মশা মারতে নতুন মেয়রের ‘কামানও’ ব্যর্থ!

এটি নগরীর হালিশহর এলাকার গইন্যাছড়া খাল। ময়লা-আবর্জনায় ভরাট এসব খালে মশার দ্রুত প্রজনন হলেও, খাল পরিষ্কারে উদ্যোগ নেই- মো. রাশেদ
লিখেছেন শৈবাল আচার্য্য
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৪৯
শুধু বর্ষা নয়, ডেঙ্গু এখন বছরজুড়েই হচ্ছে। নগর-গ্রামে ডেঙ্গুতে প্রায়ই ঘটছে প্রাণহানি। মশার উৎপাতের জন্য নগরবাসী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে দুষছেন। নতুন মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পর মশকনিধনে জোর তৎপরতা চালালেও খুব একটা সুফল মেলেনি। লিখেছেন শৈবাল আচার্য্য
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে ডেঙ্গু। দিন যতই যাচ্ছে ততই বাড়ছে মশাবাহিত এই রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর হার বাড়লেও মশা মারতে চসিকের তেমন কার্যক্রম না থাকার অভিযোগ বেশির ভাগ বাসিন্দার। তাদের কথা– সিভিল সার্জন কার্যালয় পরিচালিত জরিপে অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ‘লাল’ তালিকাভুক্ত এলাকায়ও জোরদার হয়নি মশক নিধন কার্যক্রম। উল্টো বাড়ছে মশার উপদ্রব। এই অবস্থায় নানা শঙ্কা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন বাসিন্দারা। অনেক শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ায় বাড়ছে দুশ্চিন্তা। ডেঙ্গুর ক্ষতিকারক ধরন ডেন-২-এ মৃত্যু ও আক্রান্ত বেশি বলে ধারণা করছেন গবেষকসহ সংশ্লিষ্টরা। এ জন্য মশা মারার ওপর বাড়তি নজর দেওয়ার তাগিদ তাদের। সঠিক সময়ে মশা মারতে না পারলে মৃত্যু ও আক্রান্তের হার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হওয়ার কথা বলছে স্বাস্থ্য প্রশাসন।
একই স্প্রে বারবার মারতে থাকলে মশা সেটায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। এতে মশা আর সহজে মরে না। তাই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মশা মারতে একটি নতুন ওষুধ বের করেছে, সেটি হলো রিসার্চ প্রোডাক্ট মসকিউটো অ্যান্ড সলিউশন। এডিস মশার লার্ভাসহ অন্যান্য লার্ভা ধ্বংস করার জন্য এটি ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে সংশ্লিষ্টদের কথা, মশা মারতে চসিকের ‘নতুন কামান’ও ব্যর্থ হয়েছে।
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ায় সিভিল সার্জন কার্যালয় নগরে একটি জরিপ কাজ পরিচালনা করে। সর্বশেষ পরিচালিত সেই জরিপে নগরের ২৩টি এলাকাকে ডেঙ্গুর অন্যতম হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এতে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে কয়েকটি আবাসিক এলাকাসহ ছয়টি এলাকাকে ‘লাল’ তালিকাভুক্ত, পাঁচটি এলাকাকে ‘হলুদ’, ছয়টি এলাকাকে ‘নীল’ এবং চারটি এলাকাকে ‘সবুজ’ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। সংস্থাটির আরেক জরিপে নগরের ৩৭ শতাংশ বাড়িতে মিলেছে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভাও। পিলে চমকানোর মতো এমন তথ্য-প্রমাণ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে মশা মারার দায়িত্বে থাকা চসিকের ব্যর্থতাকে।
চলতি বছরের নভেম্বর মাসটি শুরু থেকেই ভীতি ছড়াতে শুরু করে। যে কারণে মাসটির ১৮ দিনে হয় মৃত্যুর নতুন রেকর্ড। মোট মৃত্যুর প্রায় ৪০ শতাংশই হয়েছে এই ১৮ দিনেই; যা চলতি বছরের ১০ মাসের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ। মাসটিতে মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আক্রান্তের হার। প্রতিদিনই রেকর্ডসংখ্যক মানুষের শরীরে নতুন করে শনাক্ত হচ্ছে ডেঙ্গুর অস্তিত্ব। মশার কামড় খেয়ে প্রতিনিয়ত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে শিশু থেকে বয়স্ক অনেককেই। এ অবস্থায় মশা মারতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) নতুন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের নেওয়া নতুন উদ্যােগও ব্যর্থ হচ্ছে। চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের ৮৮ ভাগের বেশিজনের শরীরেই ডেঙ্গুর সবচেয়ে ক্ষতিকারক ধরন ডেন-২-এর অস্তিত্ব শনাক্ত করেছেন একদল গবেষক। অত্যন্ত ক্ষতিকারক এই ধরনের মধ্যে আবার বিপজ্জনক কসমোপলিটন প্রকরণ ছড়িয়ে পড়ার তথ্যও উঠে এসেছে গবেষণায়; যা এবারই দেশে প্রথম শনাক্ত হওয়ার কথা বলছেন তারা।
প্রতিনিয়ত খারাপ হচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি : জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বলছে, ডেঙ্গু চট্টগ্রামে চলতি বছর ৪৫ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। যার মধ্যে সর্বোচ্চ ২৪ জনই নারী। বাকিদের মধ্যে ১৬ জন পুরুষ ও ৫ জন শিশু। মৃত্যুর পাশাপাশি আক্রান্তদের একটি বড় অংশও নারী। এ পর্যন্ত আক্রান্ত প্রায় ৪ হাজার ৩০০ জনের মধ্যে ১ হাজার ২০০ জনের ওপরে নারী। চলতি বছর ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে নভেম্বরে; রেকর্ড ১৬ জনের। অথচ এর আগের ১০ মাসে মৃত্যুর হার ছিল একেবারে কম। এর মধ্যে জানুয়ারিতে মাত্র দুই জন, ফ্রেবুয়ারিতে কোনো মৃত্যু নেই, মার্চে একজন, এপ্রিল, মে ও জুনে টানা তিন মাস মৃত্যুহার ছিল ‘শূন্য’, জুলাই ও আগস্টে একজন করে মৃত্যু হয়, সেপ্টেম্বরে ১১ জন এবং অক্টোবরে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
কাগজে-কলমে চসিকের খরচ কোটি টাকা : সিটি করপোরেশনের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে মশার ওষুধ কেনায় ব্যয় করেছে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা। পরের বছরেও প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। আর চলতি (২০২৪-২০২৫) অর্থবছরে সর্বোচ্চ আট কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ওষুধ কিনতে চার কোটি এবং ফগার ও হ্যান্ড স্প্রে মেশিন কিনতে দুই কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। তবে বাস্তবে এত টাকার সঠিক বাস্তবায়ন মশক নিধন কার্যক্রমে মিলছে না বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। এতে পরিবার নিয়ে উদ্বিগ্ন ৪১ ওয়ার্ডের বাসিন্দারা।
বছরজুড়েই থাকছে মশার উপদ্রব : বাসিন্দারা বলছেন, আগে বছরে এক মৌসুম মশার উপদ্রব থাকলেও এখন থাকছে বছরজুড়েই। গত কিছুদিন ধরে মশার উপদ্রব বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। নগরের বাকলিয়া, পাঁচলাইশ, মুরাদপুর, মোহাম্মদপুর, খতিবের হাট, চান্দগাঁও, বহদ্দারহাট, শুলকবহর, হামজারবাগ, চকবাজার, বায়েজিদসহ কয়েকটি এলাকায় মশার উপদ্রব বেশি। সরেজমিন বেশ কয়েকটি এলাকা পরিদর্শন করে নালা, খাল, বাসা-বাড়ির পাশের ছোট-বড় ড্রেন ময়লায় ভর্তি ও পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। আর এসব স্থানে ভন ভন করছে মশা। কীটতত্ত্ববিদদের মতে, দেশে প্রায় ১২৩ প্রজাতির মশা আছে। এর মধ্যে ১৬ প্রজাতির মশা বেশি; কিউলেক্সই ৯৫ শতাংশের বেশি।
ক্ষুব্ধ নগরবাসী: মশার উপদ্রবের মধ্যেই নগরের বাকলিয়া এলাকায় একই পরিবারের তিনজনকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হতে হয়েছে হাসপাতালে। এতে কাহিল অবস্থা কল্পলোক আবাসিক এলাকার এক নম্বর সড়কে বসবাসকারী পরিবারটির। পরিবারে একমাত্র সুস্থ থাকা অ্যাডভোকেট রিগ্যান বলেন, ‘প্রথমে ছোট ভাই; পরে স্ত্রী ও বাবার ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। দ্রুত সময়ের মধ্যে প্লাটিলেট কমে যাওয়ায় সবাইকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। এলাকায় মশার উপদ্রব বহুগুণ বাড়লেও ওষুধ ছিটাতে দেখা যায় না কাউকেই।’ মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা গৃহিণী নূর বেগম বলেন, ‘সন্ধ্যার পর মশার অত্যাচার বেড়ে যায় কয়েকগুণ।’
চকবাজারের বাসিন্দা আরিফ হোসেন বলেন, ‘বাসার চারপাশের খাল-নালা ময়লায় ভরপুর। এসব দেখার যেন কেউই নেই।’ কাট্টলী এলাকার বাসিন্দা স্বপ্না চৌধুরী বলেন, ‘মশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে সকাল থেকেই কয়েল ব্যবহার করি। বাসার চারপাশ নিয়মিত পরিষ্কার রাখি। তারপরেও মশা থেকে মুক্তি মিলছে না। ঘুম থেকে উঠে দেখি শরীরে মশার কামড়ের লাল দাগ।’
উপদ্রব যেখানে বেশি সেখানে ওষুধ ছিটানোর তাগিদ : ডেঙ্গু নিয়ে একাধিক গবেষণায় নেতৃত্ব দেওয়া গবেষক ও বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. আবদুর রব চৌধুরী বলেন, ‘ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দুই শতাধিক বাসিন্দাদের নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা পরিচালিত করে ৮৮ ভাগের শরীরে ডেঙ্গুর ক্ষতিকারক ধরন ডেন-২-এর অস্তিত্ব পেয়েছি। যার মধ্যে অত্যন্ত বিপজ্জনক কসমোপলিটন প্রকরণ ছড়িয়ে পড়ারও তথ্য মিলেছে। ডেঙ্গুর ভয়াবহ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে মশক নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে হবে। কোন এলাকায় কোন ধরনের মশার উপদ্রব বেশি, কোন মশা কোন ওষুধে মরবে, তা নির্ণয় করে ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আদনান মান্নান বলেন, ‘ডেঙ্গুর হটস্পটগুলোতে বাড়তি নজর দিতে হবে। কসমোপলিটন প্রকরণটি ডেঙ্গুর তীব্রতা ও মৃত্যুহার বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে চসিক লোক দেখানো কাজ করছে। একবার ওষুধ ছিটিয়ে গেলে তিন-ছয় মাসেও তাদের দেখা মিলে না। সংস্থাটির গা ঢাকা ভাবের কারণে নগরীর বেশির ভাগ এলাকা ডেঙ্গুর হটস্পটে পরিণত হয়েছে। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলে বাকি এলাকাগুলোও হটস্পটে পরিণত হবে। কাগজে-কলমে চসিক মশা মারতে কোটি টাকা খরচ করছে। তবে বাস্তবে দৃশ্যমান নয় তাদের মশক নিধন কার্যক্রম। মশা মারতে চসিক ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। জবাবদিহিতা না থাকায় এমন হচ্ছে। নতুন মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পরও মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে আশানুরূপ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এতে নগরবাসীর মাঝে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।’
মশা মারতে না পারলে আক্রান্তের হার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে বলছেন স্বাস্থ্য প্রশাসন। সিভিল সার্জন মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘মৃত্যু ও আক্রান্তের হার নিয়ন্ত্রণে মশা মারার ওপর জোর দিতে হবে বেশি। আমরা এরই মধ্যে কয়েকটি জরিপ পরিচালনা করে নগরের কোন এলাকায় মশার উপদ্রব বেশি ও কোন কোন এলাকার বাসিন্দারা বেশি ডেঙ্গুতে মৃত্যু এবং আক্রান্ত হচ্ছে সেটি খুঁজে বের করেছি। মশা মারার দায়িত্ব যেহেতু চসিকের; তাই জরিপের ফলাফল, পরামর্শসহ যাবতীয় বিষয় তাদের জানিয়েছি। সঠিক সময়ে মশা মারতে না পারলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। তবে উচ্চঝুঁকিতে থাকা অনেক এলাকায়ও মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে না বলে অভিযোগ পাচ্ছি। সঠিক সময়ে মশা মারতে না পারলে আক্রান্তের হার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। তবে আশার কথা হলো এবার মৃত্যুর হার অনেকটা কম আছে।’
- বিষয় :
- মশা