্বাদ জনগণের জন্য অভিশাপে পরিণত হতে কিন্তু দেড় দশকের বেশি সময় লাগেনি। মূল প্রকল্পের কয়েক গুণ অর্থ ব্যয় করার পরও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি আসেনি বরং বিড়ম্বনা বেড়েই চলেছে। অনেকের মতে, মনুষ্যসৃষ্ট এসব জলাবদ্ধতা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতো লাভজনক। ফলে হাঁস মারতে চায় না কেউ।
নগরায়ণের প্রথম পর্যায়ে গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষ যখন গ্রামীণ জীবনের কথা ভুলতে পারেনি, তখন সামর্থ্যবানরা শহরের বাড়িতে মাছের জন্য পুকুর কেটেছে; দেশি ফলের জন্য সবুজ বনায়ন করেছে। কিন্তু জনসংখ্যার ভারে সেসব পুকুরও আজ ভরাট। স্থানীয় সরকারের পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশন নিজ নিজ এলাকার জলাশয়গুলো স্বজনের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দিয়ে পানি চলাচলের গতিপথে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে সর্বক্ষণ। রাজনীতির মদত ও কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় দেশের জলাশয়গুলো প্রথমত বেদখল হয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে সেখানে দালানকোঠা নির্মাণ করে আবাসন বাণিজ্য শুরু হচ্ছে। নানাভাবে গণহারে জলাশয় ধ্বংস করার পরিণতিই মূলত আজকের জলাবদ্ধতা।
মজার বিষয়, এখন সারাদেশে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির জন্য কর্তৃপক্ষ দেশি-বিদেশি অর্থে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে। তাতে কাজের কাজ তো কিছু হচ্ছেই না, বরং নগরবাসী যত পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে, ততই কর্তৃপক্ষের রমরমা বাণিজ্য জোরদার হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে ভবদহের কথা বলা যায়। চার দশক আগে প্রথম যখন যশোর জেলার দুঃখ ভবদহে জলাবদ্ধতার কথা ব্যাপক প্রচার পায়, তখন এলাকার মানুষের কষ্টকর জীবন দেখে সারাদেশের মানুষ ভবদহের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। সরকার সেই জলাবদ্ধতা নিরসনে দেশি-বিদেশি পরামর্শকদের একের পর এক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে থাকে কিন্তু এসব পরিকল্পনায় এলাকার মানুষের বিপদ বরং ইতোমধ্যে বেড়েছে।
কয়েক দিন আগে রাজধানীতে কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টিপাতে শহরটা সমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। সে সময়ে বিশেষজ্ঞরা কারণ বিশ্লেষণ করে তাদের অভিমত জানিয়েছেন; মুক্তির জন্য করণীয় নির্ধারণ করেছেন; কর্তৃপক্ষ বলছে নিজের মতো সমাধানের কথা। আমি বা আমরা যারা স্থায়ী জলাবদ্ধতার মধ্যে বসবাস করি, তারা কিন্তু রাজধানীর জলাবদ্ধতা দেখে আনন্দ পেয়েছি। দেশের বিত্তবানরা তো সাধারণ ছুটিতেও পরিবার-পরিজন নিয়ে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে অলস সময় কাটাতে চলে যায়। আমার ধারণা, সামর্থ্যহীনরা সেই জলাবদ্ধ পানিতে সাঁতার কেটে, বল খেলে, লাফালাফি করে আনন্দ পেয়েছে। শিশু-কিশোরদের খুশিমাখা মুখগুলো অনেককে আনন্দিত করেছে। যদিও খেলা শেষে বস্তিতে গিয়ে অনেকে দেখেছে তাদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম সম্বল ডুবে নষ্ট হয়েছে বা পানিতে ভেসে গেছে।
যশোরের দিকে তাকাই। কয়েক শতাব্দীপ্রাচীন এই জনপদে সরকারি-বেসরকারি জলাশয়গুলো প্রতিযোগিতামূলক ভরাট করে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়া চলমান। সরকার যেখানে নিজেই অবকাঠামো নির্মাণের জন্য জলাশয় ভরাট করে, সেখানে আইনে যা-ই থাক না কেন, তারা কি সাধারণ মানুষকে ব্যক্তিগত জলাশয় ভরাটে বাধা দেওয়ার কোনো অধিকার রাখে?
জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সম্পত্তির ভাগাভাগির ফলে দেশে অবকাঠামো অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এলাকার নদী-খাল নানাবিধ মানবসৃষ্ট কারণে আপন চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। বৃষ্টির পানি সরে যাওয়ার ন্যূনতম সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। জলাবদ্ধ মানুষ স্থানীয় সরকারের ওপর নিজেদের ভাগ্য ছেড়ে দিয়েছে বারবার। স্থানীয় সরকারও বিদেশি শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছে একাধিকবার। তবে প্রতিবারই কোনো প্রকার প্রাক-জরিপ ছাড়া প্রকৌশলী আর জনপ্রতিনিধিদের অনুপস্থিতিতে শুধু ঠিকাদারের ইচ্ছামতো ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে যশোরের জেলা প্রশাসনের দপ্তরের সামনের ড্রেনের কথা বলা যায়। ড্রেনের শুরুটা হয়েছে বিদ্যমান রাস্তা থেকে ২-২.৫ ফুট উঁচুতে। কেন এমন হলো, কেউ বলতে পারে না। এটা এক জায়গায় নয়। দেশের যেখানেই ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে সেখানেই একই দৃশ্য। ড্রেনের পানি কোথা থেকে কোথায় যাবে, তারও ঠিক-ঠিকানা পাওয়া যায় না।
এ বিষয়ে পৌরসভা নাগরিক সচেতনতার জ্ঞান দিলেও ড্রেন পরিষ্কারের নামে যা করে, তাতে কোনোভাবেই কাজের কাজ হয় বলে সাধারণ পৌরবাসীর মনে হয় না। তাই কর্তৃপক্ষের আশীর্বাদ এবং পৌরকরের বিপরীতে উপহার হিসেবে প্রদত্ত জলাবদ্ধতাকে গ্রহণ করাই একমাত্র উপায় বলে বিবেচনার দাবি রাখে।
জলাবদ্ধতার দুইটা রূপ– একটা স্থায়ী, অন্যটা অস্থায়ী। নাগরিকদের জন্য দুটোই বিভিন্ন সময়ে থাকা সরকারের উপহার। স্থায়ীটা কেন্দ্রীয় সরকারের; অস্থায়ীটা স্থানীয় সরকারের। আমাদের সরকারগুলো বিভিন্ন সময়ে জনকল্যাণের ব্রত নিয়ে প্রতি ইঞ্চি জমি আবাদ করতে গিয়ে দেশের জলাভূমি ধ্বংস করেছে। উজাড় করেছে বন। আগে গ্রামে গেলে একটা বাঁশঝাড় দেখা যেত; একটা ছনের মাঠ দেখা যেত; বিভিন্ন ফলের গাছ পাওয়া যেত। এখন জনকল্যাণে সেখানে আফ্রিকান মাগুর এসেছে; মেহগনি ও ইউক্যালিপটাস গাছ এসেছে। এসব করে সরকারি বাহবা পাওয়া গেছে ঠিক, কিন্তু পরিবেশের ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে, তার দায় সাধারণ মানুষকে বহন করতে হচ্ছে। জনদাবি পূরণের কথা বলে বিগত সরকারগুলো নদী সংস্কারের নামে সেচ সুবিধা বৃদ্ধি এবং পানি নিষ্কাশনে নদী খনন করেছে। তাতে নদী খালে পরিণত হয়েছে আর খালগুলো হয়েছে নালা। তার ওপর দখল-দূষণ তো আছেই। এতে পরিবেশের ওপর যে প্রভাব পড়ছে, তাতেই জলাবদ্ধতার বিস্তার ঘটছে এবং আজকের অস্থায়ী জলাবদ্ধতা আগামীতে স্থায়ী রূপ নিচ্ছে।
পানির স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করা না গেলে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি কখনোই আসবে না– নিশ্চিত। আমাদের পেশাজীবীরা রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতার কারণে ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষায় নিবেদিত হওয়ায় দেশে পেশা আজ দিশাহীন। ফলে প্রাণ-প্রকৃতিসহ সর্বক্ষেত্র দিশাহীন। রাজনীতি পেশাজীবীদের মুক্তি না দিলে জনগণ দিন দিন আরও এমন সব বিরূপ পরিবেশের মধ্যে পতিত হবে, তা আজকের বাংলাদেশ দেখে অনুমান করা যায়। তখন কল্পনাতেই জনপ্রতিনিধিদের অঙ্গীকারকৃত সিঙ্গাপুর, ভেনিস, প্যারিসে বসবাস করতে হবে; কক্সবাজার বা পটুয়াখালীর সমুদ্রসৈকত, সুনামগঞ্জ-নাটোর-কিশোরগঞ্জের হাওর-বাঁওড়-বিলের বাইরে প্রাকৃতিক জলাধার বলে কিছু থাকবে না।
এম আর খায়রুল উমাম: সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)
- বিষয় :
- নগরায়ণ