সাইফুল হত্যার বার্তা এবং ফাঁদে পা দেওয়ার আশঙ্কা

নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ। ছবি: সংগৃহীত
ইফতেখারুল ইসলাম
প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৪ | ১৭:৫২ | আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২৪ | ১৮:১৩
বুধবার চট্টগ্রাম আদালতে আইনজীবী সাইফুল ইসলামের হত্যাকাণ্ডে আমি বিস্মিত হয়েছি। আদালতের মতো জায়গায় কীভাবে এত নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ঘটে গেল! বিক্ষোভকালে চারপাশে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছিল। অথচ তাদের পাশেই এত বড় ঘটনা ঘটে গেল! সাইফুল চট্টগ্রাম কলেজে আমার সহপাঠী ছিল। আমার বন্ধুর এমন নিষ্ঠুর মৃত্যুর তীব্র নিন্দা জানাই।
গত ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ চট্টগ্রামে এক সমাবেশ করে। সেখানে বক্তৃতা রাখেন বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস। এ সময় তিনি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছেন এমন অভিযোগে ৩১ অক্টোবর সদ্য বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা ফিরোজ খান চট্টগ্রামে একটি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার ২৫ নভেম্বর ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ডিবি পুলিশ চিন্ময়কে আটক করে এবং আদালতে সোপর্দ করে। পরদিন শুনানিতে তাঁর জামিন নামঞ্জুর করে জেলে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে আদালত চত্বরে চিন্ময়পন্থিরা বিক্ষোভ করে। চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সভাপতি একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, বিক্ষোভকারীরা এক আইনজীবীকে চেম্বারের নিচ থেকে ধরে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে।
সাইফুলের হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে ষড়যন্ত্র থাকার আশঙ্কা অমূলক নয়। এখানেই দেশের সনাতন গোষ্ঠী, সর্বস্তরের জনগণ ও সরকারকে ভেবেচিন্তে পা ফেলতে হবে। কোনোভাবেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উস্কে দেওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, সনাতন ভাইয়েরা আমাদের মতোই এই মাটি ও মানুষ থেকে উদ্ভূত। তারা আমাদের ভাই ও বন্ধু। হিন্দু জনগোষ্ঠীরও একই অনুভূতি ও শ্রদ্ধাবোধ থাকা জরুরি। এটি ভুলে গেলে চলবে না, পতিত সরকারের দোসর ও ভারত রাজনৈতিক সুবিধা নিতে সনাতন জনগোষ্ঠীকেও বিপদে ফেলতে দ্বিধা করবে না। এটিই রাজনীতিতে স্বার্থের খেলা! এই খেলার ফাঁদ থেকে সনাতন জনগোষ্ঠীসহ সর্বস্তরের নাগরিকদের সতর্ক ও সাবধান থাকা দরকার।
বাংলাদেশের মানুষ সবসময় সম্প্রীতি ও সহাবস্থানে বিশ্বাসী। তারা দাঙ্গাহাঙ্গামাবিরোধী। কিন্তু কতিপয় ব্যক্তি রাজনৈতিক ফায়দা নিতে দেশের মানুষকে বিভাজিত করার চেষ্টা করে। ইতিহাসের পরতে পরতে আমরা সেটাই দেখেছি। এখনও দেশে উনিশ শতকের সেই হিন্দু-মুসলিম বর্গ দিয়ে রাজনৈতিকভাবে স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র চলে। যে কোনো মুহূর্তে এই পুরোনো খেলা কাজে লাগিয়ে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে। ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করে নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী। এখানেই গণতন্ত্রকামী মানুষের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে হিন্দু ও মুসলিম একই গ্রামে মিলেমিশে বাস করে। রাষ্ট্রীয়ভাবেও সমান সুযোগের স্বীকৃতি আছে। কিন্তু স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি জনগণের মধ্যে বৈষম্য ও বিভেদকে চাগিয়ে তোলে। এসব সামাজিক বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে এবারে দেশের সর্বস্তরের মানুষ নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ডাক দিয়েছে। এখানেই দেশের পরিবারতন্ত্র ও গোষ্ঠীতন্ত্র উপড়ে ফেলার নতুন এক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই স্বপ্ন সফল করতে হলে হিন্দু, মুসলিম সর্বস্তরের মানুষকে একই কাতারে শামিল হতে হবে। কোনো ধরনের পাতানো ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।
বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলিম ও অন্য ধর্মবলম্বীরা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। এই তো আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীরা রাত জেগে গ্রামে গ্রামে মন্দির পাহারা দিয়েছে। তাছাড়া ফ্যাসিস্ট সরকারবিরোধী লড়াইয়ে সর্বস্তরের ধর্মীয় গোষ্ঠী অংশগ্রহণ করেছিল। উল্লেখযোগ্য আরেকটি দিক হলো, ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীরা হিন্দু, খ্রিষ্টান, আদিবাসী ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে কমিটি গঠন করেছে। তরুণদের এই প্রচেষ্টাকে পুরোনো রাজনীতিবিদ ও পেশাজীবী শ্রেণির সাধুবাদ জানানো নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি কী তরুণদের জায়গা করে দেবে?
এই কাজ অতটা সহজ নয়। কারণ, চারপাশে ওত পেতে আছে নানা স্বার্থগোষ্ঠী। এখানেই তরুণদের সজাগ থাকতে হবে। এই লড়াইয়ে তারা দূরদর্শিতার প্রমাণ দিতে না পারলে দেশকে পরিবার ও গোষ্ঠীতন্ত্রের বলয় থেকে বের করে আনা সম্ভব নয়।
তরুণদের এখনকার লড়াই, সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে সংহতি জাগিয়ে তোলা। শুধু শিক্ষার্থী সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। নিম্ন আয়ের জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলতে হবে। গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে শহরের প্রত্যেক ছোট-বড় ব্যবসায়ী বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত। একজন ফল ব্যবসায়ী, মুদি দোকানি, দুধ বিক্রেতাও কোনো না কোনো সিন্ডিকেট ও শ্রেণিস্বার্থের সঙ্গে যুক্ত। তাই তরুণদের মাথায় রাখতে হবে, এসব শ্রেণিগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের আলাপ অত্যন্ত জরুরি। তাদের কাছে এটাই স্পষ্ট করতে হবে, কেন তারা পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নয়া বন্দোবস্তের লড়াইয়ে শামিল হবেন।
ইতোমধ্যে ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে ছয়জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ভাঙচুর ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে ২১ জনকে আটক করেছে। প্রধান উপদেষ্টা শিগগির তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো লিখিত বিবৃতি দিয়ে হত্যাকারীদের বিচারের দাবি তুলেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় হত্যার বিচার চেয়ে বেশ কয়েকটি সমাবেশও হয়েছে। আশা করছি, খুব শিগগির অপরাধীদের চিহ্নিত করে অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে।
ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, দৈনিক সমকাল
[email protected]
- বিষয় :
- আইনজীবীর মৃত্যু
- চট্টগ্রাম