'সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের কোন নীতিমালা নেই'

আহসান রাজীব বুলবুল, কানাডা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২২ | ০০:২৫ | আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০২২ | ০০:২৫
বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্য নিয়োগের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় প্রয়োজনীয় যোগ্যতা এবং দক্ষতাবিহীন অনেকেই উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়ে যাচ্ছেন। আর তাদের কার্যকলাপের কারনেই উপাচার্যদের নিয়ে নানা বিতর্ক এবং প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক দুই উপাচার্য এবং সাবেক ডাকসু নেতা।
তারা বলেন, উপাচার্যরা সততার সাথে মেরুদণ্ড শক্ত করে দায়িত্ব পালন করলে তাদের নিয়ে কোনো বিতর্কই হতো না।
কানাডার বাংলা পত্রিকা ‘নতুন দেশ’ এর প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগর এর সঞ্চালনায় সম্প্রচারিত ‘শওগাত আলী সাগর লাইভে’র আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা এই মতামত দেন।
‘বাংলাদেশের উপাচার্যদের নিয়ে এতো প্রশ্ন কেন’ শীর্ষক এই আলোচনায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান, বাংলাদেশ উপাচার্য পরিষদের সাবেক সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. জসিমউদ্দিন আহমদ এবং ডাকসুর সাবেক এ জি এস নাসির উদ দুজা অংশ নেন। রোববার কানাডার স্থানীয় সময় দুপুরে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশ্বদ্যিালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, বাংলাদেশের নতুন জেনারেশনের ৫২টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের কোনো নীতিমালা নাই। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের আইন থাকলেও কেবলমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সেই আইনের আলোকে ভিসি নিয়োগ হয়েছে, আর কোথাও নয়।
তিনি আরও বলেন, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগের জন্য যে রিজেন্ট বোর্ড আছে তার সদস্য হচ্ছেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, তিন চার জন করে আমলা,রাজনৈতিক দলের স্থানীয় সদস্য। রিজেন্ট বোর্ডকে এরাই নিয়ন্ত্রণ করে। এদের কথামতো না চললে ওই জায়গায় কেউ দায়িত্ব পালন করতে পারবে না।
তিনি প্রশ্ন করেন, বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত রিজেন্ট বোর্ডে ৪/৫ জন আমলা কেন থাকবে, তাদের কেন সিন্ডিকেটের সদস্য করতে হবে। দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদদের এই জায়গায় নিয়োগ দিলে তাদের মেধাভিত্তিক পরামর্শে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উপকৃত হতে পারতো।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার জন্য তহবিল বরাদ্দে কোনো সমস্যা নেই উল্লেখ করে অধ্যাপক মান্নান বলেন,দু একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই গবেষনার জন্য দেয়া বরাদ্দ খরচ করতে পারে নাই। টাকা নিয়ে গবেষণার জন্য আমরা গবেষক খুঁজে পাই নাই।
যিনি যেই কাজের উপযুক্ত তাকে সেই কাজে নিয়োগ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক আবদুল মান্নান, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মঞ্চুরি কমিশন-তথা শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিটি জায়গায় যেনো যোগ্য ব্যক্তি নিয়োগ পায় তার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকাকালে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মের তদন্তের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগসহ তদন্ত রিপোর্ট শিক্ষামন্ত্রনালয়ে জমা দেয়ার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। পরে বলা হয়েছে এই সব রিপোর্ট হারিয়ে গেছে। দুই আড়াই হাজার পৃষ্ঠার রিপোর্ট কীভাবে হারিয়ে যায় প্রশ্ন তুলে অধ্যাপক মান্নান বলেন সরিষার মধ্যে ভূত থাকলে তো সেই ভূত তাড়ানো যাবে না।
উপাচার্য পরিষদের সাবেক সভাপতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. জসিমউদ্দিন আহমেদ তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের আর্থ সামজিক বাস্তবতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের উপর বিশেষ করে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের উপর নানা ধরনের চাপ থাকে।
কিন্তু উপাচার্য যদি নিজে সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেন তা হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই চাপগুলো উপেক্ষা করা সম্ভব হয়। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য গবেষনা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বর্তমানে নিয়ম শিথিল করে একটি মাত্র গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই উপাচার্য হিসেবে এমন ব্যক্তি নিয়োগ পাচ্ছেন যাদের শর্তের একটি গবেষণা সেটিও নেই। বহিঃর্বিশ্বে একটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিতি পায় তার শিক্ষক এবং তাদের গবেষণার মাধ্যমে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের গবেষণার দৈন্যদশার কারনেই আন্তর্জাতিক র্যাংকিং এ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রথম একশতের তালিকায় স্থান পায় না।
তিনি বলেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ না নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। এমনকি একই সঙ্গে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ নেন। ফলে তারা গবেষণার জন্য ইচ্ছা বা সময় কোনোটাই বের করতে পারেন না। তিনি বলেন, এদের মধ্য থেকেই অনেকে উপাচার্য হয়ে যান বলে তাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম গুরুত্ব পায় না।
ডাকসুর সাবেক এ জি এস নাসির উদ দুজা বলেন, আজকের বাস্তবতায় একটি ছাত্রসংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে। উপাচার্য মহোদয় সেই নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসতে চান কী না, না কি তারা নিজেরাও সেউ নিয়ন্ত্রনে থাকতে চান- সেটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তিনি উপাচার্যদের মেরুদন্ড সোজা করে দায়িত্ব পালনের উপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, তা না হলে সত্যিকারের জ্ঞান চর্চ্যার কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ‘নতুন দেশ’ এর প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগর কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া তুলে ধরে বলেন, স্বাধীন তৃতীয় একটি সংস্থা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খুঁজে যাচই বাছাই করে উপাচার্য পদের প্রার্থীদের সংক্ষিপ্ত তালিকা করে বিশ্ববিদ্যালয়কে দেয়। বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়াটি ভাবা যায় কী না সেই ব্যাপারে চিন্তা করার আহ্বান জানান তিনি।
- বিষয় :
- বাংলাদেশ
- বিশ্ববিদ্যালয়
- উপাচার্য নিয়োগ
- নীতিমালা