কারা হাসপাতালের সেই ‘ভিআইপি’ ওয়ার্ডে তালা

জেল রোডে দাঁড়িয়ে কারাবন্দিদের সঙ্গে কথা বলতেন স্বজনরা সমকাল
আহমেদ কুতুব
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২৩:২২
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিতর্ক এড়ানো এবং অর্থ কেলেঙ্কারি থেকে নিরাপদে থাকতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কারা হাসপাতালের কথিত ‘ভিআইপি ওয়ার্ডে’ তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তদবির ঠেকাতে হাসপাতালটির তৃতীয় তলা এখন রোগীশূন্য। কারাবন্দি কোনো আসামি প্রকৃতভাবে অসুস্থ হলে সেই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এখন প্রতিদিন গড়ে ৬০ থেকে ৭০ জন আসামি কারা হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ১০০ শয্যার কারা হাসপাতালে চট্টগ্রাম জেলা ছাড়াও কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, ফেনী জেলা কারাগারে অসুস্থ হওয়া বন্দি আসামিদের উন্নত চিকিৎসা দিতে এখানে পাঠানো হয়। হাসপাতালে কারা বিভাগের একজন নিজস্ব সহকারী সার্জনসহ চারজন চিকিৎসক থাকার কথা, তবে এখন তিনজন চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। কারাগারের নিজস্ব সহকারী সার্জনের প্রেষণ আদেশ প্রত্যাহার হওয়ায় তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ফেরত গেছেন।
এখন চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে তিনজন চিকিৎসক কারা হাসপাতালে পালাক্রমে রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। তারা হলেন তুষারকান্তি নাথ, জাহেদুল ইসলাম ও মো. একরাম। তারা কেউ কারা হাসপাতালে অনিয়ম ও দুর্নীতির দুর্নাম কাঁধে নিতে রাজি না হওয়ায় মূলত হাসপাতালের বিতর্কিত ওয়ার্ডটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম কারা হাসপাতালের সহকারী সার্জন (সদ্য প্রেষণাদেশ প্রত্যাহার হওয়া) ডা. রেজা মো. সরোয়ার আকবর বলেন, ‘ষষ্ঠ গ্রেডে আমার পদোন্নতি হওয়ায় প্রেষণ আদেশ প্রত্যাহার করিয়ে কারা বিভাগে থেকে স্বাস্থ্য বিভাগে ফেরত চলে এসেছি। চট্টগ্রাম কারা হাসপাতাল থেকে চলে আসার সময় অন্য তিন চিকিৎসক হাসপাতালটিকে অনিয়মমুক্ত করার জন্য সবরকম পদক্ষেপ নিয়েছেন। রাজনৈতিক তদবির ও অর্থের বিনিময়ে হাসপাতালে আসামি ভর্তি করা কিংবা বেডে রাখা ঠেকাতে তৃতীয় তলার ওয়ার্ডটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তারা এখন স্বচ্ছ ও অনিয়মমুক্তভাবেই হাসপাতালটি পরিচালনা করছেন।’
কারা হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডা. তুষারকান্তি নাথ বলেন, ‘কারাবন্দি আসামিদের চিকিৎসা দিতে সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে আমাদের পদায়ন করা হয়েছে। রোস্টার করে আমরা বন্দিদের চিকিৎসা দিচ্ছি। তদবির কিংবা অর্থের বিনিয়মে কেউ যাতে সুবিধা নিতে না পারেন। সুনামের সঙ্গে কাজ করব, না পারলে অন্যত্র চলে যাব।’
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ মঞ্জুর হোসেনকে ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
গত সপ্তাহে কারাগার থেকে চট্টগ্রাম আদালতে হাজিরা দিতে আসা একাধিক কারাবন্দি আসামির সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সাবেক প্রধানমনন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ক্ষমতার পালাবদলে কারাগারের ভেতরও পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। এখন কারারক্ষী ও কর্মকর্তারা বন্দিদের সঙ্গে আগের মতো ধমক দিয়ে কথা বলেন না। বন্দিদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করছেন। ভালভাবে কথা বলছেন। অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে না। ডাক্তার ও মেডিকেল সহকারীরা রোগের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে সরকারি ওষুধ দিচ্ছেন। আগে এ চিত্র ছিল না। কোন বন্দির অসুস্থতা বেশি হলে তাকে সাথে সাথে ভর্তি দেওয়া হচ্ছে। গুরুতর হলে চমেক হাসপাতালে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কারা হাসপাতালটি বিগত সময়ে যেন টাকার মেশিনে পরিণত হয়ে উঠেছিল। মাসিক হারে হাসপাতালের সিট বিক্রি, আউটডোরে চিকিৎসার নামে চলেছে টাকার খেলা। সুস্থ ও বিত্তবান বন্দিদের রাজকীয় আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল হাসপাতালটি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলীয় প্রভাবশালী আসামিদের আয়েশী কারাভোগের প্রিয় জায়গায় পরিণত হয়েছিল অসুস্থ বন্দি রোগীদের হাসপাতালটি। এমনকি আদালত থেকে কারাভোগ করতে পাঠানো চেক প্রতারণা মামলার আসামিদের ‘সেভ হোম’ হিসেবেও মাসের পর মাস ধরে ব্যবহৃত হয়েছে এই হাসপাতাল। এখানে ভর্তি থাকা রোগীদের তিন ভাগের দুই ভাগই অর্থ আত্মসাতের আসামি ছিলেন। মাসিক ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকার চুক্তিতে সুস্থ আসামি ভর্তি থাকার অভিযোগ ছিল সবসময়। হাসপাতাল ঘিরে কারাগারে ভেতর ও বাইরে বাণিজ্যের বৃহৎ জাল সৃষ্টি হয়েছিল। ছিল একাধিক সিন্ডিকেটও। সুস্থ আসামিকে হাসপাতালে ভর্তির তদবিরের তালিকায় এমপি, আ.লীগ নেতা, আমলা ও ডাক্তারদের নামও উঠে এসেছিল। ৪০০ কোটি টাকার ঋণখেলাপী নূরজাহান গ্রুপের পরিচালক টিপু সুলতান লাখ টাকা চুক্তিতে এক বছর ধরে হাসপাতালে থেকে আরাম-আয়েশে কারাভোগ করেন। তার মতো আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তদবিরে স্বর্ণ চোরাচালান মামলার আসামি উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আবু সাহেদ, পিয়ন থেকে কোটিপতি বনে যাওয়া চট্টগ্রামের পদ্মা অয়েল কোম্পানীর সিবিএ নেতা নাছির উদ্দিন, অতিরিক্ত পোস্ট মাস্টার জেনারেলের সুস্থ শ্বশুর মো. ইফতেখার, চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ ডা. খোকন চৌধুরী ও তার ভাই প্রবীর চৌধুরীর মতো বহু সুস্থ বন্দি কারা হাসপাতালে অবৈধভাবে আশেয়ী কারাভোগ করেন।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করে কারাগারের ভেতর-বাইরের পরিবেশ ও পরিস্থিতি। কারা অভ্যন্তরে বন্দিদের বিদ্রোহের কারণেও কারাগারে অনিয়ম ও দুর্নীতি একেবারে সীমিত পর্যায়ে চলে এসেছে। এখন কেউ কোন অনিয়ম করলেও তা কঠোর গোপনীয় ও চুপিসারেই করছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হাসপাতালের চিকিৎসক ও কারা কর্মকর্তারা যৌথ বৈঠক করে রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীদের তদবিরে হাসপাতালে সুস্থ আসামি না তোলার বিষয়ে একমত হন। কারা হাসপাতালের চিকিৎসকরা কোনভাবেই এ দায় নিতে রাজি নন। তারা তদবিরের বিষয়টি দেখার জন্য কারা কর্মকর্তাদের উপর ভার ছেড়ে দেন। গত এক মাস ধরে অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্তভাবে স্বচ্ছভাবে চলছে কারা হাসপাতালটি।
জানা যায়, হাসপাতালে ভর্তি থাকলে একজন আসামি একটি লোহার সিট পান, যেখানে সাধারণ ওয়ার্ডে থাকলে গাদাগাদি করে রাতে ঘুমাতে হয়। ওয়ার্ডে সাধারণ খাবার পেলেও হাসপাতালে দুই বেলা উন্নত মানের ডাইট খাবার ও সকালে দুধ-কলা দেওয়া হয়। যেখানে সাধারণ বন্দিরাম পান পরিমিত ভাত, মাছ ও সবজি। হাসপাতালে হাঁটাচলা করতে পারেন বন্দিরা। কিন্তু ওয়ার্ডে নিজের মনমতো হাঁটা চলাফেরা করার সুযোগ নেই। এভাবে হাসপাতালে থাকলে অনেক বাড়তি সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারেন বন্দি আসামি।
- বিষয় :
- কারাবন্দী