ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

কুটিরশিল্প বিকাশেও সিন্ডিকেট বাধা

কুটিরশিল্প বিকাশেও সিন্ডিকেট বাধা

বারৈয়ারঢালা ইউনিয়নে একটি পাড়ায় বাঁশের সামগ্রী তৈরি করছেন একদল নারী সমকাল

এম সেকান্দর  হোসাইন, সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম)

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৪ | ২৩:১০

চট্টগ্রামের ভাষায় জিনিসগুলোর নাম বেশ আকর্ষণীয়, ভাঁইর, লাই, ডুলা, খারাং, উইজ্জা, জুইর। ভাঁইর, লাই হচ্ছে পণ্য রাখার ঝুড়ি। ও খারাং হচ্ছে পণ্য রাখার বড় খাঁচা, ডুলা হলো মাছ রাখার খাঁচা বিশেষ। উইজ্জা হলো মুরগির বাচ্চা নিরাপদ রাখার বিশেষ খাঁচা। আঁর জুইর হলো বৃষ্টি থেকে বাঁচার ছাতা বিশেষ।
একসময় গ্রামে মানুষ এসব গ্রামীণ পণ্য ডালা, কুলা, চালুন ফেরি করে বিক্রি করতেন। তবে বর্তমানে প্লাস্টিক সামগ্রীর সহজলভ্যতা ও কম দামের কারণে গ্রামীণ বাঁশ-বেতের কুটিরশিল্প হারিয়ে যাচ্ছে।
তারা বাঁশ দিয়ে বানান ঝুড়ি ও খাঁচা বিশেষ এসব গ্রামীণ জিনিসপত্র। মূলত এসব কুটির শিল্পের অংশ। সীতাকুণ্ড উপজেলার বারৈয়ারঢালা ইউনিয়নের কয়েক হাজার পরিবার এখনও সগৌরবে ধরে রেখেছে বাঁশের কুটিরশিল্প। বাঁশ ও বেত দিয়ে যারা নানা পণ্য তৈরি করেন তারা সবাই নারী। শত বছর ধরে বংশপরম্পরায় তারা এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তবে এখন বাঁশ শিল্পীদের মনে অনেক দুঃখ। দাদন ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের প্রভাবে এসব জিনিসের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। আর্থিক সংকটের কারণে অনেক সময় বেকার বসে থাকতে হয়। এই সুযোগে দাদন ব্যবসায়ীরা তাদের জিম্মি করে রাখেন। 
সরেজমিন কথা হয় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। তারা বলেন, একসময় গ্রামীণ জনপদে ঘরে ঘরে তৈরি হতো বাঁশ দিয়ে শত পণ্য। কালের বিবর্তনে গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য বাঁশ ও বেত শিল্প  হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বারৈয়ারঢালা  ইউনিয়নের হাজারো পরিবার এই বাঁশ শিল্প আঁকড়ে আছে এখনও। ইউনিয়নের পূর্ব লালানগর, পশ্চিম লালানগর, ফেদাই নগর, বহরপুর, মহালংঙ্কাসহ বিভিন্ন গ্রামে গৃহিণীরা বাঁশ দিয়ে পণ্য তেরি করে তা বিক্রি করে সংসারে সুখ আনার চেষ্টা করছেন।
আসমা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী একজন কৃষক। সে হালচাষ করে সংসার চালায়। আমিও বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে বিক্রি করে কিছুটা রোজগার করি, এটা সংসারে সচ্ছলতা আনে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার শ্বশুর-শাশুড়িরাও এই পেশায় ছিলেন। তবে স্থানীয় এখন প্লাস্টিক পণ্যের সহলভ্যতার কারণে আগের মতো আমরা দাম পাই না। আবার আমাদের জিনিস যারা কেনেন তারা বাইরে থেকে আসেন। অনেক সময় বাইরে থেকে আসা ক্রেতাকে এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হয় না। পণ্য কিনতে আসা কয়েকজন ব্যবসায়ীর উপর হামলাও হয়েছে। ফলে আমাদের পণ্য অবিক্রিত থেকে যায়।’ তিনি জানান, তাদের তৈরি একজোড়া খাঁচার দাম স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ১৫০ টাকার বেশি দেন না। তবে বাইরে থেকে আসা ক্রেতারাদের কাছে তা ২০০ টাকায় বিক্রি করা যায়।
একই এলাকার বিবি খতিজা বলেন, ‘একটি বাঁশের দাম ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। একটি বাঁশ দিয়ে ৫টি খাঁচা হয়, সময় লাগে প্রায় দুই দিন। সরকারিভাবে যদি আমাদের ঋণ দেওয়া হয় তাহলে আমরা এই পেশায় আরও বেশি উন্নতি করতে পারব।’

কাজল রেখা নামের অন্য আরেক গৃহিণী বলেন, ‘আমাদের ঘরগুলো ছোট। বর্ষাকালে ঘরে কাজ করতে খুবই অসুবিধা হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে আমাদের জিম্মি করে রেখেছেন। এ থেকে মুক্তির জন্য প্রশাসনের সহযোগিতা চাই।’
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক বলেন, ‘একসময় পাহাড়ে প্রচুর বাঁশ পাওয়া যেত। শিল্পকারখানা গড়ে উঠার কারণে দিনদিন বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এখন আমাদের অনেকদূর থেকে বাঁশ কিনে আনতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্থানীয় বেশিরভাগ নারীর ঘরে বসে কাজ করার জায়গা নাই।  বৃষ্টি হলে কাজে ব্যাঘাত ঘটে। এই ইউনিয়নে কয়েক হাজার মানুষ বাঁশ শিল্পের সঙ্গে জড়িত।  সরকারিভাবে যদি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের আর্থিক সহায়তা করা দরকার।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কুটির শিল্প একটি জনবান্ধব শিল্প হিসেবে পরিচিত। কুটির শিল্পর সঙ্গে গ্রামের অধিকাংশ মহিলা জড়িত। কুটির শিল্পের মাধ্যমে নারীদের উন্নয়ন সম্ভব। এই শিল্প বিকাশের জন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে। আর বিক্রেতারা যাতে পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান সেই ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হবে।’

আরও পড়ুন

×