তাঁর চেতনায় মানুষ ও তারুণ্যের শক্তি

স্যার ফজলে হাসান আবেদ: ২৭ এপ্রিল ১৯৩৬–২০ ডিসেম্বর ২০১৯
রাব্বী আহমেদ ও সারা আফরীন
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:১৫
স্বাধীনতার প্রথম পাঁচ বছর অভ্যন্তরীণ সম্পদের ঘাটতি, বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরতাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল বাংলাদেশ। ১৯৭৩ সালে ইউএনআরওডি ত্রাণ কর্মসূচি বন্ধ করলে অর্থনৈতিক সংকট প্রকটতর হয়। খাদ্য ঘাটতি, মুদ্রাস্ফীতি, পণ্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে যোগ হয় আকস্মিক বন্যা। ১৯৭৪ সালে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। এ সংকট মোকাবিলায় যারা এগিয়ে আসেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ।
১৯৭১-এ আবেদ কাজ করতেন শেল অয়েলের হেড অব ফিন্যান্স পদে। এপ্রিলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলে যান লন্ডন। বন্ধু ও সহকর্মীদের সঙ্গে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘হেল্প বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের গণহত্যা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তুলে ধরা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের তহবিল সংগ্রহে নেতৃত্ব দেন।
১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে দেশে ফিরতে শুরু করে ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় এক কোটি শরণার্থী। ইউএনএইচসিআরের সূত্রমতে, এ সময় প্রায় ৬০ লাখ শরণার্থী ফিরে আসে, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রত্যাবাসন কর্মসূচি। দেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি শরণার্থীদের পুনর্বাসনও তখন রাষ্ট্রের মূল এজেন্ডা।
১৯৭২-এর ১৭ জানুয়ারি দেশে ফেরেন আবেদ। বন্ধু ভিকার চৌধুরীর চিঠিতে শাল্লা সম্পর্কে জেনেছিলেন: হিন্দুপ্রধান এ অঞ্চলে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। দেশে ফিরে কাজ শুরু করতে প্রয়োজন টাকা। ক্যামডেন হাউসে ফ্ল্যাটের শেয়ার বিক্রি করেন ৮ হাজার পাউন্ডে। ফেলে আসেন শেকসপিয়র ও বার্নাড শর বই ছাড়া আর সব।
বিধ্বস্ত দেশ; মানুষের মনে স্বজন হারানোর ক্ষত। আবেদের মেন্টর ও ছোট চাচা রাজনীতিক, সংস্কৃতিসেবী সায়ীদুল হাসানকেও নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। ফেব্রুয়ারিতে সিদ্ধান্ত নেন নিজে শাল্লার পরিস্থিতি দেখবেন। ঢাকা থেকে সরাসরি যাওয়ার উপায় নেই। প্রথমে দিরাই, তারপর ১৭ মাইল হেঁটে শাল্লা। দীর্ঘ ও কষ্টকর এই যাত্রায় আবেদের সঙ্গী হন ডাক্তার মনোরঞ্জন, গুণেন্দু, রামানন্দ, গীষ্পতিসহ স্থানীয় কিছু তরুণ। এদের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা। শাল্লায় পৌঁছে গভীর রাত অবধি স্থানীয়দের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা; শরণার্থীদের পুনর্বাসন কাজে তরুণদের সহযোগিতা চাই।
ওই রাতে এক দোকানের মাচায় ঘুমিয়েছিলেন ৩৬ বছরের আবেদ; প্রচণ্ড ঝড়ে ভিজে একাকার। তাঁর জীবনে দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন আনে এ অভিজ্ঞতা। শুধু অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রির টাকা আর ‘হেল্প বাংলাদেশ’-এর অবশিষ্ট ২৫ হাজার রুপি দিয়ে এ ক্ষয়ক্ষতি সামলানো সম্ভব নয়। দরকার আরও সুচারু পরিকল্পনা, বড় অঙ্কের তহবিল। ক্ষয়ক্ষতি ও প্রয়োজন বুঝতে শাল্লায় জরিপের সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
নোট বই ও কলম হাতে ঘুরে ঘুরে তরুণরা সংগ্রহ করে তথ্য। জরিপের প্রোফর্মা তৈরি করেছিলেন নিজেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের কিছু শিক্ষক ও শিক্ষার্থী তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেন।
শুরুতে ‘ত্রাণ সংঘ’ নামে পুনর্বাসন কাজ পরিচালিত হলেও আবেদ তার নাম পাল্টে রাখেন– ‘বাংলাদেশ পুনর্বাসন সহায়ক কমিটি’, সংক্ষেপে ব্র্যাক। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো জরুরি হয়ে পড়লে আবেদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কবি সুফিয়া কামাল সম্মত হন পরিচালনা পর্ষদের প্রথম চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নিতে। সদস্য হন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকও। ৯৫, মতিঝিলে ভিকারের ল চেম্বার হলো ব্র্যাকের অস্থায়ী অফিস। দেশ পুনর্গঠনে আগ্রহী, উদ্যমী তরুণদের কাছে ব্র্যাক হয়ে ওঠে জুতসই প্ল্যাটফর্ম।
সে সময় বাংলাদেশের সংকটে অক্সফাম চাচ্ছিল বড় অঙ্কের তহবিল দিতে। কিন্তু সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় চাচ্ছিল বড় কোনো প্রতিষ্ঠানকে তহবিল দিতে। ‘ভিশন আছে এমন বাংলাদেশি তরুণদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ’ করতে চাচ্ছিলেন অক্সফামের এ অঞ্চলের ফিল্ড ডিরেক্টর রেমন্ড কুনোয়ার। শাল্লার জরিপের ভিত্তিতে অক্সফামে খসড়া পরিকল্পনা জমা দেন আবেদ। পছন্দ করেন রেমন্ড ও অক্সফামের ওভারসিস এইড ডিরেক্টর কেন বেনেথ। অক্সফাম থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজার ডলারের অনুদান পায় ব্র্যাক। তহবিল পেয়ে শাল্লাতে বড় প্রজেক্টের পরিকল্পনা করেন আবেদ। প্রায় ৯ মাস প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ের কাজ চলে। আসাম রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কম দামে বাঁশ কিনে কুশিয়ারা নদী দিয়ে ভাসিয়ে আনা হয়। ২০০ টন করোগেটেড আয়রন শিট দেয় সরকার।
পেশায় অ্যাকাউন্ট্যান্ট হলেও আবেদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমাজবিজ্ঞানীর। অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে গোটা জনগোষ্ঠীকে ভাগ করেন চারটি ভাগে। শুরুতে ৬ হাজার ৫০০ ঘর তৈরির লক্ষ্য থাকলেও ১০ হাজার ২০০টি ঘর বানায় ব্র্যাক। বাড়ি মেরামতে ৩ হাজার ৯০০ পরিবারকে দেওয়া হয় বাঁশ ও টিন। ১৪ হাজার ১০০ পরিবারকে সাহায্য করার পরও বাঁচে ১৬ হাজার ৫০০ পাউন্ড। অক্সফামকে তা ফেরতের প্রস্তাবও দেন। সংস্থাটি তাঁকে প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু করতে বলে। শাল্লা হয়ে ওঠে ব্র্যাকের ‘লার্নিং ল্যাবরেটরি’।
শুরু থেকেই ব্র্যাককে ‘লার্নিং অর্গানাইজেশন’ হিসেবে গড়ে তুলছিলেন। শুধু ত্রাণ দিয়ে স্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব নয়– এই উপলব্ধি থেকে গুরুত্ব দেন দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্পে। ব্র্যাকের নাম পাল্টে রাখেন ‘বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি’।
শাল্লায় কৃষি, মাছ চাষ, ব্যবহারিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, কারিগরি প্রশিক্ষণ, কমিউনিটি সেন্টার ডেভেলপমেন্টে (গণকেন্দ্র) কাজ করে ব্র্যাক। ‘গণকেন্দ্র’ হয় গ্রাম উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। জাল ও সুতা কেনার টাকা দেওয়া হয় জেলেদের। তখনও বাংলাদেশে ‘ক্ষুদ্র অর্থায়ন’ ধারণার প্রচলন না থাকলেও এর মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিকভাবে ব্র্যাকে এর শুরু।
উন্নয়ন ক্ষেত্রে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান ফজলে হাসান আবেদ। ‘কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট’ দিয়ে শুরু করলেও পরে চলে যান ‘কনসিয়েনটাইজেশন’ অ্যাপ্রোচে। ভূমিহীনদের সামনে রেখে করেন কর্মসূচির পরিকল্পনা। ‘কনসিয়েনটাইজেশন’ ধারণাটি ব্রাজিলের শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরি থেকে নিলেও দক্ষিণের উন্নয়ন ধারণার সঙ্গে মিলিয়ে দেন নতুন রূপ। ধারণাটি ছিল– দরিদ্র ও শোষিত মানুষ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিতে এমনভাবে সংগঠিত হবে, যাতে ব্র্যাকের ওপর নির্ভরতা কমে যায়।
শাল্লার পর রৌমারী ও জামালপুর; চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের পর রৌমারীতে অক্সফামের কার্যক্রম ব্যর্থ হলে সংস্থাটির ফিল্ড ডিরেক্টর কোল ডজ ব্র্যাককে সেটি পরিচালনার অনুরোধ করেন। শিশুমৃত্যু ঠেকাতে শূন্য থেকে ১৫ বছর বয়সী ৩৫ হাজার ছেলেমেয়ের জন্য দুই বেলা খিচুড়ি পরিবেশন কর্মসূচি নেয় তারা। অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের জন্য গড়ে তোলেন পুষ্টিকেন্দ্র। চুয়াত্তরের বন্যায় খাদ্য সংকটে পড়ে জামালপুর। ইউনিসেফের অনুরোধে ভিক্ষাজীবী ৮৪০ নারীকে নিয়ে ব্যবহারিক শিক্ষা কর্মসূচি চালু করে ব্র্যাক।
ফজলে হাসান আবেদ অনুভব করেন, দারিদ্র্য ও অসাম্যের কারণগুলো জটিল; পরস্পর নিবিড়ভাবে জড়িত। এর সমাধানও হতে হবে বহুমাত্রিক। ফলে শাল্লা, রৌমারী এবং জামালপুরের শিক্ষা থেকে গ্রহণ করেন উন্নয়নের সমন্বিত প্রকল্প। মানিকগঞ্জকে নির্বাচন করেন কার্যক্ষেত্র হিসেবে। স্থানীয়দের যুক্ত করেন আয়বর্ধক কাজে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি খাতের পাশাপাশি নারীর হস্তশিল্প দক্ষতাকে বাজারে যুক্ত করতে শুরু হয় ‘আড়ং’ ও ‘আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন’। অনেক কর্মসূচি ও সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজের শুরু হওয়ায় মানিকগঞ্জ ব্র্যাকের ‘আঁতুড়ঘর’ বা ‘টেস্টিং গ্রাউন্ড’ নামে পরিচিত।
রৌমারী ও জামালপুরের অভিজ্ঞতা থেকে নারীর শক্তি উপলব্ধি করেন আবেদ। চ্যালেঞ্জের মধ্যেও শিশুর খাবার নিশ্চিত করতে অটল ছিলেন রৌমারীর নারীরা। অন্যদিকে উন্নয়নের প্রথাগত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেন জামালপুরের নারীরা। সমাজের উন্নয়নে নারীর নেতৃত্ব অপরিহার্য– এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে ব্র্যাকের সব কাজে নারীকেই কেন্দ্রে রাখেন আবেদ। উন্নয়ন বোঝাপড়া ও মূল্যায়নে প্রতিষ্ঠা করেন নিজস্ব রিসার্চ ইউনিট। পরবর্তী সময়ে ‘রিসার্চ অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন ডিভিশন’-রেড।
স্বাধীনতা-পরবর্তী টালমাটাল সময়ে দেশ পুনর্গঠনে দৃঢ় ভূমিকা রাখেন ফজলে হাসান আবেদ। তারুণ্যের বিপুল শক্তি ও সম্ভাবনা তিনি ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে মোকাবিলা করেছিলেন রাষ্ট্রের বিবিধ সমস্যা। তাঁর এ উন্নয়ন ধারণা ‘দক্ষিণ গোলার্ধের উন্নয়ন মডেল’ হিসেবে স্বীকৃত। তিনি প্রমাণ করেছেন– সংকট যত গভীরই হোক; ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ও সুদূরপ্রসারী ভিশনের মাধ্যমে তা ডিঙানো সম্ভব। তাঁর দেখানো পথ হতে পারে আগামী বিনির্মাণের পাথেয়।
২০২৪ সালের ২০ ডিসেম্বর স্যার ফজলে হাসান আবেদের প্রয়াণের পঞ্চম বছর। তাঁর অমর-অক্ষয় স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা।
রাব্বী আহমেদ: কনটেন্ট কো-অর্ডিনেটর, স্যার ফজলে হাসান আবেদ নলেজ হাব, কমিউনিকেশন্স, ব্র্যাক; সারা আফরীন: হেড অব ব্র্যান্ড অ্যান্ড প্রোগ্রাম কমিউনিকেশন্স, ব্র্যাক
- বিষয় :
- তারুণ্য