ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতির ‘নতুন বন্দোবস্ত’ কতটা সম্ভব?

শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতির ‘নতুন বন্দোবস্ত’ কতটা সম্ভব?

মাহফুজুর রহমান মানিক

মাহফুজুর রহমান মানিক

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০০:১২

লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতির পরিবর্তে ছাত্রদের কল্যাণে গঠনমূলক সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির প্রত্যাশা দীর্ঘদিনের। জুলাই-আগস্টে ছাত্রদের আন্দোলনে সেটি আরও জোরালোভাবে সামনে আসে। গণঅভ্যুত্থানের পর এটি বলা চলে, শিক্ষার্থীদের প্রধান দাবি হয়ে উঠেছে। বস্তুত, জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে প্রায় সব ছাত্র সংগঠন অংশ নেয়। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছাত্র রাজনীতির দখল ও সন্ত্রাসবাদের পুরোনো ধারা পরিবর্তনে স্বাভাবিকভাবেই জনআকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। ফলে সবাই ভেবেছে, বিদ্যমান ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ঐক্য তৈরি হবে; সবাই সহাবস্থানের রাজনীতি করবে এবং লেজুড়বৃত্তির পথ পরিহার করবে। কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে, সেই প্রত্যাশা তত ক্ষীণ হয়েছে। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-কুয়েটের ১৮ ফেব্রুয়ারির এক ঘটনাই শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতির অনেক হিসাব পাল্টে দিয়েছে। 

কুয়েটের ঘটনার পর থেকে ছাত্র সংগঠনগুলোর ঐক্যে কেবল ফাটল ধরাই নয়, বরং পরস্পরকে প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করে নানাভাবে ঘায়েল করার প্রতিযোগিতাও যেন শুরু হয়ে গেছে। ছাত্রদলের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রশিবিরের দূরত্ব এতটাই বেড়েছে, যার মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে গত দেড় দশকের সন্ত্রাসবাদের চেহারা ফিরে আসার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আগে ক্যাম্পাসে দেখা যেত হেলমেট বাহিনী। ছাত্রদের আন্দোলনের সময় মধ্য-জুলাইয়েও দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সহযোগী এই হেলমেট বাহিনী কীভাবে ছাত্রছাত্রীদের ওপর চড়াও হয়। মেয়েদের রক্তাক্ত চেহারা সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তোলে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ হয় ছাত্রলীগ।    

কুয়েটের ঘটনার ভয়াবহ দিক হলো, প্রকাশ্যে অস্ত্রের ব্যবহার। সেদিন ছাত্রদল নেতাকর্মীর সংঘর্ষের সময় ধারালো অস্ত্র হাতে অবস্থান নেন খুলনার দৌলতপুর থানা যুবদলের সহসভাপতি মাহবুবুর রহমান। তাঁকে অবশ্য সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আবার শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে কুয়েটে ছাত্র রাজনীতিও বন্ধ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তার পরও শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ থামছে না। খুলনা থেকে রোববার সেখানকার ৮০ জন শিক্ষার্থী ঢাকায় এসেছেন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করতে। তারা বলছেন, ক্যাম্পাসে এখনও নিরাপদ বোধ করছেন না। কারণ তাদের দাবি পূরণ হয়নি; শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কুয়েটের ঘটনার পর ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব ভালোভাবেই সামনে আসে। ছাত্রদলের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রশিবিরের সংঘাত কেবল কুয়েটেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধীরা পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ ও সমাবেশ করে। 
কুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। ছাত্রদল এই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রশিবির এর পক্ষে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন করে যে ছাত্র সংগঠন গঠন করতে যাচ্ছে, সেখানে তারা ছাত্র রাজনীতির কাঠামো পরিবর্তনের কথা বলছে। সেটা কেমন হবে? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও নতুন ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের সম্ভাব্য নেতা আব্দুল কাদের সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, ‘শিক্ষার্থীরা আবাসিক এরিয়া এবং একাডেমিক এরিয়ায় কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং রাজনৈতিক কাঠামো চায় না। শিক্ষার্থীদের এই কনসার্নকে প্রায়োরিটি দিয়েই আমাদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সাজানো হবে।’ তিনি বলেছেন, ছাত্রাবাস ও শিক্ষার্থীদের হলে রাজনীতি ফিরে গেলে আবারও দাসত্বের ‘কালচার’ ফিরে আসবে।

নতুন বন্দোবস্তের এ ছাত্র রাজনীতি কিংবা সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতি চালু করার জন্য ছাত্র সংগঠনগুলোর সদিচ্ছা ও ঐক্য জরুরি। ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্রশিবিরসহ প্রতিটি ছাত্র সংগঠনকেই এটা অনুভব করতে হবে যে, প্রত্যেকের মূল চরিত্র ছাত্র এবং ছাত্রদের জন্যই তারা দল করছে। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদের অধিকার ক্ষুণ্ন হলে সেখানে তারা অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারের সঙ্গে তারা দেনদরবার করবে। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের নিয়ে কোনো আয়োজনে প্রশাসনকে ছাত্র সংগঠনগুলো সহায়তা করবে। পাশাপাশি দেশের স্বার্থেও তাদের কর্মসূচি থাকবে। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র সংগঠনগুলোর পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়া ও সহাবস্থান থাকবে। এর বাইরে লেজুড়বৃত্তি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, হল দখল, শিক্ষার্থী নির্যাতন, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি ছাত্র সংগঠনের কাজ হতে পারে না। গত দেড় দশকে ছাত্রলীগ এ ধরনের অপরাধের কারণেই সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ হয়েছে। নতুন করে সেই রাজনীতি শিক্ষাঙ্গনে কেউই দেখতে চায় না।   
সুস্থ ধারার রাজনীতি চালু করার জন্য জরুরি হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্র সংসদ চালু করা। ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেক দিন ধরেই আলাপ চলছে। কিন্তু সেখানেও এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি সমকালের প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি খবর– ছাত্র সংসদ নির্বাচন ছাত্রদলে ‘আটকা’। ছাত্রদল সংস্কারের কথা বলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনের যে ধরনের জোর তৎপরতা দরকার, সেটাও অনুপস্থিত। 

অবশ্য সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। অভ্যুত্থান- পরবর্তী শিক্ষাঙ্গনে নতুন পরিবেশ দেখা যাচ্ছে, যেখানে হলগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। হল প্রশাসন তাদের নীতি অনুসারে শিক্ষার্থীদের আসন বরাদ্দ দিচ্ছে। এই ব্যবস্থাপনা অবশ্যই টিকিয়ে রাখতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার হওয়ার কারণে কোনো ছাত্র সংগঠন সেখানে নাক গলাতে পারছে না। কিন্তু ভয় হলো, রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে তাদের ছাত্র সংগঠন পুনরায় লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি শুরু করে কিনা। এ ক্ষেত্রে বলার বিষয় হলো, সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ছাত্র সংগঠনগুলোকে বুঝতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও এটি অনুধাবন করতে হবে। পাশাপাশি ছাত্র সংসদ এখনই সক্রিয় করে শিক্ষার্থীদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার মাধ্যমেও লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতির পথ বন্ধ হতে পারে।

মাহফুজুর রহমান মানিক: 
জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
[email protected]

আরও পড়ুন

×