পররাষ্ট্র নীতি
বাণিজ্য বন্ধের হুমকি দিয়ে লাভ নেই

হাসান মামুন
হাসান মামুন
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:১২ | আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:১৩
বাংলাদেশে সূচিত রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘিরে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের বড় অবনতি ঘটেছে, সন্দেহ নেই। এর প্রভাব দু’দেশের বাণিজ্যেও পড়েছে। হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই, ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু প্রভাব পড়েছিল বাণিজ্যে। মাঝে সেটা কেটেও যাচ্ছিল। হালে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি বেড়েছে বলেও খবরে প্রকাশ। ওখানেও আমরা প্রধানত রপ্তানি করছি তৈরি পোশাক। এর কাঁচামালের বড় অংশ আবার আসছে ভারত থেকে। এতই নিবিড় দু’দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক। তবে সম্প্রতি এতে নতুন করে চিড় ধরার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একেবারেই রাজনৈতিক ইস্যু ঘিরে। এরই মধ্যে কয়েকটি স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হওয়ার খবর উদ্বেগজনক।
দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে বলে ভারতের সঙ্গে স্থলপথেই আমাদের বাণিজ্য বেশি। রয়েছে ২২টি ঘোষিত স্থলবন্দর। কিছু শুল্ক স্টেশনও রয়েছে। সংকটের মধ্যেও সুখবর হলো, প্রধান স্থলবন্দর বেনাপোলসহ সিংহভাগই চালু আছে। সিলেট অঞ্চলের যেসব স্থলবন্দর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ভারতীয় অংশে বিক্ষোভের চাপে, সেগুলোও অচিরে চালু হবে বলে আমরা আশা করব। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ তো নয়ই, কমাতেও চাইছি না আমরা। ভারতের দিক থেকে সৃষ্ট উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতেও আমাদের অর্থ উপদেষ্টা যা বলেছেন, তার সারমর্ম হলো– যেখান থেকে সুবিধাজনক, সেখান থেকেই পণ্য আনা হবে। ভারত থেকে আমদানি সাধারণভাবে সুবিধাজনক– এটা কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই।
তার অর্থ অবশ্য এটা নয়, ভারত থেকে আমদানি না হলে আমরা সাক্ষাৎ বিপদে পড়ব। প্রায় সব পণ্যেই আমাদের জন্য বিকল্প উৎস রয়েছে। মাঝে ভারত থেকে কিছু কৃষিপণ্য আমদানি কঠিন ছিল তাদের বাণিজ্যিক বাধার কারণে। এটা যে কেবল বাংলাদেশের জন্য ছিল, তা নয়। এ অবস্থায় আমরা বরং কোটায় কিছু খাদ্যপণ্য আমদানি করতে চেয়েছিলাম। হালে দূরবর্তী দেশ, যেমন মিসর থেকেও আনা হয়েছে পেঁয়াজ। সম্প্রতি করাচি থেকে সরাসরি কনটেইনারবাহী জাহাজ এসেছে চট্টগ্রাম বন্দরে। তাতে বিভিন্ন শিল্প উপকরণের সঙ্গে এসেছে পেঁয়াজ ও আলু। পাকিস্তান থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চিনি আমদানির উদ্যোগের খবরও রয়েছে। আমরা কিন্তু আগে এসব পণ্য ভারত থেকেই বেশি আনতাম।
এ ক্ষেত্রে প্রধান প্রশ্ন হলো, দাম কেমন পড়ছে। সময়ের ব্যাপারও আছে বৈকি। বেশি দামেও আমদানি করতে হতে পারে, দ্রুত আনা জরুরি হলে। ভারত থেকে বেশি দামে আমদানিটাও অনেক সময় পুষিয়ে যায় পরিবহন ব্যয় কম বলে। জ্বালানি তেলের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ার সময়ে জাহাজ ভাড়া বেড়ে গিয়েছিল। তাই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাণিজ্য নতুন গুরুত্ব পেয়েছিল। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভাষাগত এবং অল্প করে আমদানির সুবিধাও আছে। এগুলো গোপন ব্যাপারও নয়। সে জন্যও আমরা বিশেষ করে চাই, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যটা স্বাভাবিকভাবে চলুক। ভারতেরও এটা না চাওয়ার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। সারা দুনিয়ায় এটি সম্ভবত সপ্তম বৃহত্তম বাজার তার। কোনো দেশ কি চায় তার বাজার হারাতে? সেখানে তার হিস্যা কমুক, এটাও
চাইবার কথা নয়।
অথচ ভারতের ভেতর থেকে ‘রপ্তানি বন্ধ’ করার আওয়াজ জোরেশোরে তোলা হচ্ছে। তবে এটা হচ্ছে মূলত পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায়, বিজেপির ভেতর থেকে। বিচিত্র নামে বিজেপির কিছু স্থানীয় সংগঠন হট্টগোল করেছে কয়েকটি স্থলবন্দর এলাকায় এসে। সামনে এ জাতীয় আরও সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে তারা। ত্রিপুরার বিজেপিদলীয় মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধের কথা ভাবছে। নিজেকে ‘কমিটেড ক্যাপিটালিস্ট’ দাবি করা এ ব্যক্তি বলেছেন, ভারত ছাড়া বাংলাদেশ টিকতে পারবে না! এসব কথা যে কত সারবস্তুহীন, সেটা আমরা জানি। চার-পাঁচ দশক আগের বাংলাদেশ যে আর নেই– সেটা সম্ভবত তারাও জানেন। তবু স্থানীয় রাজনৈতিক বিবেচনা থেকেই হয়তো এসব বলছেন। কোনো বৃহৎ কৌশলের অংশ হিসেবেও স্রেফ উত্তেজনা জিইয়ে রাখার জন্য এসব করা হয়ে থাকতে পারে। ভালো যে, বাংলাদেশের দিক থেকে একই ভাষায় জবাব দেওয়া হচ্ছে না। তার কোনো প্রয়োজনও নেই।
ভারত থেকে পণ্যসামগ্রী প্রধানত আসে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার মতো সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর বাইরে থেকে। রপ্তানিকারক সে রাজ্যগুলোয় কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ নিয়ে কোনো শোরগোল নেই। কেন্দ্রীয় সরকারও এমন কিছু ভাবছে বলে এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তারা হয়তো বরং কিছুটা চিন্তিত পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধির প্রবণতা দেখে। ভারত ভিসা প্রায় বন্ধ করে দেওয়ায় শীতের এ সময়টায় বাংলাদেশ থেকে ভারতের বাইরে বেড়াতে যাওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। কোনো কোনো দেশ এ পরিস্থিতি লুফে নিতেও চাইছে। এ অবস্থায় ‘অভ্যন্তরীণ পর্যটন’ও বাড়বে। তাতে দেশের টাকা থাকবে দেশেই। ভারত মেডিকেল ভিসা দিতেও গড়িমসি করায় এ দেশের মানুষের মনে সেটা তৈরি করতে পারে গভীর ক্ষত। এতে আবার বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবসায় আসতে পারে নতুন গতি। বাংলাদেশি সেবাপ্রত্যাশীদের না পাওয়ায় কলকাতাসহ ভারতের বিভিন্ন শহরে সংশ্লিষ্ট ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবরও কম মিলছে না। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা সরকারের বরং এসব দিকে বেশি করে দৃষ্টি দিয়ে উত্তেজনা প্রশমনে ভূমিকা রাখা দরকার।
একসময় ভারত ছিল আমাদের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার। কালক্রমে চীন সে জায়গা দখল করে নিয়েছে। চীনের সঙ্গে ভারতেরও বিরাট বাণিজ্যিক সম্পর্ক। ভারত-চীনের রাজনৈতিক সম্পর্ক আবার উল্লেখযোগ্য খারাপ। তাদের মধ্যে সীমান্ত-সংঘাতও মাঝে মাঝে ঘটে থাকে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এতটা খারাপ হয়নি কখনও। আর পরিস্থিতি তেমন দিকে মোড় নেবে না বলেই আশা করি। বাংলাদেশের দিক থেকে অন্তত তেমন কোনো উস্কানি নেই। এখানে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে, সেটা এ দেশের নিজস্ব ব্যাপার। ব্যাপক মানুষের ইচ্ছাতেই এখানে নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি স্বেচ্ছাচারী সরকারের পতন ঘটেছে। দেশটি রয়েছে উত্তরণকালীন পরিস্থিতিতে। এ অবস্থায় বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাড়তি ঝামেলায় জড়ানোর কোনো প্রয়োজন তার নেই। বাংলাদেশ স্বভাবতই চাইবে ভারতসহ বাণিজ্যিক ও উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে। অর্থনীতিকে স্বাভাবিক ধারায় ফেরানোর চ্যালেঞ্জও তার সামনে রয়েছে। রপ্তানি খাত সচল রাখা এবং পণ্যবাজারে দাম সহনীয় করে আনার চেষ্টা তাকে করতে হচ্ছে অবিরত। এ অবস্থায় ভারত বাণিজ্যে অনিচ্ছুক হলে বাংলাদেশকে অগত্যা বিকল্পের সন্ধান করতে হবে। সেটা ভারতীয় পক্ষেরও নিশ্চয় জানা।
বাণিজ্য বন্ধের হুমকি দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে কাবু করা যাবে বলে মনে হয় না। তার পেছনে রয়েছে সিংহভাগ রাজনৈতিক দল ও বেশির ভাগ মানুষের সমর্থন। অচিরেই এখানে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে বলেও সবার আশা। বাংলাদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন পরিস্থিতিও এমন নয় যে, ভারত অসহযোগিতা করলেই দেশটি খাদ্যাভাবে পড়বে। তার অসহযোগিতার মুখে বরং বিশেষ বিশেষ পণ্য উৎপাদনে নতুন জোয়ার আসার সম্ভাবনা রয়েছে। যেমনটা দেখা গেছে গোসম্পদের বেলায়। আমদানির ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য বিকল্পও কম নেই। আমদানি সক্ষমতাও বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমাদের বদনামও নেই।
হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট
- বিষয় :
- পরারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়