যেমন ছিল জিম্মিদশার সেই দিনগুলো
‘৩৩ দিনকে মনে হয়েছে ৩৩ বছর’

চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছার পর আনন্দে উচ্ছল এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের নাবিকরা মো. রাশেদ
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪ | ২৩:২৮ | আপডেট: ১৯ মে ২০২৪ | ১১:০৩
মোহাম্মদ নুরউদ্দিন। এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের জিম্মি সেই ২৩ নাবিকের একজন। খাবারের দায়িত্বে থাকায় খুব কাছ থেকে জলদস্যুদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি। তাঁর সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন রিজিওনাল এডিটর সারোয়ার সুমন
‘জলদস্যুরা প্রত্যেকে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র, রকেট লাঞ্চার ও মেশিনগান নিয়েই জাহাজে উঠে ওরা। এসব অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখাত আমাদের। কখনও কখনও মাথার দিকে তাক করে রাখত মেশিনগান। একসঙ্গে এত অস্ত্র দেখিনি কখনও। কখনও কখনও মজা করলেও হঠাৎ করে রুদ্ররূপ ধারণ করত জলদস্যুরা। নির্দেশ না মানায় আমাদের দু’জন সিনিয়র নাবিকের সঙ্গে খারাপ আচরণও করে জলদস্যুরা। একজনকে থাপ্পড় মেরেছিল। আরেকজনকে মেশিনগানের বাঁট দিয়ে আঘাত করেছিল। তবে দাগ হয় কিংবা গুরুত্বর আঘাত হওয়ার মতো কোনো আঘাত তারা করেনি। মানসিকভাবে খুব পীড়ার মধ্যে ছিলাম আমরা। ৩৩ দিনকে মনে হচ্ছে ৩৩ বছর।’ এভাবেই জিম্মিদশার দুঃসহ সেই স্মৃতি স্মরণ করলেন এমভি আব্দুলাহ জাহাজের জেনারেল স্টুয়ার্ড মোহাম্মদ নুরউদ্দিন।
সমকালের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় জিম্মিদশার সেই ৩৩ দিনের নানা ঘটনা তুলে ধরেন তিনি। জলদস্যু ও নাবিকদের খাবারের দায়িত্বে থাকায় খুব কাছ থেকেই সবার আচরণ পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে তাঁর। জলদস্যুদের কে কেমন ছিলেন, কার সঙ্গে কী আচরণ করেছেন, তারা কীভাবে ভয় দেখাত, দিন ও রাতের সময়গুলো জলদস্যুরা কীভাবে কাটাত– এসব বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন তিনি।
জলদস্যু কমান্ডারকে ডাকতাম ‘উঠপাখি’
জেনারেল স্টুয়ার্ড নুরউদ্দিন বলেন, ‘জলদস্যুরা বাংলা বুঝত না। তারপরও সাবধান থাকতাম আমরা। কথা বলার সুবিধার্থে তাদের ডাকতাম সাংকেতিক নামে। ওদের কমান্ডারকে আমরা ডাকতাম ‘উটপাখি’। জলদস্যুদের একজন আমাদের খুব জ্বালাত। আমরা তাঁর নাম দিয়েছি ‘ছ্যাচড়া’। আরেকজনের নাম দিয়েছিলাম ‘সান্টু’। জলদস্যুদের একজনের নাম ছিল আহমদ। তাঁর নাম দিয়েছি আমরা দোভাষী। সে কিছুটা ইংরেজি বলতে পারত এবং বুঝত। আমাদের ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ স্যার এই নামকরণ করেন। সাংকেতিক এসব নামে ডাকার কারণে তারা আমাদের কথা বুঝতে পারত না– বলেন নুরউদ্দিন। তিনি আরও জানান, ‘পরিবেশ হালকা রাখতে আমাদের ক্যাপ্টেন সবচেয়ে বেশি কথা বলতেন তাদের সঙ্গে। এতে তারা নরমাল থাকত। আবার অনেক সময় বিরক্তও হয়েছে। মহিউদ্দিন নামের এক জলদস্যু একদিন খুব রেগে গিয়েছিল। ক্যাপ্টেনের চোখের সামনে আঙুল তুলে বলে, ‘ইউ টক ঠু মাচ’।
দুম্বা এনে জাহাজেই জবাই করত ওরা
‘জলদস্যুরা স্পিডবোটে করে জীবিত দুম্বা নিয়ে আসত। জাহাজেই তা জবাই করত তারা। একসঙ্গে কখনও চার-পাঁচটি দুম্বা আনত। কখনও আনত তারও বেশি। প্রতিটি দুম্বার ওজন হতো সাত থেকে আট কেজি। বিশেষ কায়দায় সেদ্ধ করে এসব দুম্বার মাংস খেত তারা। খেতে বলত আমাদেরও। তাদের এই মাংস আমরা খেতে পারতাম না। কারণ সেদ্ধ করা দুম্বার মাংসের সঙ্গে সেদ্ধ ছোলা বুট কিংবা সেদ্ধ চাল মিশ্রণ করত তারা। এক ধরনের কাঁচা তেলও এটার সঙ্গে মেশানো হতো। তাদের কাছে এ খাবার খুব জনপ্রিয় ছিল। কখনও কখনও তিন বেলাতেই দুম্বার সেদ্ধ মাংস খেয়েছে তারা।’
ওরা থাকত এসি রুমে আমরা মেস রুমে
জলদস্যুদের আচরণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নুরউদ্দিন বলেন, ‘জলদস্যুরা কেউ রোজা রাখত না। নামাজও পড়ত না। কিন্তু খাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করত তা হালাল কিনা?’ তারা আমাদের ব্রিজে কিংবা ক্রু মেস রুমে থাকতে দিত। কিন্তু নিজেরা থাকত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে। পাইলটের রুম, অফিসার লাউঞ্জ, অতিরিক্ত কেবিন রুম ও অফিসার মেস রুমে থাকত তারা। মাঝে মধ্যে আমাদের কেবিন রুমে যেতে দিত। শেষ দিকে কিছুটা ভালো আচরণ করেছে ওরা। প্রথম দিকে খুব কঠিন ছিল ওদের আচরণ। পরে যখন মুক্তিপণের আলোচনা শুরু হয় তখন আস্তে আস্তে সদয় আচরণ করতে থাকে তারা।’
কথার গাড়ি চালিয়ে নুরউদ্দিন আরও বলেন, ‘জলদস্যুদের আপ্যায়নের দায়িত্বে ছিলাম আমি ও চিফ কুক শফিকুল। আমরা দুজন তাদের আচরণ খুব কাছ থেকে দেখেছি। পান থেকে চুন খসলেই রুদ্ররুপ ধারণ করতো তারা। কখনও কখনও মজা করতো। তবে একজন মজা করলে অন্যজন কঠোর থাকতো।
উঠেছে ১২ জন, নেমেছে ৬৫ জন
‘১২ মার্চ যেদিন জলদস্যুরা জিন্মি করে এমভি আবদুল্লাহ; সেদিন প্রথমে ১২ জন জলদস্যু উঠে জাহাজে। সোমালিয়ার উপকূলে যাওয়ার পর তিন ধাপে আরও ৫০-৫৫ জন জলদস্যু জাহাজে উঠে। জাহাজ সোমালিয়ার উপকূলে নোঙর করার পর প্রথম যে ১২ জন উঠেছিল তারা নেমে যায়। নতুন আরেকটি গ্রুপ আসে জাহাজে। কিছুদিন পর তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় আরো একটি গ্রুপ। যেদিন ওরা জাহাজ ছেড়ে চলে যায় সেদিন নয়টি বোটে ৬৫ জন জলদস্যু গুণে দেখেছি আমরা। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল ভারী অস্ত্র। তারা খুব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বলে মনে হয়েছে আমাদের। প্রচুর খাবার খেতে পারে তারা। তবে যতটুকু খায় তার চেয়ে বেশি নষ্ট করে জলদস্যুরা’- স্মৃতি হাতড়ে বললেন নুরউদ্দিন।
তেহেরী খেয়েছি ঈদের দিন
ঈদের সময় খুব মন খারাপ ছিল আমাদের। তবে ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই আমরা বুঝতে পারছিলাম সমঝোতার দিকে এগুচ্ছে আলোচনা। ভেবেছিলাম ঈদের আগেই হয়তো মুক্তি মিলবে। কিন্তু পরে দেখলাম সেটা আর হয়নি। তাই ঈদের দিন মন খারাপ ছিল সবার। শেষ রোজার দিন ক্যাপ্টেন স্যার বললেন আজ কি রান্না করলে ভালো হয়? বিশেষ কিছু রান্না করা হোক। তখন বেশিরভাগ নাবিক তেহেরী খেতে চাইলো। মাংস দিয়ে তখন তেহেরী রান্না করলাম আমরা। এই তেহেরী দিয়েই শেষ রমজানের ইফতার করেছি আমরা। ঈদের দিনও তেহেরেী খেয়েছি গরম করে। সাথে রেধেঁছিলাম দুই ধরনের সেমাই। ঈদের দিন দুপুরে বিশেষ অরেকটি খাবার রান্না করেছিলাম, সেটি এখন মনে করতে পারছি না। তবে আমাদের রান্না করা সেমাই ও তেহেরী খেয়েছে জলদস্যুদের কেউ কেউ’- বললেন জেনারেল স্টুয়ার্ড নুরউদ্দিন।
গোসল করতাম সপ্তাহে একদিন
দুঃসহ সেই স্মৃতি ঘেঁচে নুরউদ্দিন আরও বলেন, ‘দুবাই যাওয়ার পথেই আমাদের জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়ে। জাহাজে পর্যাপ্ত খাবার ও সুপেয় পানি ছিল। তিন্তু যখন আমরা জলদস্যু দ্বারা আক্তান্ত হয়েছি তখন খাবার ও পানি ভাগাভাগি করতে হয়েছে। যে খাবার ২৩ জন খাওয়ার কথা ছিল সেটি প্রায় ৩৫ জনে খেতে লাগলো। উপক’লে আসার পর জলদস্যুর সংখ্যা আরও বেড়েছে। তাই ভাকার ও পানি রেশনিং করে ব্যবহার করতে হয়েছে আমাদের। প্রথম দিকে ২/৩ দিন পর পর গোসল করতার আমরা। কিন্তু শেষ দিকে গোসল করতাম সপ্তাহে একদিন। এজন্য আমাদের অনেকের চর্ম রোগ দেখা দিয়েছিল। আরও দেরীতে জাহাজ দস্যুমুক্ত হলে এই সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করতো।’
ঈদের দিন রুদ্ধমূর্তি ছিল জলদস্যুদের
মুক্তিপণের টাকা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর জলদস্যুদের আচরণে পরিবর্তন আসে বলে জানান নুরুদ্দিন। তিনি বলেন, ‘ঈদের নামাজ পড়ার জন্য আমরা জলদস্যুদের বিনীতভাবে অনুরোধ করি তারা যেন আমাদের নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়। এসময় আমরা ২২ জন ঈদের নামাজ পড়ি। আমাদের সাথে নামাজ পড়ে দোভাষী আহমদও। কিন্তু আমাদের একজন নাবিক ইঞ্জিন রুমে দায়িত্বে থাকায় সেদিন নামাজ পড়তে পারেনি। নামাজ পড়ার এই ছবি তুলেছিলেন আমাদের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান। পরে নামাজ পড়া সেই ছবি দেখা যায় গণমাধ্যমে। এটি প্রকাশ হওয়ার পর খুব রুদ্ররূপ ধারণ করে জলদস্যুরা। এর আগে আমাদের সাথে মাঝে মাঝে কথা বলার চেষ্টা করতো তারা। কিন্তু ঈদের দিন থেকে নামার আগ পর্যন্ত খুব কঠোর ছিল জলদস্যুরা। শেষ ১০-১২ দিন ভারী অস্ত্র নিয়ে পালাক্রমে পাহারা দিত তারা। কোন কথা বলতো না। আমাদের চিফ অফিসারকে এজন্য কঠোর ভাষায় সতর্ক করেছিল জলদস্যুরা।’
মাদকাসক্ত থাকতো জলদস্যুরা
নুরুদ্দিন বলেন, ‘একজাতীয় গাছের ছোট ছোট কিছু কাণ্ড ও পাতা চিবিয়ে খেতো জলদস্যুরা। এটি মাদক হিসেবে গ্রহণ করতো তারা। এটা আনা হতো কেনিয়া থেকে। আবার ছাই রঙের একধরনের পাউডার জিহ্বার মধ্যে দিয়ে মাদকের স্বাদ নিতো তারা। জলদস্যুদের তরল জাতীয় কোনো মদ খেতে দেখিনি। তবে প্রচুর চা খেতো তারা। দিনে ৫/৬ ঘণ্টার বেশি ঘুমাতো না তারা কেউই। মাদক ছাড়া থাকতে পরতো না বেশিরভাগ জলদস্যু।’
- বিষয় :
- জাহাজ জিম্মি