উল্টোরথ
সিনেমা বন্ধ, পর্যটক হেনস্তা ও শাকিলের ‘আত্মহত্যা’

এহ্সান মাহমুদ
এহ্সান মাহমুদ
প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২৫ | ০০:২৪ | আপডেট: ১৩ জুন ২০২৫ | ০০:২৫
ঈদের ছুটিতে যখন সবকিছু বন্ধ, তখন খবর পেলাম, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়েছে। ঘটনার পর কাছারিবাড়িতে দর্শনার্থীদের প্রবেশ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এইবার ঈদুল আজহার ছুটি চলাকালে ঘটেছে এমন আরও তিনটি ঘটনা।
প্রথম চিত্র: টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে নিরাপত্তার অভাবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী বন্ধ করা হয়েছে। সেখানে ঈদের দিন থেকে ‘তাণ্ডব’ সিনেমা দেখানো হচ্ছিল। পারকি ইউনিয়ন ওলামা পরিষদের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল থেকে চলচ্চিত্র প্রদর্শন বন্ধের দাবি জানানো হয়। আন্দোলনকারীদের একজন মাওলানা আবদুল্লাহ বলেন, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানে ক্ষতি হতে পারে। এ ছাড়া অসামাজিক কার্যকলাপ হতে পারে। সেই জন্য হলটিতে সিনেমা প্রদর্শন বন্ধে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন (সমকাল অনলাইন)।
দ্বিতীয় চিত্র: সিলেটের সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার উৎমাছড়া এলাকায় পর্যটকদের হেনস্তার ঘটনা ঘটেছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা যুব জমিয়তের সহসভাপতি মুফতি রুহুল আমিন সিরাজী দলীয় কর্মীদের নিয়ে সেখানে যান। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘উৎমাছড়া কোনো পর্যটন কেন্দ্র নয়। কেউ ছবি আপলোড করবেন না।’ আরেকজনকে বলতে শোনা যায়, ‘এলাকার মুরব্বিরা বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছি– এখানে যাতে কেউ না আসেন। আমরা সম্মানের সঙ্গে বলছি– আপনারা এখানে আসবেন না।’ এ বিষয়ে রুহুল আমিন সিরাজী বলেন, ‘কিছু মানুষ এখানে মদপান ও অশ্লীল কার্যক্রম করছেন। এতে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। স্থানীয় আলেম-ওলামা ও মুরব্বি-যুবকদের নিয়ে ঈদের আগে বৈঠক করে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী তারা উৎমাছড়ায় পর্যটক যেতে নিরুৎসাহিত করছেন।’ তবে এখন উপজেলা যুব জমিয়ত বলছে, উৎমাছড়ায় তারা শুধু ধর্মের ‘দাওয়াত’ দিতে গিয়েছিলেন।
তৃতীয় চিত্র: মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদ (২৪) আত্মহত্যা করেছেন। শাকিলের স্বজন জানিয়েছেন, ফেসবুকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে এক ব্যক্তির পোস্টে মন্তব্য করেছিলেন শাকিল। পরে সেটি ঘিরে স্থানীয় কিছু লোক তাঁকে হুমকি দেন। বাড়িতে গিয়েও বিভিন্নজন তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে ভয়ভীতি দেখান। এ পরিস্থিতির কারণেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
আত্মহত্যার আগে ফেসবুকে চারটি পোস্ট দিয়েছিলেন শাকিল। সর্বশেষ পোস্টে তিনি লেখেন, ‘আমি নাস্তিক নই, গ্রামের সবাই আমাকে নাস্তিক বলছে। আমি জানি আর আমার আল্লাহ জানে, আমি নবী মুহাম্মদকে কোনো কটূক্তি করিনি। আমাকে নিয়ে আমার বাবা অনেক গর্ব করত, গ্রামের সবাই আমাকে অনেক সম্মান করত। আজ আমি আমার নিজের আপন মানুষের কাছে আমার সম্মান হারিয়েছি। আগামীকাল আমার বাবাকে সবাই গালি দিবে, আমার মাকে সবাই অসম্মান করবে, এই লজ্জা আমি কখনও সহ্য করতে পারব না। একটা ছেলে হয়ে নিজের বাবা-মায়ের মানসম্মান আমি এভাবে নষ্ট করে দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে পারব না। কোনো দিন আমি গ্রামে মাথা তুলে চলতে পারব না। আত্মহত্যা মহাপাপ– আমি জানি। আমি অনেক পাপ করেছি, আজ আর একটা শেষ পাপের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।’
দক্ষিণ জামশা গ্রামসহ আশপাশের গ্রামের কয়েকশ লোক শাকিলদের বাড়ি গিয়ে পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন হুমকি দেন। এর পর রাত ২টার দিকে বাড়িতে নিজ ঘরের ভেতর ফাঁস নিয়ে শাকিল আত্মহত্যা করেন। দক্ষিণ জামশা গ্রামের নাসিরউদ্দিন আহমেদের ছেলে শাকিল। কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। থাকতেন মুহসীন হলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন শাকিল। বড় দুই ভাই দেশের বাইরে থাকেন। ভাইদের মধ্যে শুধু তিনিই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। তাঁর ভাইয়ের স্ত্রী রিনা বেগম বলেন, ‘শাকিলের চিরবিদায়ে পুরো পরিবার শোকস্তব্ধ। আমরা এখন আর কিছু বলতে চাই না। আমরা তো আর তাকে ফেরত পাব না! তাকে হারিয়ে আমাদের পরিবারের সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমার শ্বশুর শাকিলকে নিয়ে খুব গর্ব করতেন– ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তিনি এখন পাগলের মতো হয়ে গেছেন। শুধু বলছেন, আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম। বিচার একমাত্র আল্লাহই করবেন। মানুষের কাছে আমার কোনো বিচার নাই’ (ডয়চে ভেলে, ১১ জুন ২০২৫)।
কিছুদিন ধরে আলাপ শুনছি– ‘হিন্দু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ রচিত গান আমাদের জাতীয় সংগীত হতে পারে না। কারা এই আলাপ করছেন, সেটা বুঝতে সহায়ক হতে পারে ওপরের তিনটি ঘটনা। প্রতিটি ঘটনায় এটাও স্পষ্ট হয়েছে– মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের তৎপরতার ঘাটতি রয়েছে। দেশের সর্বত্র যে কোনো ভিন্নমতের ওপর অনায়াসে হামলা হচ্ছে, মাজারে হামলা হচ্ছে, নারী নিপীড়ন হচ্ছে, ভিন্ন জাতিসত্তার ওপর নিপীড়ন হচ্ছে। পরিতাপের বিষয়, এসব সংঘবদ্ধ সহিংসতার বিরুদ্ধে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা এবং বিচারহীনতার পুনরাবৃত্তি ঘটনাগুলো প্রেক্ষাপট তৈরি করছে।
বাংলাদেশ বহু জাতি-ধর্ম-বর্ণের এক ভূখণ্ড। এখানে বহু মত ও পথের মানুষ একত্র হয়ে বহু বছর ধরে বসবাস করে আসছে। এখানকার মানুষ উগ্র পন্থাকে কোনোদিন গ্রহণ করেনি। এখানে ঋতুবৈচিত্র্য ও বহমান নদীর স্বভাবের মতো মানুষও সরল ও স্বতঃস্ফূর্ত। তাই এখানে কোনো একক মত, একক পথ কখনও মানুষের এগিয়ে যাওয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। মানুষের বিপক্ষে গিয়ে এখানে পরাক্রমশালী শাসক টিকতে পারেননি। যার সর্বশেষ নজির আমরা দেখেছি জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে। তাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা ছিল– কোনো উগ্র পন্থাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, সরকার এমন কোনো গোষ্ঠীর কাছে নতজানু হয়ে পড়ছে। সরকারকে দ্রুত এই অবস্থা থেকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে।
এহ্সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক,
সমকাল; কথাসাহিত্যিক