সরকারি কলেজ যেন ‘সোনার হরিণ’

ফাইল ছবি
শৈবাল আচার্য্য, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২২:৪২
মেধাবী শিক্ষার্থী সাজ্জাদুর রহমান শিমুল। এসএসসিতে জিপিএ ৫ পাওয়ায় তার প্রবল ইচ্ছা ছিল ঐতিহ্যের চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হওয়ার। এটি তার দীর্ঘদিনের স্বপ্নও। তবে ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই এ প্রবাদটি শতভাগ মিলে গেছে শিমুলের ক্ষেত্রে। কারণ পছন্দের কলেজে ভর্তি হতে কয়েক দফায় অনলাইনে আবেদন করেও কপালে জোটেনি ভর্তির সুযোগ। শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষে থাকা চট্টগ্রাম কলেজে মোট আসন রয়েছে মাত্র এক হাজার ৪০টি। এর বিপরীতে কলেজটিতে ভর্তি হতে আবেদন করে কয়েকগুণ বেশি শিক্ষার্থী। এই অবস্থায় চট্টগ্রাম কলেজ তো নয়ই; চট্টগ্রামের আট সরকারি কলেজের কোনোটিতেই ভর্তির সুযোগ হয়নি হতভাগা শিমুলের।
তবে এমন অবস্থা কেবল শিমুলেরই নয়; ভালো ফলাফল করেও তার মতো চট্টগ্রামের অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না পছন্দের সরকারি কলেজে। এ অবস্থায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের সরকারি কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়া অনেকটা ‘সোনার হরিণ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো আসন স্বল্পতা। চট্টগ্রামে প্রতি বছর শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও সে তুলনায় বাড়ছে না সরকারি কলেজের আসন সংখ্যা।
এদিকে, গত ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে অনলাইনের মাধ্যমে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়েছে; যা চলবে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের এক বিজ্ঞপ্তিতে নিবন্ধনের নির্দিষ্ট দিন-তারিখ ও বিস্তারিত নিয়ম বলে দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, শিক্ষা বোর্ডগুলোর আওতাধীন দেশের সব উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ভর্তি ওয়েবসাইটের প্যানেল কলেজের ইআইআইএন নম্বর ও পাসওয়ার্ড দিয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টার মধ্যে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে।
এবারের এসএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড থেকে ১ লাখ ২০ হাজার ৮৭ জন শিক্ষার্থী পাস করেছে। যার মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছে ১০ হাজার ৮২৩ জন। অথচ চট্টগ্রাম মহানগরের আটটি সরকারি কলেজে আসনই রয়েছে মাত্র ১০ হাজার ১০০টি। এ হিসেবে এবার জিপিএ ৫ পেয়ে পাস করাদের অনেকের ভাগ্যেই জুটবে না সরকারি কলেজে ভর্তির সুযোগ। আর যেসব শিক্ষার্থী অল্পের জন্য জিপিএ ৫ পায়নি ও যারা কম জিপিএ পেয়েছে তাদের কাছে তো সরকারি কলেজে ভর্তি হতে পারা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। এমন বাস্তবতায় সরকারি কলেজে আসন বাড়ানোর দিকে জোর দেওয়ার তাগিদ বিশিষ্টজনদের।
তাদের মতে, আসন বৃদ্ধি করা না গেলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়বে। কেননা, বেসরকারি কলেজে বাড়তি ফি দিয়ে পড়ার মতো সামর্থ্য নেই মেধাবী অনেক গরিব, অসহায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের।
জানা যায়, সরকারি আট কলেজের প্রত্যেকটিতে নেই আবার বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের আলাদা আসন। চট্টগ্রামের আট সরকারি আট কলেজের মোট আসনের মধ্যে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য আসন রয়েছে ২ হাজার ৭৪০টি, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের জন্য ৩ হাজার ৭৭০টি এবং বিজ্ঞান
বিভাগের জন্য ৩ হাজার ৫৯০টি। এরমধ্যে চট্টগ্রাম কলেজে ১ হাজার ৪০টি, সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে ১ হাজার ৭২৫টি, সরকারি সিটি কলেজে ২ হাজার ১৮০টি, সরকারি কমার্স কলেজে ৯৭০টি, সরকারি মহিলা কলেজে ১ হাজার ৪০০টি, বাকলিয়া সরকারি কলেজে ১ হাজার ৪৩৫টি, চট্টগ্রাম সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ১ হাজার ৫০টি এবং কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজে আসন রয়েছে মাত্র ৩০০টি। পাস করা শিক্ষার্থীর তুলনায় এমন আসন সংখ্যাকে অপ্রতূল বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এ কারণে এসএসসিতে ভালো ফলাফল করেও সন্তানদের পছন্দের সরকারি কলেজে ভর্তির সুযোগ না পাওয়াকে দুর্ভাগ্যের বলছেন অভিভাবকরা।
চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের অধীনে এবার ২১৯টি কেন্দ্রে ১ হাজার ১২৫টি বিদ্যালয় থেকে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৭৫৩ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। যার মধ্যে জিপিএ-৫ পাওয়াদের মধ্যে পাঁচ হাজার ৭৫০ জন ছাত্রী ও পাঁচ হাজার ৭৩ জন ছাত্র। এর মধ্যে বিজ্ঞানে ৯ হাজার ৫৮৯ জন, মানবিকে ১৩৭ জন ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে এক হাজার ৯৭ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে।
চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক জাহেদুল হক বলেন, ‘চট্টগ্রামে যে হারে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে সে হারে বাড়ছে না সরকারি কলেজের আসন সংখ্যা। যে কারণে এসএসসিতে ভালো ফলাফল করেও অনেকের ভাগ্যে প্রথম সারির সরকারি কলেজে ভর্তির সুযোগ হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন। কয়েক দফা আবেদনের পরও এখনও অনেকেই কলেজে ভর্তি হতে পারেনি। যে কারণে তাদের অনেকেই আমাদের কাছে ভর্তির সুযোগ পেতে আবেদন করছে। বিষয়টি আমরা আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটিকে জানিয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু পাস করা শিক্ষার্থীর তুলনায় সরকারি কলেজে আসন সংখ্যা কম, তাই আবেদনের সময় কিছু বিষয়ে বাড়তি সতর্ক থাকার তাগাদা দিই আমরা। কলেজ পছন্দক্রম নির্ধারণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা যেসব কলেজে আসন সংখ্যা একেবারে কম সেখানে আবেদন না করায় ভালো। তাছাড়া দুই-তিনটি কলেজে আবেদন না করে পছন্দক্রমের স্থলে বাড়তি কলেজ দেওয়ার পরামর্শ থাকে আমাদের। তবে অনেক শিক্ষার্থী দেখা যায় এক থেকে তিনটি কলেজে আবেদন করে। অনেকে আবার মেধা তালিকা অনুযায়ী প্রথম সারির যেসব কলেজ পাবে না সেগুলোতেই পছন্দক্রম হিসেবে দিয়েছে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রামে সরকারি কলেজের আসন সংখ্যা না বাড়ার কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না। এতে মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ পড়ালেখা থেকে ঝড়ে পড়ছে। কারণ বেসরকারি কলেজে রয়েছে নানাখাতে বাড়তি ফি’র চাপ। যা নি¤œ-মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের বহন করা কঠিন।’ কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে কোনকিছুই নেই ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। এ কারণে দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় অনেক কাটছাট করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এমন বাস্তবতায় বাড়তি খরচ দিয়ে সন্তানকে বেসরকারি কলেজে পড়ানো অনেক পরিবারের জন্য দুঃস্বপ্ন।’
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষদের আবেদনের প্রেক্ষিতে এরইমধ্যে কলেজে ভর্তির সময়সীমা কয়েক দফায় বাড়াতে বাধ্য হয় আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি। সর্বশেষ গত ১৫ আগষ্ট আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি তপন কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, কলেজ না পাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইনে আবেদনের সময় আবারও বাড়িয়ে ১৮ আগষ্ট পর্যন্ত করা হয়। ২২ থেকে ২৪ আগষ্ট পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের নির্বাচন নিশ্চায়ন শেষে ২৫ আগষ্ট কলেজে ভর্তি করার কথা বলা হয় তাতে। তবে সেটি আবারও বাড়িয়ে পহেলা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। উল্লেখ্য, কোটা সংস্কার আন্দোলন ও সরকারের পদত্যাগের কারণে কয়েক দফায় পেছানো হয় ভর্তি কার্যক্রম।
- বিষয় :
- কলেজ ছাত্র