উল্টোরথ
লন্ডন বৈঠকের কতটা সুফল মিলবে

এহ্সান মাহমুদ
এহ্সান মাহমুদ
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫ | ০০:৪৬ | আপডেট: ২০ জুন ২০২৫ | ০০:৪৬
যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্প্রতি (১৩ জুন ২০২৫) একটি বৈঠক হয়েছে। বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, তাদের মধ্যে একান্তে এই বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে উভয় পক্ষের (সরকার ও বিএনপি) প্রতিনিধিরা যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছেন।
এই বৈঠক থেকে ঘোষণা আসে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সত্যিকার অর্থেই এ ঘোষণার পর থেকে জাতীয় নির্বাচনের সময় নিয়ে রাজনৈতিক অস্বস্তি কাটতে শুরু করেছে। এর আগে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত এপ্রিল থেকে এগিয়ে ফেব্রুয়ারির প্রথম ভাগে নির্বাচনের সময় নির্ধারণে একমত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপি। তবে এই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচার বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
বিএনপি চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন দাবি করে আসছিল। জামায়াতে ইসলামী রোজার আগে নির্বাচন হলে ভালো হয় বলে মত দিয়েছিল। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) চাচ্ছিল সংস্কার ও বিচার শেষ করে নির্বাচন। এ অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টা ঈদের আগে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। বিএনপি এ নিয়ে প্রকাশ্যে অসন্তোষ জানায়। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির এক ধরনের টানাপোড়েন শুরু হয়। লন্ডনে বৈঠক-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে দু’পক্ষই বলেছে, তারা ‘সন্তুষ্ট’। তবে ‘এই ঘোষণা লন্ডনে হওয়ায় এবং একটি দলের সঙ্গে কথা বলে নির্বাচনের সময় এগিয়ে আনা’র খবরে অসন্তোষ জানিয়েছে জামায়াত ও এনসিপি (সমকাল অনলাইন, ১৩ জুন ২০২৫)।
সবার চোখ এখন লন্ডন বৈঠকের ফলাফলের দিকে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বৈঠককে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ বলে মন্তব্য করেছেন। পাশাপাশি বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, লন্ডন বৈঠক একটি দলের পছন্দ হয়নি। কোন দল– সেটা সরাসরি না বললেও বোঝা গেল, ইঙ্গিত জামায়াতের দিকে।
লন্ডন বৈঠকে কী পাওয়া গেল– এমন প্রশ্নের সোজা জবাব হতে পারে, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ঘোষণা। নির্বাচিত সরকার নিয়ে জনগণের যে চাহিদা তৈরি হয়েছিল, বিপরীতে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে যে অনিশ্চয়তা দেখা গিয়েছিল, তাতে এই ঘোষণায় জনগণের কথা চিন্তা করে কোনো বিভাজনে না গিয়ে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ঘোষণা এসেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, এই ঘোষণা অনেকের পছন্দ হয়নি। যাদের পছন্দ হয়নি, তাদের কেউ কেউ সংস্কারের কথা বলছেন। তাদের প্রস্তাবিত সংস্কারের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে, এসব সংস্কার প্রস্তাবের অধিকাংশই আনা হয়েছে নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে। এ ছাড়া নিজেদের অসামর্থ্যকে আড়াল করতেও কিছু সংস্কার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যেমন– প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব এমন দল দিয়েছে, যাদের এখন পর্যন্ত দেশব্যাপী সাংগঠনিক কাঠামোই দাঁড়ায়নি। এমন দলের পক্ষে আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করা কোনো মিরাকল না ঘটে গেলে আপাত অসম্ভব। তাই মনে হতে পারে, নির্বাচন হলেই তাদের বিপদ। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, যেহেতু নির্বাচন নেই, তাই তাদের অনেক গুরুত্ব।
এ কথা সত্যি, প্রফেসর ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যকার লন্ডন বৈঠকের পর বাংলাদেশের রাজনীতির চিত্রনাট্য অনেকখানি বদলে গেছে। ঐতিহাসিক ৫ আগস্টের পর আলোচনায় সামনে আসা দীর্ঘদিন গোপনে কার্যক্রম চালানো রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামী বিক্ষুব্ধ। এই দলের নেতাদের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, তারা হতাশ। জামায়াতে ইসলামীর ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ কী? এতদিন তো জনশ্রুতি ছিল, জামায়াতই সরকারের চালিকাশক্তি। সরকারের নীতিকৌশল নির্ধারণে দলটির ভূমিকা ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এসবের পরও জামায়াতের কেন সরকারের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক বা সমঝোতা পছন্দ না? দলটি বলছে, বর্তমান সরকার নাকি নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। বাস্তব অবস্থা কি তাই? মাত্র এক পক্ষকাল আগে যেখানে বিএনপিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো বিদেশের মাটিতে– বাংলাদেশের অর্ধশতাধিক দলের মধ্যে শুধু একটি দল (বিএনপি) নির্বাচন চাইছে।
জামায়াত নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তৃতা আর কৌশল দেখে বোঝা যায়, এটিই জামায়াতের রাজনীতির চিরাচরিত ভুল। দলটি বরাবরই ভুল করে এবং অতীত থেকে শিক্ষা নেয় না। একসময়ের মিত্র বিএনপিকে এখন তারা শত্রুর কাফেলা হিসেবে চিহ্নিত করছে। এই জামায়াতের জন্য বিএনপিকে গত ১৫ বছরে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। জামায়াত নেতাদের গাড়িতে পতাকা তুলে দেওয়া ছিল বাংলাদেশি রাজনীতির অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট। এটি নিয়ে অন্তহীন সমালোচনার মুখে পড়েছিল বিএনপি। এখনও সমালোচকের ছুরি দলটিকে বিদ্ধ করে চলেছে।
দেখা যাচ্ছে, লন্ডন বৈঠক বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতোমধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। যেহেতু এটি দু’জনের একান্ত বৈঠক ছিল, তাই বৈঠকের সব খবর জানা যায়নি। তবে নির্বাচন আয়োজনে ঐকমত্যের পাশপাশি দেশি-বিদেশি নানা শক্তি এবং ভূরাজনীতির কৌশল এখানে আলোচিত হয়েছিল, ধারণা করা যায়। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রোডম্যাপের জন্যও বৈঠকটি জরুরি ছিল।
তবে লন্ডন বৈঠকেই বাংলাদেশি রাজনীতির সবকিছুর ফয়সালা হয়ে গেছে– এটা ভাবার কারণ নেই। আমরা অতীতের কথা স্মরণ করতে পারি। অতীতের মতো যে কোনো সময় যে কোনো পক্ষ চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ করতে পারে। তবে এই লন্ডন বৈঠকে একটি বিষয় স্পষ্ট– ৫ আগস্ট ২০২৪ ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচার তকমা পাওয়া আওয়ামী লীগের ফিরে আসার পথ আপাতত বন্ধ।
লন্ডন বৈঠকটি যেহেতু সরকারের সঙ্গে বিএনপির হয়েছে, তাই দলটি অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখে চলবে বলে আশা করা যায়। সরকার এবং বিএনপি উভয় পক্ষই অবিশ্বাস তৈরি হয়, আপাতত এমন কিছুতে জড়াবে না, সে আশাও করা যায়। সরকার যদি নির্বাচন নিয়ে তাদের কথা না রাখে তাহলে আরও শক্তিশালী আন্দোলন করার জন্য বিএনপির হাতে সময় থাকবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ গ্রহণ বিষয়ে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের নেতৃত্বে চলমান বিক্ষোভ কীভাবে মীমাংসার দিকে যায়, সেটি দেখেও একটি বার্তা পাওয়া যাবে।
আমরা প্রায়ই বলে থাকি– অবিশ্বাস করে ঠকার চেয়ে বিশ্বাস করে ঠকা শ্রেয়। লন্ডন বৈঠকের পর বাংলাদেশের রাজনীতি দিয়ে চিরায়ত এই বুলিকে আরেকবার যাচাই করার সুযোগ সবাই পেয়েছি। আমরা অপেক্ষা করছি।
এহ্সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক,
সমকাল; কথাসাহিত্যিক