সাদা কালো
জাতীয় ঐক্যে সংখ্যালঘুদের শামিল করার সহজ পথ

সাইফুর রহমান তপন
সাইফুর রহমান তপন
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৫:২৫
সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার ঘটনায় গত আড়াই মাসে ৮৮ মামলায় ৭০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মঙ্গলবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ তথ্য জানান। খবরটি নিঃসন্দেহে স্বস্তিদায়ক। কারণ এতে অন্তত এটা স্পষ্ট হয়– ৫ আগস্ট-পরবর্তী সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ সম্পর্কে সরকার ‘ডিনায়াল’ অবস্থানে নেই।
বস্তুত গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এ ইস্যুতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে জনগণ তো বটেই, এমনকি সরকারি পর্যায়েও যে বাগ্যুদ্ধ চলেছে, তাতে মূল বিষয়টিই হারাতে বসেছিল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল, নির্যাতিতদেরই বলতে হবে– তাদের কেউ নির্যাতন করেনি। নইলে তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এ প্রসঙ্গে ২৮ নভেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা’র কয়েক ব্যক্তির দেওয়া বিবৃতির কথা বলা যায়। সেখানে পরামর্শ ছিল– ‘বাংলাদেশের হিন্দু জনসমাজ’ যাতে ‘বিবেকবান ও দায়িত্বশীল নাগরিকের ভূমিকা পালন’ করে।
প্রেস সচিবের এ ভাষ্যও স্বস্তিকর, ওই গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা গত ৫ আগস্ট থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ঘটনার ভিত্তিতে করা মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত। পরের ঘটনাগুলোর তথ্য সংগ্রহও চলছে এবং ‘ন্যক্কারজনক এসব ঘটনায় জড়িতদের ছাড় দেওয়া হবে না’ (সমকাল, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪)।
আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রেস সচিব জানিয়েছেন, ৮৮টি মামলার মধ্যে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মামলা হয়েছে ৬২টি এবং এসব মামলায় গ্রেপ্তার ৩৫ জন। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ১৯ সেপ্টেম্বর হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে দেশে গত ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত ২ হাজার ১০টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বলে জানায়। সরেজমিন পরিদর্শনের মাধ্যমে তৈরি করা হলেও, সরকারপক্ষের কেউ কেউ প্রতিবেদনকে ‘বিভ্রান্তিকর’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
এতদিন অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এও বলা হচ্ছিল, ৫ আগস্ট-পরবর্তী সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে কয়টি ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর কারণ আক্রান্তদের ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা। এ ক্ষেত্রেও সচেতন মহলে স্বস্তি জুগিয়ে সরকার অবস্থান পরিবর্তন করেছে বলে মনে হচ্ছে। প্রেস সচিব একই প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, আক্রান্তের রাজনৈতিক পরিচয় তাদের কাছে ‘মুখ্য’ নয়। ‘ক্রাইম হলেই আমরা এগুলো সিরিয়াসলি নিচ্ছি’ (সমকাল, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪)।
দেশে বহুদিন ধরে একটা কথা বিশেষত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চালু আছে– সন্ত্রাসী সন্ত্রাসীই। তার যেমন কোনো দল নেই; আক্রান্তেরও কোনো দল নেই। দুর্ভাগ্যবশত, অতীতের সরকারগুলো বহু ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক এ নীতি মেনে চলেনি। সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় অন্তর্বর্তী সরকার এ মনোভাব নিয়ে এগোলে নিঃসন্দেহে তা হবে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
অবশ্য, মামলা বা গ্রেপ্তারের ঘটনাই সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীর জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে না। বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই, শুধু ২০২১ সালে দুর্গাপূজার সময় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবের কথা স্মরণ করুন। কুমিল্লা শহরে রাতের গভীরে পূজামণ্ডপে ‘ধর্ম অবমাননা’ ঘটার অভিযোগ তুলে শুধু কুমিল্লাতেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর কথিত তৌহিদি জনতা হামলে পড়েনি; নোয়াখালী, রংপুরসহ অন্তত ২১ জেলায় তা ছড়িয়ে পড়ে। এসব হামলায় সনাতন ধর্মের বহু মানুষের বসতবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ধ্বংসের পাশাপাশি একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তখনও বহু মামলা হয়; অনেকে গ্রেপ্তারও হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটা মামলারও সুরাহা হয়নি। এমনকি সনাতন ধর্মের মণ্ডপে গিয়ে নিজ ধর্মের অবমাননার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নকারী ওই তরুণকে ‘মানসিক রোগী’ আখ্যা দিয়ে নিষ্কৃতির আয়োজন করা হয়।
শুধু ২০২১ কেন; বলতে গেলে গত ৫৩ বছর ধরেই হিন্দুদের পাশাপাশি অন্য ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা অসংখ্য হামলার শিকার হয়েছেন। কোনোটারই নিষ্পত্তি হয়নি। বরং ভুক্তভোগীদের মনে ক্ষোভ জাগিয়ে সংশ্লিষ্ট সরকার হয় সেগুলো অস্বীকার করেছে, নয় নিছক আশ্বাসবাণী শুনিয়েই দায়িত্ব সেরেছে। সত্য, এ দীর্ঘ সময়ে সব ধরনের রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় ছিল। তাদের দায় বর্তমান সরকারের নেওয়ার কারণ নেই। কিন্তু অন্তত গত ১৫ বছরের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার তদন্ত ও বিচার তো হতে পারে।
অনেকেই অভিযোগ করেন, গত ১৫ বছরে একটাও সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনার বিচার না হওয়ার কারণ এই যে, আওয়ামী লীগ সরকার কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের করতে চায়নি। এখন তো সে সরকার নেই। কোনো ফৌজদারি মামলা তামাদিও হয় না। তাহলে কেন ২০১৪, ২০১৮ বা ২০২১ সালের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিচার হচ্ছে না?
২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর যে ভয়ংকর অত্যাচার করা হয়েছিল, সেগুলো বিগত আওয়ামী লীগ সরকার তদন্ত করেছিল। কিন্তু ওই তদন্তই শেষ। না প্রতিবেদনটি তারা প্রকাশ করেছে, না কোনো বিচার হয়েছে। এতে অনেকেই বেশ রহস্য খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু এখন কি সেই রহস্য ফাঁস করে দেওয়ার উপযুক্ত সময় নয়?
তা করলে কিন্তু এই যে স্বাধীনতার পর এই প্রথমবারের মতো সনাতন ধর্মের লোকেরা সেক্যুলার মহলে বিস্ময় জাগিয়ে রীতিমতো তাদের ধর্মগুরুদের নেতৃত্বে আট দফা দাবিতে রাজপথে নামলেন, তা নাও ঘটতে পারত। আর সরকারকেও এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তনের পথ রচনা– তা প্রমাণের কসরত করতে হতো না। সংখ্যালঘুরা যে দল বেঁধে আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়, তাও হয়তো তখন ঠেকানো যেত।
শুধু তা কেন? যে শত্রু সম্পত্তি বা অর্পিত সম্পত্তি আইনের বলি হয়ে বিপুলসংখ্যক হিন্দু এমনকি চৌদ্দপুরুষের ভিটে হারিয়েছেন, তা বাতিল করে আওয়ামী লীগ সেই ২০০০ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন করে। কথা ছিল, এ আইনের মাধ্যমে ইতোপূর্বে দখলকৃত সব হিন্দু সম্পত্তি ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে দলটি দেড় দশক কাটালেও আইনের জায়গায় আইন রয়ে গেছে; বেদখল সম্পত্তির সিংহভাগ প্রকৃত মালিকের কাছে ফেরত যায়নি। দলটির সমালোচকরা প্রায়ই ২০০০ সালে প্রকাশিত অধ্যাপক আবুল বারকাতের একটা গবেষণাগ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে বলে থাকেন, অর্পিত সম্পত্তির বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর দখলে আছে। এখন সে সম্পত্তিগুলো প্রকৃত মালিকদের ফেরত দেওয়া কি কঠিন কাজ?
কাজগুলো করলে শুধু হিন্দু নয়, সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কেই জাতীয় ঐক্যে শামিল করা সহজ হবে– সরকার তা নিশ্চয় জানে। একই সঙ্গে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বৃহৎ প্রতিবেশীর নাক গলানোরও সুযোগ যে কমবে– সেটাও অজানা নয়। সরকার এ ইতিবাচক পথে হাঁটবে, না পুরোনো রাজনৈতিক ছকেই এগোবে– সেটাই এখন দেখার বিষয়।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
- বিষয় :
- জাতীয় ঐক্য