ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

দুর্যোগ

নদীভাঙনপীড়িত রৌমারীর হাহাকার উপদেষ্টারা শুনবেন?

নদীভাঙনপীড়িত রৌমারীর হাহাকার উপদেষ্টারা শুনবেন?

ছবি: সংগৃহীত

মহিউদ্দিন মহির

প্রকাশ: ৩১ অক্টোবর ২০২৪ | ০২:০৫

কুড়িগ্রাম জেলায় দারিদ্র্যের হার বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ বন্যা ও নদীভাঙন। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার রৌমারী উপজেলা রয়েছে চরম দরিদ্র জনপদের তালিকায়। প্রতিবছর একাধিকবার বন্যা দেখা দেয় এখানে। এ বছরেও কয়েক দফা বন্যা হয়ে গেল। বন্যা আক্রান্ত ও ভাঙনকবলিত মানুষের পক্ষে প্রতিবছর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয় না বলেই কুড়িগ্রাম জেলা দারিদ্র্যসীমা থেকে উঠতে পারে না। 

কুড়িগ্রামের প্রতিটি নদনদীই কমবেশি ভাঙনপ্রবণ। ভাঙনের তীব্রতা দেখা দেয় বন্যার পানি কমে যাওয়ার সময়। তবে শুষ্ক মৌসুম ছাড়া সারাবছর কমবেশি ভাঙতে থাকে। জেলা সদর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদ-বিচ্ছিন্ন রৌমারী বরাবরই অভাবী জনপদ। বন্যা ও ভাঙনে কৃষিজমি, ফসল, গবাদি পশু, ভিটেমাটি হারানো তাদের প্রতিবছরের দুঃখগাথা। বিশেষত নদীভাঙনে অন্যান্য সম্পদের সঙ্গে বসতিও হারাতে হয়। 

এ বছরও রৌমারী উপজেলার সুখেরবাতি, উত্তর খাউরিয়া, ঘুঘুমারী, চর ইটালুকান্দা, চর খেদাইমারীর প্রায় তিনশ মানুষের ভিটেমাটি, হাজার হাজার একর আবাদি জমি, পাঁচের অধিক শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান গেছে ব্রহ্মপুত্রের উদরে। রাস্তার ধারে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন যাপন করছে ভাঙনকবলিত এসব মানুষ। নদীতীরবর্তী বাড়ির বাসিন্দাদের কাটছে নির্ঘুম রাত– কখন যে ঘরবাড়ি নদীতে হারিয়ে যায়! 

ব্রহ্মপুত্রপাড়ের বাতাস এখন ভাঙনকবলিত মানুষের কান্নায় ভারি। টানা বর্ষণে খোলা আকাশের নিচে না করতে পারে রান্না, না থাকে মাথা গোঁজার ঠাঁই। প্রাকৃতিক ক্রিয়াদির ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়ায় সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত নারীরা। খোলা আকাশের নিচে প্রাকৃতিক কর্ম সারতে রাত নামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এতে বাড়ছে রোগ-ব্যাধি। নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হচ্ছে। নদীপাড়ের বাসিন্দা ছলেমন অন্যের বাড়িতে কাজ করে চরের মধ্যে দুই কাঠা জমি কিনে ঘর তুলেছিলেন। সেটাও এবার নদীর উদরে গেছে। তবু তাঁর দাবি একটাই- ত্রাণ নয়, নদীভাঙন থেকে পরিত্রাণ।

নদীভাঙনে বাস্তুচ্যুত মানুষের বেশির ভাগই এলাকা ছেড়ে যেতে চান না। অনেকেই সাত-আটবার ভাঙনের কবলে পড়ার পরও সড়কের ধারে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কোনো রকমে মাথা গুঁজে থেকে যান। কারণ তারা কৃষিকাজ, মাছ ধরা বা নৌকা চালানো ছাড়া আর কোনো কাজ জানেন না। 

বন্যায় যাদের খানিকটা ভিটেমাটি টিকে থাকে, সেখানে ফেরার পর তাদের হাতে না থাকে কাজ, না থাকে ঘরে খাবার। অনেক পরিবারকেই এক বা দু’বেলা খেয়ে টিকে থাকতে হয়। এবারের বন্যায় রৌমারীর ভাঙনকবলিত মানুষের কাছে একমুঠো খাবারও পৌঁছেনি। তাদের একজনকেও পুনর্বাসন করা হয়নি। যাদের খাবার জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয়, তারা নতুন করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করবে কীভাবে?

প্রতিবারের মতো এবারও বন্যা ও ভাঙনপরবর্তী সময়ে রৌমারীতে জীবন-জীবিকার সংকট আরও তীব্র হয়েছে। বর্ষাকালীন বন্যায় ফসল ডুবে যাওয়ার পর পানি নেমে গেলে আবারও ফসল রোপণ করা যায়। কিন্তু এ সময়ে আর তা সম্ভব নয়। এই শেষবেলার বন্যায় বাদাম, কলাই, ধানসহ যেসব ফসলের ক্ষতি হলো, তা অপূরণীয়। 

রৌমারীকে বাঁচাতে হলে নদীভাঙন প্রতিরোধের পাশাপাশি ঘরবাড়ি, জমিহারা মানুষের পুনর্বাসন প্রয়োজন। সরকারকে ভাঙনকবলিত মানুষদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে। এই অভাবী জনপদের বেশির ভাগ মানুষকে বছরের ছয় মাস দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কাজের সন্ধানে ছুটে বেড়াতে হয়। এলাকায় কর্মসংস্থান হলে তাদের ছিন্নমূল জীবনের অবসান ঘটবে।

রৌমারীতে নদীভাঙন প্রতিরোধে স্থায়ী সমাধানের দাবি দীর্ঘদিনের। কিন্তু বছর বছর ভাঙনকবলিত মানুষের হাহাকার কোনো সরকারকেই স্পর্শ করেনি। বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদে এমন কয়েকজন রয়েছেন, যারা দীর্ঘদিন নদী, পানিসম্পদ ও পরিবেশ বিষয়ে কাজ করে আসছেন। নদীতীরবর্তী জনগোষ্ঠীর হাহাকার এখন তারাও কি শুনবেন না?

২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের বাম তীর রক্ষার নামে সরকারিভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার ডিপিপি প্রণয়ন হলেও, তার সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রতিবছর ভাঙনের তালিকায় আসছে নতুন নতুন এলাকা। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের দায়িত্বরত ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে এ অঞ্চলের নিঃস্ব, অসহায় মানুষ বারবার লিখিতভাবে জানানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৪ অক্টোবর কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পরিবেশ, বন ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বরাবর স্মারকলিপি তারা পাঠিয়েছেন। 

দরিদ্র উপজেলা রৌমারী রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বহীন হলে সমানতালে রাষ্ট্র এগিয়ে যাবে না। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের যে আকাঙ্ক্ষা, তাতে বৈষম্য দূর হবে না।

মহিউদ্দিন মহির: সংগঠক

আরও পড়ুন

×