ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

স্মরণ

বিচারকের আত্মত্যাগ ও বৈষম্যহীন দেশ

বিচারকের আত্মত্যাগ ও বৈষম্যহীন দেশ

বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে ও সোহেল আহমেদ

মহসিনুল হক

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৪ | ০৩:০৭

প্রতিবছর ১৪ নভেম্বর এলেই আমাদের সহকর্মী বিচারক জগন্নাথ ও শহীদ সোহেলের কথা মনে পড়ে। ২০০৫ সালে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন আমাদের এ দুই সহকর্মী। 

আজ নতুন প্রজন্মের কাছে ‘জগন্নাথ-সোহেল’-এর স্মৃতি জানাতে চাই। আজ থেকে ১৯ বছর আগে ২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশের বিচারাঙ্গন থেকে ডুবিয়ে দেওয়া হয় দুই উজ্জ্বল নক্ষত্রকে। দেশবাসী সে সময় দেখেছিল বাংলাদেশের বিচারাঙ্গনের এক গভীর ক্রান্তিকাল। দুটি তরুণ তাজা প্রাণ সিনিয়র সহকারী জজ জগন্নাথ পাঁড়ে এবং সিনিয়র সহকারী জজ শহীদ সোহেল আহমেদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের কথা সেদিন মুহূর্তেই জেনেছিল বিশ্ববাসী।

১৮তম বিসিএস (বিচার) ক্যাডারে ১৯৯৮ সালের ২৪ জুন জগন্নাথ, সোহেলসহ আমরা ৯৯ জন সুপারিশকৃত সহকারী জজ দেশের বিভিন্ন জজশিপে যোগদান করেছিলাম। একই ব্যাচে চাকরির কারণে বিভিন্ন সময় একসঙ্গে ট্রেনিং করেছি আমরা। জগন্নাথ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র। সোহেল এসেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। জগন্নাথের জন্ম হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ১৭ ফ্রেব্রুয়ারি; বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার বঙ্গোপসাগরঘেঁষা পদ্মা গ্রামে। সোহেল জন্মেছিলেন ১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর ভোলা জেলায়। জীবদ্দশায় জগন্নাথের স্ত্রী রীতা এবং একমাত্র পুত্র শ্রেষ্ঠকে নিয়ে ছিল সুখের সংসার। সোহেলেরও স্ত্রী কান্তা এবং একমাত্র পুত্র ইফতিকে নিয়ে ছিল এক আনন্দময় জীবন। কে জানত, ২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর ঠিক সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে তাদের মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে হাজির হবে কোনো এক ঘাতক! 

আজ জগন্নাথ-সোহেলের মৃত্যু দিবসে বলতে চাই, বর্তমানে আমরা যে বাংলাদেশ দেখতে চাই, সেটি হবে আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ এক আবাসভূমি। কিন্তু এখনও দেখা যায় মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী লাখো শহীদ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে আত্মদানকারী হাজারের বেশি শহীদ তরুণের রক্তে ভেজা এই দেশের বিরুদ্ধে নানামুখী চক্রান্ত অব্যাহত। এসব চক্রান্ত রোধ করতে হলে আমাদের উদ্যোগী ও উদ্যমী তরুণ সমাজকে একটি স্বপ্নের বাংলাদেশ রেখে যাওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞা করতে হবে। কেমন হবে সেই স্বপ্নের দেশ? আমরা যখন পথ ধরে হাঁটব, দেখব প্রত্যেক মানুষ একে অপরের কল্যাণকামী। তারা পরস্পর অভিবাদন জানাচ্ছে। সবার মুখে হাসি। পরস্পরের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ নেই, ক্ষোভ নেই। কেউ কারও নিন্দা করছে না। রাজনীতিবিদরা ক্ষুদ্র স্বার্থে বিতর্কের বদলে পরিকল্পনা করছেন দুঃখী মানুষের দুঃখ দূর করার উপায় নিয়ে।

সেই বাংলাদেশে কোনো ধর্মবিদ্বেষ থাকবে না। বর্ণ বা সম্প্রদায় বা দল মানুষের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবে না। সেখানে সবাই বিশ্বাস করবে– আমরা একই জাতি। তাদের কেউ হবে কৃষক, কেউ শ্রমিক, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ চাকরিজীবী। একটি ক্রিকেট টিমে একেক খেলোয়াড় একেক ভূমিকা পালন করলেও সবার লক্ষ্য থাকে টিমকে জেতানো। তেমনি সমাজের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মানুষদের কাজ ভিন্ন হলেও জীবনের লক্ষ্য হবে অভিন্ন– একটি বাসযোগ্য, শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণ।
সেই বাংলাদেশের তরুণ সমাজ হবে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ। সেই বাংলাদেশের প্রতিটি নদীতে বয়ে চলবে বিশুদ্ধ পানির ধারা। সেই জলধারা এতটাই নির্মল, তাতে স্নান করলে শরীর ও মনের ক্লেদ দুই-ই বিদূরিত হবে। তার গতিপথে কেউ বাঁধ দেবে না। তার আশীর্বাদে উর্বর হবে এ দেশের মাটি। যেখানে স্বাস্থ্যবান কিষান-কিষানিরা ফলাবে সোনার ফসল। তাদের মুখে থাকবে মুক্তাঝরা হাসি। 

সেই বাংলাদেশে নতুন এক শিক্ষাব্যবস্থা প্রণীত হবে, যেখানে প্রত্যেকে ধর্মের সঠিক শিক্ষা ও নৈতিকতার দীক্ষায় দীক্ষিত হবে। এখান থেকে যেমন কোনো ধর্মান্ধের জন্ম হবে না; তেমনি দেখা যাবে না কোনো ধর্মবিদ্বেষীর। তারা হবে মানবতার কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ; দেশ ও জাতির সম্পদের রক্ষক, দেশপ্রেমিক, সৎ, আদর্শ নাগরিক। ১৪ নভেম্বর ‘জগন্নাথ-সোহেল’-এর শহীদ দিবসে আমরা প্রত্যাশা করি, ‘জগন্নাথ-সোহেল’ দেশবাসীর হৃদয়ে থাকবেন এবং ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে যুক্ত হয়ে থাকবেন তারা এবং আমাদের আগামীর বাংলাদেশ হবে সব রকম নিপীড়নমুক্ত, বৈষম্যহীন, আধুনিক, প্রগতিশীল মানবিক ‘বাংলাদেশ’। 

মহসিনুল হক: জেলা ও দায়রা জজ, চাঁদপুর

আরও পড়ুন

×