ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

বিশেষ লেখা: মুক্তপ্রাণ মুক্তধারা

বিশেষ লেখা: মুক্তপ্রাণ মুক্তধারা

লোগো

আবুল কালাম আজাদ

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৫:১১ | আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৪:৫৬

‘অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস’– বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই ধ্রুপদি বাক্যকে শিরোধার্য করে ২০০৫ সালের ৩১ মে সমকালের যাত্রা শুরু। রুদ্ধশ্বাস রাজনীতি থেকে অর্থনীতির ঘূর্ণায়মান বৃত্ত– এসবের মধ্যে দেশের মানুষের যাপিত জীবনের কড়চা সমকাল। এক নতুন রাষ্ট্রনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় সমকাল পা রেখেছে আত্মপ্রকাশের ২০তম বছরে। 

এ মুহূর্তে ইতিহাসের নতুন এক কালপর্ব যাপন করছে বাংলাদেশ। জুলাই-আগস্টজুড়ে আমরা দেখেছি অসামান্য গণঅভ্যুত্থান, দেখেছি কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী ও জনতার অভূতপূর্ব প্রতিরোধ ও বিজয়। নিয়মিত বিরতিতে এ দেশে নানা সময়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু এবারের অভ্যুত্থানে জাতি-গোষ্ঠী-পেশা নির্বিশেষে সর্বস্তর ও সর্বাবস্থানের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ও নির্ভীক অংশগ্রহণ সর্বজনীন এক বার্তা উপস্থাপন করে। প্রমাণিত হয়েছে, নিপীড়ন চালালে এর সুদূর-পরিণতি কখনও ভালো হয় না। মানুষ সহনশীল জীব। এর অর্থ এই নয় যে, ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে তাকে চিরকাল দাবিয়ে রাখা যাবে। ইতিহাসে আমরা এর আগেও দেখেছি, ভবিষ্যতেও দেখব, দাম্ভিক শাসকের করুণ পতন সুনিশ্চিত। এ অভ্যুত্থানে আমরা দেখেছি শ্রমজীবী থেকে শুরু করে নিয়মিত লেখাপড়ায় অভ্যস্ত শিক্ষার্থী, আদিবাসী থেকে প্রবাসী, কেন্দ্রিক থেকে প্রান্তিক সবার নির্লোভ ও স্বপ্নময় অংশগ্রহণ। তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের প্রতিরোধ ছিল নির্মম। সড়কপথ, আকাশপথ নির্বিশেষে রাষ্ট্রযন্ত্রের এমন বেপরোয়া আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার আমরা ইতোপূর্বে দেখিনি। আর কোনো গণঅভ্যুত্থানে দেশজুড়ে এত বিপুল মানুষ শহীদ হননি। 

আন্দোলন চলাকালে সারাদেশ ভরে গেছে নান্দনিক গ্রাফিতিতে, আশ্চর্য সব দেয়াল লিখনিতে। পুলিশবিহীন দিনগুলোতে শিক্ষার্থীরা যান চলাচল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও পরিচ্ছন্নতার কাজ স্বেচ্ছাশ্রমে করে গেছে। এবং সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়েও প্রাণ দিয়েছে তারা। পিছু হটেনি। বিপুল মানুষের প্রতিরোধ ও আত্মত্যাগে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অর্গল খুলে গেছে; মুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের পথে হাঁটতে শুরু করেছে বাংলাদেশ।

তাই আমাদের এবারের প্রত্যয়– ‘মুক্তপ্রাণ মুক্তধারা’। এই প্রত্যয়কে উপজীব্য করে তিন পর্বে সমকালের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে। আজ প্রকাশিত হলো প্রথম পর্ব। তিন পর্বে আয়োজিত বিশেষ সংখ্যায় বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীগণের চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মাত্রা, প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পত্রস্থ হচ্ছে। থাকছে গণঅভ্যুত্থানের অসামান্য গ্রাফিতি, দেয়াল লিখন ও আলোকচিত্রের সন্নিবেশ। একইসঙ্গে বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকারসহ আরও প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয়ে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের সুচারু বিশ্লেষণ মানবিক-সামাজিক-রাষ্ট্রিক সত্যের সারাৎসার উপস্থাপন করেছে। আমাদের বিশ্বাস, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সুবিশাল আয়োজন পাঠককে সমৃদ্ধ করবে এবং এর মধ্য দিয়ে একটি মুক্ত ও মানবিক সমাজ নির্মাণের পথে নতুন চিন্তা ও ভাবনার অনুষঙ্গ পাওয়া যাবে।

আমরা গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ত্রিশ লাখ মানুষকে, হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যাদের আত্মত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে প্রিয় মাতৃভূমি। মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা, লড়াকু বীরাঙ্গনা, স্বজন হারানো অজুত মানুষের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞতা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের প্রতি। আন্দোলেন অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী, জনতাসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষের প্রতি আমাদের অভিবাদন। আমাদের অতীত মন্দ কৃতকর্মের দিকে ফিরে তাকানোর সুযোগ করে দেওয়া এ গণঅভ্যুত্থান জাতির জন্য বড় সুযোগের দ্বার খুলে দিয়েছে। এর সুফল গ্রহণ করতে হলে, অভ্যুত্থানকালীন বাস্তবতার মতো এখনও সব মত ও পথের অবিচ্ছিন্ন ঐক্য প্রয়োজন। একতাবদ্ধ থেকে পরস্পরকে সহায়তা করে ভুলের পুনরাবৃত্তি রোধ করে দিতে হবে। এ কারণে প্রয়োজন স্বচ্ছতা ও সুস্থ সমালোচনার পরিবেশ এবং সুস্থ ধারার গণমাধ্যমের অপার স্বাধীনতা। 

গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের একটি অনুপম ঐক্যের দিক রয়েছে। গণতন্ত্রের স্তম্ভ হচ্ছে– গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব, সমদর্শিতা, ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা। এগুলো গণমাধ্যমেরও স্তম্ভ। গণমাধ্যম যখন তার স্তম্ভে ভর করে দৃঢ় ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে কাজ করতে পারে, তখন গণতন্ত্রও সুরক্ষিত হতে থাকে। এই সত্য হৃদয়ে রেখে প্রতি ভোরে পাঠকের হাতে নতুন একটি সমকাল আমরা পৌঁছে দিতে চাই। প্রগতিশীল সমাজ নির্মাণের যে অভিযাত্রা বাংলাদেশে চলে এসেছে, সমকাল বরাবরই তার বিনম্র সহযাত্রী। কেবল পত্রিকা প্রকাশ নয়, আমরা রাষ্ট্র ও সমাজ-চিন্তা কাঠামোয় অংশ নিতে চাই এবং সমাজের মৌলিক চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রেও অংশী হতে চাই। 

সমকালের যাত্রাপথে সাফল্যের পেছনে রয়েছে পাঠকদের অকৃত্রিম ভালোবাসা। ছাপা পত্রিকার পাশাপাশি দেশে-বিদেশে সমকালের অনলাইনে রয়েছেন বিপুলসংখ্যক পাঠক। সকল পাঠকের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। অভিনন্দন জানাই শুভানুধ্যায়ী, বিজ্ঞাপনদাতা, হকার, এজেন্টসহ সকলকে– যাদের সম্মিলিত অংশগ্রহণে সমকাল এতটা পথ পাড়ি দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। আমাদের সমুদ্রগামী যাত্রা অব্যাহত থাকবে। আমরা মনে করি, একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, উদার মানসিকতার দৈনিক পত্রিকা হিসেবে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে সমকাল দিনে দিনে আরও সচেষ্ট হয়ে উঠবে। মুক্তপ্রাণের মুক্তধারায় স্নাত হোক প্রাণবন্ত স্বদেশ, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই আমাদের বিনীত নিবেদন। 

লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, সমকাল

আরও পড়ুন

×