ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

নৃত্যের তালে যেভাবে সুস্থ থাকে মস্তিষ্ক

নৃত্যের তালে যেভাবে সুস্থ থাকে মস্তিষ্ক

ফাইল ছবি

মেহবুবা মাহনুর চাঁদনী

প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৪ | ২৩:২৬

নাচ শব্দটি শুনলে অনেকেই মনে করেন এটি কেবল বিনোদনের কোনো উপায় বা অবসরে করার মতো কাজ; অথবা বড়জোর গান, বিতর্ক, অভিনয় বা খেলাধুলার মতো কোনো সহশিক্ষা কার্যক্রম (এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটি)। অনেকে এটাও মনে করেন, শিশুর সাধারণ শিক্ষার্জনকে আকর্ষণীয় করে তোলা ছাড়া এসবের আর বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই। আবার অনেকের ভাবনায় এটিও আসে যে, এতে শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে; শিশুর শিক্ষা গ্রহণ ব্যাহত হচ্ছে। আসলেই কি তাই! 
নাচ বিষয়ে গবেষকরা একদমই ভিন্ন তথ্য দিচ্ছেন। তারা জানাচ্ছেন, নাচ মস্তিষ্কের সামগ্রিক বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা শিশুর শিক্ষার্জন ও পরবর্তী জীবন গঠনে ইতিবাচক প্রভাব রাখে। কেবল প্রথাগত পড়াশোনা আর পরীক্ষার মাধ্যমেই শিশুর শিক্ষার্জন সম্ভব–এমন ধারণা থেকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বের হয়ে আসছে। শিশুর সামগ্রিক বিকাশ নিশ্চিত করতে এখন নাচ-গান, বিতর্ক বা খেলাধুলার মতো সহশিক্ষা কার্যক্রমকে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। বিশেষত সঠিকভাবে শিক্ষা অর্জন করা, শরীর ও মনের যথাযথ উন্নয়ন এবং ভবিষ্যতের জীবন গঠনে ইতিবাচক মানসিকতা গড়ে তুলতে নাচকে শিক্ষার অন্যতম জরুরি অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। 
আলবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অব মেডিসিনের বিজ্ঞানীরা ২০০৩ সালে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেন। সেখানে বিশ্রামকালীন কার্যক্রম কীভাবে বয়স্ক মানুষের মাঝে ডিমেনশিয়ার (মানসিক বৈকল্য; স্মৃতি সংরক্ষণ, চিন্তাভাবনা করা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা কমে যাওয়া) ঝুঁকি বাড়াতে ভূমিকা রাখে তার ফলাফল উঠে আসে। সাইক্লিং, গলফ, টেনিস বা সাঁতারের মতো ১১টি শারীরিক ব্যায়ামের ওপর পরিচালিত এ গবেষণায় দেখা যায়, বয়সকালে ডিমেনশিয়া প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখে নাচ। এতে আরও দেখা যায়, নাচের সঙ্গে সম্পর্কিত সামাজিক যোগাযোগ ও মানসিক প্রচেষ্টা ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমিয়ে আনতে সক্ষম।
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা রাজ্যের মিনোট স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। সেখানে দেখা যায়, লাতিন-প্রভাবিত ‘জুম্বা’ নাচ দৃষ্টিশক্তি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষমতা বাড়ানোসহ বেশ কিছু কগনিটিভ ও মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নাচ মানসিক অবসাদ কমাতে, সেরোটোনিন (মস্তিষ্ক ও শরীরের মধ্যে বার্তাবহনকারী হরমোন; যা ঘুম, হজম, ক্ষত সারানো, রক্ত জমাট বাঁধা, মুড নিয়ন্ত্রণের মতো আরও নানা শারীরিক কার্যক্রমে অবদান রাখে) নিঃসরণ বাড়াতে এবং মস্তিষ্কে নতুন সংযোগ (নিউরন) তৈরি করতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। 
শিক্ষা গ্রহণ, চিন্তা, সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিমত্তার মতো বিষয়গুলোতে মস্তিষ্ক ও শরীর একসঙ্গে কাজ করে। এ ক্ষেত্রে নাচ শরীরের কর্মক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে মস্তিষ্কের সামগ্রিক বিকাশকে এগিয়ে নিয়ে যায়। নাচের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও মুদ্রা স্মরণশক্তি বাড়াতে সহায়তা করে, দ্বৈত বা দলীয় নাচে সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি পায়, সবার সামনে নাচ উপস্থাপনে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। এ ছাড়া নাচের মাধ্যমে শরীর ভারসাম্য রক্ষা করতে শেখে, পেশি সুগঠিত ও শক্তিশালী হয়; নাচ অনুশীলনকারীরা মানসিকভাবে স্থির ও সৃজনশীল হয়; নিজেকে প্রকাশ করার মাধ্যমে তারা আবেগীয় দক্ষতার দ্রুত বিকাশ ঘটাতে পারে। যেসব শিক্ষার্থী নিয়মিত নাচ অনুশীলন করে তারা সময়ানুবর্তী ও নিয়মানুবর্তী হয়। ধারাবাহিক অনুশীলনের মাধ্যমে তাদের মধ্যে নিষ্ঠা, নেতৃত্বের গুণাবলি ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্ব বিকাশে এ বিষয়গুলো অত্যন্ত কার্যকরী হয়। 
শিশুর শরীর, মন ও মস্তিষ্কের বিকাশ শৈশবেই শুরু হয়। তাই, এ সময়েই তাদের বিজ্ঞান, গণিত বা ভাষার মতো সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি, নাচের মতো গুরুত্বপূর্ণ সহশিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে পরিচিত করানো জরুরি। পুরোনো ধ্যান-ধারণা থেকে বের হয়ে এসে শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, আবেগীয় উন্নয়নসহ সামগ্রিক বিকাশে মনোযোগী হওয়ার এটাই যথার্থ সময়। v
লেখক: নৃত্য প্রশিক্ষক, গ্লেনরিচ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল 
 

আরও পড়ুন

×