যশোর-৬ ও বগুড়া-১ আসনে জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে চায় আ.লীগ

ফাইল ছবি
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২০ | ০৮:০০
যশোর-৬ (কেশবপুর) ও বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) আসনের উপনির্বাচনে জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে চায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। আগামী ১৪ জুলাই অনুষ্ঠেয় এই দু’টি উপনির্বাচনেই দলীয় প্রার্থীকে জয়ী করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টাই চালাবে দলটি। তবে রোববার নির্বাচনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বি বিএনপি দলীয় ফোরামের এক বৈঠকের পর করোনা পরিস্থিতিতে কার্যত উপনির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আওয়ামী লীগ অনেকটাই নির্ভার মনে করছে নিজেদের।
অন্যদিকে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দু’টি আসনের নির্বাচনেই ভোটার উপস্থিতি তুলনামূলক কম হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে সবমহল থেকেই। আবার দেশের কয়েকটি জেলার মতো বগুড়াও বন্যার প্রকোপে পড়ার কারণে বগুড়া-১ আসনের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আরও কমে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় দু’টি আসনের উপনির্বাচন জনমনে ঠিক কতটা আগ্রহ সৃষ্টি করবে- সেটা নিয়েও নানা জল্পনা কল্পনা ছড়িয়ে পড়েছে।
গত ২৮ জানুয়ারি সাবেক জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ইসমাত আরা সাদেকের মৃত্যুতে যশোর-৬ আসনটি শূন্য হয়। একই দলের সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান ১৮ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করলে বগুড়া-১ আসনটি শূন্য হয়। গত ২৯ মার্চ এই দু’টি উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করে তফসিল ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে করোনার কারণে ভোটের সপ্তাহখানেক আগে স্থগিত করা হয় ওই দু’টি নির্বাচন। গত শনিবার নির্বাচন কমিশন থেকে আগামী ১৪ জুলাই একসঙ্গে দু’টি আসনের উপনির্বাচনের নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। দু’টি উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংবিধান নির্ধারিত ১৮০ দিন ১৫ জুলাই শেষ হতে যাচ্ছে। ফলে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই করোনার মধ্যেই দু’টি আসনে ভোটগ্রহণের আয়োজন করতে হচ্ছে বলে ইসি’র দাবি।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, এই দু’টি আসনই আগে থেকেই আওয়ামী লীগের দখলে। গত তিন মেয়াদেই এখান থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরাই জয়ী হয়ে আসছেন। উপনির্বাচনের দুই দলীয় প্রার্থী যশোর-৬ আসনের জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার এবং বগুড়া-৬ আসনের প্রয়াত এমপি আব্দুল মান্নানের স্ত্রী ও সারিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাহাদারা মান্নান- উভয়েই যথেষ্ঠ জনপ্রিয় ও শক্তিশালী প্রার্থী। ফলে এই দু’জনের বিজয়ের ব্যাপারে মোটেই সন্দিহান নয় দলটি। এরপরও এই উপনির্বাচনকে হালকা করে দেখা হচ্ছে না। দলীয় দুই প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতেই করোনা সংকটের মধ্যেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে সম্ভব সব ধরনের প্রচেষ্টা চালানো হবে।
তারা আরও বলেছেন, নতুন করে ঘোষিত নির্বাচনের তারিখ অনুযায়ী প্রচার-প্রচারণা চালানোর জন্য সময়ও খুব কম পাওয়া যাবে। মাত্র এক সপ্তাহের মত সময় পাওয়া যাচ্ছে। এই সময়ের মধ্যেই কতদূর কী করা যায়- সেটাও ভেবে দেখা হবে। আজকালের মধ্যে এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে কেন্দ্রীয় কোনো কোনো নেতাকে এই নির্বাচনী কার্যক্রম সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক সমকালকে বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে এই মুহূর্তে অন্যসব নির্বাচনের অতটা সক্রিয়ভাবে হয়তো বা প্রচার কার্যক্রম চালানো সম্ভব হবে না। এরপরও নির্বাচন কমিশন যেহেতু নির্বাচন করছে, সেহেতু আওয়ামী লীগও যতদূর সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ভোটের মাঠে থাকবে। স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করতে কেন্দ্র থেকেও সম্ভাব্য সব রকমের তৎপরতা চালানো হবে।
এ দিকে, রোববার বিকেলে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে যশোর-৬ ও বগুড়া-১ আসনের উপনির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে মত গ্রহণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সন্ধ্যায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, দেশে করোনাভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পরিবেশ নেই বলেই তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
যশোর-৬: করোনা পরিস্থিতিতেও জমে উঠেছে উপনির্বাচন
কেশবপুর (যশোর) প্রতিনিধি জানান, যশোর-৬ (কেশবপুর) আসনের স্থগিত উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণায় নড়েচড়ে বসেছেন দলীয় নেতাকর্মী ও ভোটাররা। মাত্র ১০ দিন সময় হাতে নিয়ে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করায় সময় নষ্ট না করে মাঠে নেমে পড়েছেন প্রার্থীরাও। করোনা পরিস্থিতিতে কেশবপুরের মানুষ প্রায় সাড়ে ৫ মাস এমপি শূন্য অবস্থায় অভিবাবকহীন থাকায় নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়েছেন তারাও। তবে অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভোটগ্রহণ আয়োজনের দাবি তুলেছেন।
১৪ জুলাই অনুষ্ঠেয় এই আসনের উপনির্বাচনে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবুল হোসেন আজাদ ধানের শিষের প্রার্থী হয়েছেন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হাবিবুর রহমান লাঙ্গল প্রতিকে লড়ছেন। এই তিন প্রার্থীই আগে থেকেই ভোটযুদ্ধে ছিলেন। নতুন করে স্থগিত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের প্রার্থী শাহীন চাকলাদার রোববার সকালেই নেতাকর্মীদের নিয়ে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাওয়া শুরু করেছেন। এ দিন সকালে বিদ্যানন্দকাটি ইউনিয়নের ভান্ডারখোলা-তেঘরী এলাকা এবং বিকেলে মজিদপুর ইউনিয়নের বাগদা-মজিদপুর এলাকায় গণসংযোগ করেন তিনি। অন্যদিকে বিএনপি প্রার্থী আবুল হোসেন আজাদ ঢাকা থেকে রোববার বিকেলে কেশবপুর পৌঁছে দলীয় কার্যালয়ে নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। জাপা প্রার্থীও মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
পাশাপাশি সুশীল সমাজ ও ব্যবসায়ী নেতারা নির্বাচন নিয়ে উৎসাহব্যঞ্জক আলোচনায় মুখরিত রয়েছেন। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী নেতারা শনিবার সকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে কেশবপুর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করলেও এর বিপক্ষে সমালোচনাও হয়েছে। তবে ওইদিন বিকেলেই স্থগিত উপনির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর চায়ের দোকানের আলোচনায় এবং নির্বানে গতি বেড়েছে।
কেশবপুরের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ওয়ার্ডের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আকমল আলী বলেন, করোনা সংকটে এলাকার মানুষের পাশে কোন প্রার্থী ছিলেন আর কারা ছিলেন না- সেটা ভোটাররাও নিবিড়ভাবে দেখেছেন। তাই করোনাকালীন পরিস্থিতি ভোটারদের যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ে সহায়তা করবে। হাতে অল্প সময় থাকলেও ভোট দেওয়ার জন্য প্রার্থী বাছাইয়ে ভোটারদের বেগ পেতে হবে না।
তবে মজিদপুর গ্রামের গৃহবধূ রেখা বেগম বলেন, বেঁচে থাকলে বহুবার ভোট দিতে পারবো। তাই ভোট কেন্দ্র ও বুথের সংখ্যা না বাড়ালে ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়া যাবে কি-না ভেবে দেখতে হবে।
যশোর-৬ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৩ হাজার ১৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ২ হাজার ১২২ জন আর মহিলা ভোটার ১ লাখ ৮৯৬ জন। মোট ভোটকেন্দ্র ৭৯টি এবং ভোট কক্ষের সংখ্যা ৩৭৪টি।
বগুড়া-১: করোনার সঙ্গে বন্যার ছোবলের মধ্যেই ভোট
বগুড়া ব্যুরো ও সারিয়াকান্দি প্রতিনিধি জানান, করোনা সংক্রমণের মধ্যেই বন্যার ছোবলে বিপর্যস্ত বগুড়া-১ আসনভুক্ত দুই উপজেলা সোনাতলা ও সারিয়াকান্দিবাসী আসন্ন উপনির্বাচন নিয়ে রীতিমত শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। যে কারণে আগামী ১৪ জুলাইয়ের ভোট নিয়ে তাদের মধ্যে আগ্রহ অনেকটাই কম। বরং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের সভা-সমাবেশসহ সম্ভাব্য নির্বাচনী তৎপরতা নিয়ে আতঙ্কিত অনেকেই। এমন পরিস্থিতিতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা নির্বাচন পিছিয়ে করোনা সংকট শেষে আয়োজনের দাবিও জানান।
করোনা সঙ্কটের মধ্যেই উজান থেকে নেমে আসা ঢল এবং বৃষ্টিতে গত জুন মাসের শেষ সপ্তাহে সোনাতলা ও সারিয়াকান্দি উপজেলার ১৭ হাজার ৪০০ পরিবার বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েন। গত ২ জুলাই থেকে পানি কিছুটা কমতে শুরু করলেও যমুনার পানি রোববার দুপুর পর্যন্ত বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে ভোটের আয়োজন নিয়ে এক ধরনের শঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
বগুড়া-১ আসনের উপনির্বাচনে মোট ৭ জন প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। এরা হচ্ছেন- আওয়ামী লীগের সাহাদারা মান্নান, বিএনপির একেএম আহসানুল তৈয়ব জাকির, জাতীয় পাটির মোকছেদুল আলম, খেলাফত আন্দোলনের নজরুল ইসলাম, এনপিপির আব্দুল হাই মন্ডল, পিডিপির মো. রনি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াসির রহমাতুল্লাহ ইন্তাজ। এখানে মোট ভোটার ৩ লাখ ১৭ হাজার ৫৬৯ জন এবং মোট কেন্দ্র ১২৩টি।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাহাদারা মান্নান করোনা ও বন্যা পরিস্থিতিতেও নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে মত তুলে ধরে সমকালকে বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় কোনো জনপ্রতিনিধি নেই। যে কারণে মানুষ নির্বাচনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। তাছাড়া গ্রামের মানুষ করোনাকে তেমন ভয়ও পান না।
বিএনপি প্রার্থী আহসানুল তৈয়ব জাকির অবশ্য নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, করোনা নিয়ে মানুষের মধ্যে একে তো ভীতি কাজ করছে। তার ওপর বন্যায় বাড়ি-ঘর ও ভোটকেন্দ্র ডুবে আছে। এর মধ্যে কীভাবে নির্বাচন হবে? মানুষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে এভাবে ভোট হতে পারে না।
বগুড়া জেলা নির্বাচন কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, দু’টি উপজেলায় ১৮টি ভোটকেন্দ্রে এখনও বন্যার পানি রয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি কেন্দ্রের মাঠের মধ্যে আর ৪টি কেন্দ্রের ভেতরে পানি জমেছে। এসব ভোটকেন্দ্রে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনের আয়োজন বিষয়ে তারও কিছুটা শঙ্কিত। বগুড়া-১ আসনের উপনির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও বগুড়া জেলার সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা মাহবুব আলম শাহ্ জানিয়েছেন, যেসব কেন্দ্রে পানি আছে সেগুলো পরিবর্তন করার জন্য কমিশনে আবেদন করা হবে। আর করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভোটারদের ভোট দিতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
বগুড়া সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি মাসুদার রহমান হেলাল বলেন, সংবিধানের দোহাই দিয়ে মানুষকে মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়ে ভোটের এই আয়োজন কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। জীবনের চেয়ে সংবিধান কখনও বড় হতে পারে না। কারণ মানুষের জন্যই সংবিধান। মানুষ না থাকলে সংবিধান দিয়ে কি হবে?