প্রকৌশলীর লাভ ৩০ লাখ পৌরসভার ক্ষতি কোটি

.
মো. মহিম উদ্দিন, হাটহাজারী, (চট্টগ্রাম)
প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৫ | ২২:৫৪
বিশ্বব্যাংকের কভিড-১৯ প্রকল্পের আওতায় হাটহাজারী পৌরসভার চারটি সড়কে বাতি স্থাপন করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের ২৪ নভেম্বর প্রকাশিত দরপত্রে শর্ত দেওয়া হয়– কাজ পেতে হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বাতি স্থাপনে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। দরপত্রে এটাও উল্লেখ ছিল, সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেওয়া হবে। অথচ পৌরসভার তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী বেলাল আহমেদ খান সরকারি ক্রয় নীতিমালা লঙ্ঘন ও দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ করে প্রায় এক কোটি টাকা বেশি দামে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে ক্ষুব্ধ সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান।
পৌরসভার এটিআই সড়ক, শীলছড়ি সড়ক, মোহাম্মদপুর ও কমিউনিটি ক্লিনিক সড়ক সড়কবাতি স্থাপন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের দরপত্রে মেসার্স এ অ্যান্ড জে ইন্টারন্যাশনাল ছিল সর্বনিম্ন দরদাতা। তারা ৪ কোটি টাকায় সড়কবাতি লাগানোর দর দেয়। তবে ৫ কোটি টাকায় কাজ দেওয়া হয়েছে মেসার্স ফিলামেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে। ৩০ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে এই অনিয়ম হয়েছে বলে বঞ্চিত ঠিকাদারদের অভিযোগ। এ ঘটনায় প্রকৌশলী বেলাল আহমেদ খানকে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীতে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। তবে সংশ্লিষ্টরা জানান, হাটহাজারী পৌরসভার অনেক কাজ এখনও প্রকৌশলী বেলালই নিয়ন্ত্রণ করেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে হাটহাজারী পৌরসভার সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী বেলাল আহমেদ খানকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি সাড়া দেননি।
এ ব্যাপারে পৌরসভার সহকারী প্রকৌশল সালমা খাতুন বলেন, ‘আমি তো সবকিছু জানি না। বেলাল স্যার সবই জানেন। হয়তো যেসব প্রতিষ্ঠান বাদ পড়েছে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আমি বেলাল স্যার ও প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানাব, তবে কোনো কাগজপত্র দিতে পারব না।’
ঠিকাদাররা অভিযোগ করেন, সরকারি ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী সর্বনিম্ন অথবা দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেওয়ার কথা। সেটা না করে সর্বোচ্চ দরদাতাকে কাজ দেওয়া হয়েছে। এতে সরকার ও পৌরসভার কমপক্ষে এক কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
২০২৪ সালের ২৪ নভেম্বর নির্বাহী প্রকৌশলী বেলাল আহমেদ খান হাটহাজারী পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড এটিআই রোড ও শীলছড়ি রোড এবং ৯ নম্বর ওয়ার্ড মোহাম্মদপুর ও কমিউনিটি ক্লিনিক রোডে সড়কবাতি স্থাপনে দরপত্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্টের মাধ্যমে আহ্বান করা দরপত্র বিক্রির শেষ তারিখ, দাখিল ও খোলার তারিখ ছিল ৩০ ডিসেম্বর। ৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সানি করপোরেশন, মেসার্স শুভেচ্ছা ইঞ্জিনিয়ারিং, মেসার্স এ অ্যান্ড জে ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স ফিলামেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। ৩০ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ দরদাতা ঠিকাদারি মেসার্স ফিলামেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে কাজ দেওয়া হয়। দুই দিনের মধ্যে ওই প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
ঠিকাদারদের অভিযোগ, দরপত্র মূল্যায়নে অকৃতকার্য হওয়া দরদাতাদের জামানত ফেরত দেওয়ার কথা এবং কী কারণে অকৃতকার্য হয়েছে, সেটা ঠিকাদারদের জানানোর কথা। কিন্তু দরপত্র কমিটি এ নিয়ম মানেনি।
দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া মেসার্স এ অ্যান্ড জে ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক ইব্রাহিম পারভেজ বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে রেলওয়ে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, জেলা পরিষদ, এলজিইডিসহ বিভিন্ন পৌরসভায় দরপত্রে অংশগ্রহণ করে মালামাল সরবরাহ ও কাজ করে আসছি। এবারও হাটহাজারী পৌরসভার ই-জিপি দরপত্রে অংশ নিয়ে কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী কাগজপত্র অনলাইনে জমা দিয়েছি। ই-জিপি দরপত্রের নীতিমালা অনুযায়ী আমাদের প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হয়। তারপরও পৌরসভা কর্তৃপক্ষ কেন কাজটি আমাদের দেয়নি তা বুঝতে পারছি না।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘প্রকৌশলী বেলাল আহমেদ খান কাজ দেওয়ার বিনিময়ে আমাদের কাছে ৩০ লাখ টাকা ঘুষ চেয়েছিলেন। আমরা ঘুষ দিইনি বলে কাজটি পাইনি।’
মেসার্স শুভেচ্ছা ইঞ্জিনিয়ারিং পরিচালক আবু সুফিয়ান বলেন, ‘দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা ছিলাম আমরা। প্রথম সর্বনিম্ন দরদাতা কোন কারণে কাজ না পেলে সেটা ‘দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা পাওয়ার কথা। কিন্তু কাজটি আমাদেরও দেওয়া হয়নি এবং কী কারণে দেওয়া হয়নি সেটাও জানাননি প্রকৌশলী বেলাল আহমেদ খান।
সর্বোচ্চ দরদাতা হওয়ার পরও কিভাবে কাজ পেলেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মেসার্স ফিলামেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির প্রকৌশলী সিয়াম বলেন, ‘দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী অন্য ঠিকাদারদের এই কাজের অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু আমাদের সেই অভিজ্ঞতা আছে, তাই বেশি দামে পৌর কর্তৃপক্ষ আমাদের সাথে চুক্তি করেছে।’
বিশ্বব্যাংকের কোভিড-১৯ প্রকল্পের পরিচালক নাজমুল সাদাত মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান বলেন, ‘এখানে সর্বনিম্ন দরদাতা হলে তাকেই কাজ দিতে হবে, বিষয়টি এমন না। আর সড়ক বাতি স্থাপনে এক কোটি টাকা বেশি গেলেও কোন সমস্যা নেই।’
স্থানীয় সরকার বিভাগের নগর উন্নয়ন-১ এর অধিশাখার যুগ্ম সচিব আবুল খায়ের মোহাম্মদ হাফিজুল্লাহ খান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা অবগত না। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’
- বিষয় :
- ক্ষতিপূরণ