আইন শৃঙ্খলা বাহিনী
পোশাকের চেয়ে মানসিকতা পরিবর্তন জরুরি

অনি আতিকুর রহমান
অনি আতিকুর রহমান
প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৫ | ০০:৩২ | আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৫ | ২১:৩৯
পুলিশ, র্যাব ও আনসারের নতুন পোশাকের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তিন বাহিনীর ইউনিফর্ম বদল নিয়ে সরকারের যুক্তি– বাহিনীগুলোকে ঢেলে সাজাতে প্রতীকী এই পরিবর্তন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেছেন, বাহিনীর সদস্যদের মন-মানসিকতা পরিবর্তন করা জরুরি। সে লক্ষ্যে পোশাক পরিবর্তন করা হচ্ছে। শুধু পোশাক নয়; বাহিনীকে জনবান্ধব করতে প্রশিক্ষণেও পরিবর্তন আনতে চায় সরকার। পুলিশের নতুন পোশাক হচ্ছে আয়রন বা লোহার রঙের; র্যাবের অলিভ বা জলপাই এবং আনসারের পোশাক হচ্ছে গোল্ডেন হুইট বা সোনালি গমের রঙের।
বলাবাহুল্য, এই তিন বাহিনীর মধ্যে জনগণের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে পুলিশ। পুলিশের পোশাক পরিবর্তন নিয়ে দাবি ওঠে মূলত জুলাই-আগস্টে বাহিনীটির বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে। ওই আন্দোলনে দুই হাজারের অধিক ছাত্র-জনতা শহীদ হয়। আহত হয় ২০ হাজারের বেশি মানুষ। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী গোষ্ঠীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার এই লড়াইয়ে স্বাভাবিকভাবেই সরকারের পক্ষ নিতে হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন বাহিনী পুলিশকে। ফলে লড়াইয়ে জয়ী ছাত্র-জনতা পুলিশকে পরাজিত শক্তির দোসর হিসেবেই ভাবতে শুরু করে। ফলস্বরূপ ৫ আগস্টের পর প্রায় এক সপ্তাহ কোনো পুলিশ সদস্যকে মাঠে দেখা যায়নি। থানাগুলোয় ঘুঘু চরেছে। কিন্তু এই এক সপ্তাহে জনগণও ভাবতে বাধ্য হয়েছে– একটি পুলিশবিহীন রাষ্ট্র কতটা অনিরাপদ। তা ছাড়া একটি বাহিনীর সব সদস্য তো আর খারাপ হতে পারে না। ফলে জনগণ ফ্যাসিস্ট আমলের চিহ্নিত সুবিধাভোগী অফিসার ছাড়া অন্যদের বিষয়ে সহজ করে ভাবতে থাকে। সরকারের পক্ষ থেকেও পুলিশ বাহিনীকে কাজে ফেরানোর চেষ্টা শুরু হয়। তখন বাহিনীর ভেতর থেকেই অনেকে আপত্তি জানায়– ছাত্র-জনতার রক্তে রঞ্জিত পোশাকে কাজ করতে তারা চান না। এতে সরকার ও জনগণেরও সায় মেলে। অন্তর্বর্তী সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, পুলিশের মনোবল ফেরাতে তাদের পোশাক ও লোগো পরিবর্তন করা হবে।
সেই সময় তিনি বলেন, ‘অনেকের মন ভেঙে গেছে। এই ইউনিফর্ম পরে পুলিশ আর কাজ করতে চাইছে না। খুব দ্রুতই পরিবর্তন করা হবে। এসব বিষয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পুলিশ কমিশন হওয়া উচিত। সেই কমিশনের অধীনে পুলিশ পরিচালিত হবে। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের অধীনে থাকবে না। পুলিশকে যেন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার না করা হয়– সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’
অবশেষে সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। নতুন পোশাক নিয়ে ফ্যাশন সচেতন বা সৌন্দর্সপিপাসুদের নানা অভিমত থাকতে পারে। কিন্তু সচেতন নাগরিকের দৃষ্টি অন্যখানে। তারা মনে করেন, পোশাকের রং বা ডিজাইন যা-ই হোক, বাহিনীর গুণগত পরিবর্তন যেন নিশ্চিত হয়। বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে ওঠা বিগত সময়ের অভিযোগ যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।
রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় গেলে পুলিশকে লাঠিয়াল বাহিনী ভাবতে শুরু করে। বিরোধী দলে থাকলে প্রতিপক্ষ ভাবে। এই দুই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পুলিশকে রাষ্ট্রের জননিরাপত্তায় কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে জনগণের উচিত সঠিক তথ্য প্রদান ও আইনশৃঙ্খলা নীতি মেনে পুলিশকে সহায়তা করা।
পুলিশে অতিউৎসাহী কিছু সদস্য থাকে। তারা বিভিন্ন সময় আন্দোলন দমাতে কমান্ডের বাইরে গিয়ে অপেশাদার আচরণ করে। এসব সদস্যকে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ রাষ্ট্রের বাহিনী। তারা কোনো ব্যক্তির শিষ্য বা দলের কর্মী নয়– এটি তাদের মাথায় রেখে পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। ঔপনিবেশিক খাজনা আদায়ের লাঠিয়াল বাহিনী থেকে আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের সেবকের ভূমিকায় পুলিশকে সামনে থেকে কাজ করতে হবে। পুলিশে এখন উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়ে যোগ দিচ্ছে। এসব তরুণ নিজেরাও পরিবর্তনের সারথি। নতুন একটি পুলিশ বাহিনী গড়তে এই তরুণ তুর্কিরা বড় শক্তি হতে পারে।
ফ্যাসিবাদের পতনের পর দেশে অন্তত এক সপ্তাহ পুলিশ ছিল না। তখন আমরা টের পেয়েছি, নগরবাসীর এক পশলা ঘুম নিশ্চিত করার পেছনে পুলিশ কত পরিশ্রম। তবে এটিও প্রমাণিত হয়েছে– ওই সময়ের মধ্যে মানুষ যা কল্পনা করেছিল, তার চেয়ে অনেক কম দুর্ঘটনা ঘটেছে। ফলে এই বাংলাদেশ নিয়ে হতাশাবাদীরা যতই হতাশা প্রকাশ করুক, আমরা এখনও আশা ছাড়তে চাই না। বাংলাদেশ জিতবেই। সে জয়ে জনগণের সবচেয়ে কাছের বাহিনী হিসেবে পুলিশ সম্মুখসারির যোদ্ধারূপে ভূমিকা রাখবে। তাই বলতে চাই– পোশাকের রং যেমন হোক, কর্ম হোক ভালো। একই কথা আমরা বলতে চাই র্যাব ও আনসার বাহিনীর ক্ষেত্রেও।
অনি আতিকুর রহমান: সহসম্পাদক, সমকাল
[email protected]