ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

জীবন গঠনে সেরা চেষ্টাটাই করে যান

এডসন এরেনতাস দো নাসিমেনতো পেলে

জীবন গঠনে সেরা চেষ্টাটাই করে যান

এডসন এরেনতাস দো নাসিমেনতো পেলে [২৩ অক্টোবর ১৯৪০-২৯ ডিসেম্বর ২০২২]

সাক্ষাৎকার থেকে অনুপ্রেরণার কথা তুলে এনেছেন মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ 

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৪ | ২৩:২৩

পেলে। ‘কালো মানিক’খ্যাত ফুটবল বিষ্ময়। অনেকের বিবেচনায় তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই ফুটবলার। কিংবদন্তি এই ফুটবলারের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে অনুপ্রেরণার কথা তুলে এনেছেন মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ 

ভালো ফুটবলার হয়ে ওঠার নেপথ্যে নিঃসন্দেহে পরিশ্রমই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমার বাবা ঠিক এ কথাটিই বোঝাতে চেয়েছিলেন; অর্থাৎ ঈশ্বর তোমাকে ফুটবল খেলার সহজাত প্রতিভা দিয়েছেন ঠিকই, তবে এটিকে ফলপ্রসূ করে তোলার জন্য তোমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে; মানুষকে সম্মান করতে হবে। ফলে কঠোর অনুশীলন করতে অভ্যস্ত হই আমি। ট্রেনিং শেষে অন্য খেলোয়াড়রা যখন সৈকতে ঘুরে বেড়াত, আমি তখন সেখানে গিয়েও অবিরাম কিক মেরে যেতাম ফুটবলে। আরেকটি কথা বলতে চাই, যদি আমি ভালো ফুটবলার হয়েও থাকি, যদি ঈশ্বর-প্রদত্ত উপহার পেয়েও থাকি, তবু মাঠে বল নিয়ে ছুটে যাওয়ার কিংবা শারীরিক সক্ষমতা ধরে রাখার প্রচেষ্টা তো আমাকেই করতে হয়েছে, তাই না?
কোনো অতিমানবিক ক্ষমতা ছিল না
না, আমার মধ্যে কোনো অতিমানবিক ক্ষমতা ছিল না। যা ছিল, তার সবই সাধারণ। শক্তি জোগায়, এমন কিছুর প্রতি আস্থা রাখতে হয়েছিল; করতে হয়েছিল কিছু জিনিসের ওপর বিশ্বাস স্থাপন; তবে ক্যারিয়ারে এমন অনেক মুহূর্তের মুখোমুখি হয়েছি, যেগুলো স্রেফ ঈশ্বরের দেওয়া উপহারের ফল হিসেবে ধরে নিতে পারিনি। যেমন, আমরা একবার আফ্রিকার নাইজেরিয়ায় গিয়েছিলাম, আর সেখানে চলতে থাকা যুদ্ধ গিয়েছিল থেমে; কেননা, লোকজন যাবে পেলের খেলা দেখাতে, এজন্য তারা যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছে। খেলা শেষ হয়ে যেতেই আবার জড়িয়ে পড়েছিল যুদ্ধে; ভাবা যায়!
প্রথম বিশ্বকাপের স্মৃতি ও বাবার কান্না
প্রথম যে বিশ্বকাপের স্মৃতি মনে করতে পারি, সেটি ১৯৫০ সালের। আমার বয়স তখন ৯-১০ বছর। বাবা ফুটবল খেলতেন। বড় একটা পার্টি দিয়েছিলেন তারা। ব্রাজিল যখন উরুগুয়ের কাছে হেরে গেল, বাবাকে কাঁদতে দেখেছি। আমি ছিলাম বাচ্চা-কাচ্চাদের সঙ্গে। বললাম, ‘বাবা, কাঁদছ কেন?’ বললেন, ‘বিশ্বকাপটি হারিয়ে ফেলল ব্রাজিল।’ শুনে আমি ইয়ার্কি করলাম; বললাম, ‘কেঁদ না, বাবা; আমি তোমাকে বিশ্বকাপ এনে দেব।’ এর আট বছর পর, ব্রাজিল যখন সুইডেনে অনুষ্ঠিত ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপ জয় করল, আমিও ছিলাম সেই দলের খেলোয়াড়। এ ব্যাপারটিকে ব্যাখ্যা করা কঠিন। জানি না কেন আমি সেই দলে ছিলাম; স্রেফ জানি, দলে জায়গা পেয়েছিলাম এবং বিশ্বকাপ জিতে এসেছি। বয়স আমার তখন সতেরো বছর। বিশ্ব ফুটবলের মানচিত্রে ব্রাজিল তখনও বড় কোনো নাম ছিল না; অথচ বিশ্বকাপ জয়ের পর রাতারাতি একটি বিশাল ফুটবল জাতিতে পরিণত হলো। 
আব্বু, আমরা জিতেছি
ব্রাজিলকে সারা পৃথিবীতে বেশ ভালোভাবে পরিচিত করতে পেরেছি বলে আমি গর্বিত। এখনকার সময়ে, প্রযুক্তির কারণে, বালকরা গোল করে দৌড়ে এসে ক্যামেরার সামনে বলতে পারে, ‘আব্বু, তোমাকে ভালোবাসি’; আর এ কথাটি মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় সারা বিশ্বে। আমাদের সময়ে, হয়তো আমার বাবা খেলা দেখেছেন ঠিকই, হয়তো তিনি জানতেন, আমরা জিতেছি; কিন্তু আমাদের কোনো টিভি ছিল না, ছিল না এমনতর যোগাযোগ ব্যবস্থা। রাতে শেষ হওয়া খেলার অনুভূতি পরের দিন সকালে সুইডেনের রেডিওতে গিয়ে আমরা জানাতে পেরেছি; যেন ব্রাজিলে বসে শুনতে পায়, ‘আব্বু, আমরা জিতেছি।’ সেই দিনগুলো কখনোই ভুলব না।
আমার সেরা চেষ্টাটাই করে গেছি
খেলা সবসময় খেলাই ছিল। তবে টাকা উপার্জনের জন্য আমাদের সারা বছর ঘুরে বেড়াতে হতো। ধরুন জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে আমরা খেলে বেড়াতাম লাতিন আমেরিকায়। খেলা শেষ হলে টাকা পেতাম। তারপর গ্রীষ্মে চলে যেতাম ইউরোপে। সেখানেও খেলা শেষ হলে মিলত টাকা। এখনকার খেলোয়াড়দের তো স্পন্সর আছে; তাদের এভাবে ঘুরে বেড়ানোরও দরকার পড়ে না। আমাদের সময়ে, আমরা পৃথিবীজুড়ে ফুটবল খেলে বেড়াতাম। সময় এখন পাল্টে গেছে। হয়তো এটিই আমাকে তরুণদের কাছে একটি উদাহরণ করে তুলেছে। তবে মরে গেলেও আমি খুশি থাকব; কেননা, আমি আমার সেরা চেষ্টাটাই করে গেছি। আমার খেলা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে; কেননা, এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খেলা।
ঈশ্বরের উপহার ও অন্যদের সম্মান
ছোটবেলায় অন্য শিশুদের চেয়ে ভালো খেলতাম বলে ওদের খুব হেয় করতাম। একদিন বাবা বললেন, ‘শোনো। ঈশ্বর তোমাকে ফুটবল খেলার বিশেষ গুণ দিয়েছেন বলে বাচ্চাদের সঙ্গে এমন করো না। তুমি আসলে কিছুই না। এ স্রেফ ঈশ্বরের একটা উপহার। ফলে অন্যদের সম্মান করতে শেখো; কেননা, একজন ভালো মানুষ হওয়া, ভালো ব্যক্তিত্ব হওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ। এখন থেকে তোমাকে সেটির জলজ্যান্ত উদাহরণ হয়ে উঠতে হবে।’

আরও পড়ুন

×