প্রচ্ছদ
ব্লাউজে বৈচিত্র্য

তাসলিমা তামান্না
প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৪ | ১০:১৩
রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সামিয়া। কয়েকদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে বান্ধবীরা মিলে শাড়ি পরার পরিকল্পনা করেন। শাড়ি আগে থেকেই পছন্দ করা ছিল। বিপত্তি বাধে ব্লাউজ নিয়ে। শাড়ি পরার পর তাঁর মনে হচ্ছিল, ব্লাউজের কারণে শাড়িটাই ম্লান দেখাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কন্ট্রাস্টের একটা ব্লাউজ কিনে শাড়ি দিয়ে পরার পর হাসি ফুটল সামিয়ার মুখে। কারণ, এবার তার সাজপোশাকে একটা জমকালো ভাব ফুটে উঠেছে।
শুধু সামিয়া নয়, আজকাল শাড়ি পরার ক্ষেত্রে নারীরা ফ্যাশনেবল ট্রেন্ডি ব্লাউজ পছন্দ করছেন। ব্লাউজ এখন আর শুধু শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে পরার অনুষঙ্গ নয়, ফ্যাশনের ক্ষেত্রে যোগ করেছে ভিন্ন মাত্রা। ব্লাউজের ব্যতিক্রমী ডিজাইন আর কাটিং শাড়ির লুক আরও নান্দনিক করে তুলতে পারে।
ফ্যাশন প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল। সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব বাড়িয়ে তোলাটাই ফ্যাশনের মূল লক্ষ্য। সব বয়সীই চান অন্যের সামনে নিজের সৌন্দর্যকে মেলে ধরতে। ফ্যাশনের ক্ষেত্রে পোশাকের গুরুত্ব অপরিসীম। ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, উৎসবে, যে কোনো অনুষ্ঠানে অথবা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে পোশাকের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। আর বাঙালি সংস্কৃতিতে শাড়ির তুলনা কিছুর সঙ্গেই করা যায় না; তা যতই সালোয়ার-কামিজ, কুর্তি, পশ্চিমা পোশাক কিংবা অন্যান্য পোশাক আলাদা জায়গা করুক না কেন। বিয়ে, নিমন্ত্রণ কিংবা যে কোনো উৎসবে তরুণী থেকে শুরু করে সব বয়সী নারী শাড়িকে প্রধান পোশাক হিসেবে বেছে নেন। শাড়ির সৌন্দর্য সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে ডিজাইনাররা ব্লাউজের ফ্যাশনের ক্ষেত্রে আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছেন।
একটা সময় এ উপমহাদেশে শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ পরার চল ছিল না। বাড়িতে তো বটেই, বাড়ির বাইরেও সেভাবে ব্লাউজ পরতেনও না বাঙালি নারীরা। ঠিক কবে থেকে এ অঞ্চলে ব্লাউজ পরার রীতি এলো তা নিয়ে ঐতিহাসিক মতভেদ রয়েছে। অনেকে বলেন, ইংরেজ শাসনামলে রানী ভিক্টোরিয়া প্রথম শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ ব্যবহার করেন। এর পর থেকেই এখানকার মানুষের মধ্যে বিশেষ করে সমাজের ওপরতলার মানুষের মধ্যে প্রথমে ব্লাউজ পরার রীতি শুরু হয়। পরে তা সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। আবার কারও কারও মতে, ব্লাউজের প্রচলনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের যোগ আছে। কবিগুরুর বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী স্বামীর সঙ্গে গুজরাটে গিয়ে পার্সি নারীদের শাড়ি পরার ধরন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুনভাবে শাড়ি পরা শুরু করেন। তিনি শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ পরতেন। তার পর থেকে বাঙালি নারীদের মধ্যে ব্লাউজ পরার চল শুরু হয়। সেই সময় বড় হাতার ব্লাউজই ছিল ফ্যাশন। পরে তা বিভিন্ন ধরনের হাতায় পরিবর্তিত হয়।
ডিজাইনারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে কোনো পোশাকের ক্ষেত্রে আরাম এবং স্বস্তির ব্যাপারটি বেশি গুরুত্ব পায়। আমাদের দেশ গরমপ্রধান হওয়ায় ডিজাইনাররা টপ ঘরানার ও স্লিভলেস ব্লাউজ তৈরি করছেন। এর পাশাপাশি দেশীয় ফ্যাশন ট্রেন্ডের সঙ্গে পাশ্চাত্যের মিশ্রণ ঘটিয়েও তৈরি হচ্ছে ব্লাউজ। ডিজাইনাররা জানান, বৈচিত্র্য আনতে ব্লাউজের হাতা এবং গলার কাটিংয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
বর্ণন লাইফস্টাইলের স্বত্বাধিকারী ফারজানা মঈন জানান, বিভিন্ন সময়ের উপযোগী ও আরামের কথা চিন্তা করে এখন ট্রেন্ডি ব্লাউজ তৈরি হচ্ছে। ফেব্রিকের ক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করছেন নিট, সিল্ক ও ধুপিয়ান কাপড়। গর্জিয়াস লুক আনতে ব্লাউজগুলোয় হ্যান্ডওয়ার্ক, এমব্রয়ডারি ও কাটিং-সুইং করছেন তারা।
ফারজানা মঈন জানান, ব্লাউজগুলোর কোনোটার নেকলাইনে আছে ভারী এমব্রয়ডারি, আবার কোনোটায় ব্যাকপার্টে আছে ভারী এমব্রয়ডারি ওয়ার্ক ও টার্সেল। কোনো কোনো ব্লাউজে লেইস দিয়ে নেকলাইন ও স্লিভে কুচি দেওয়া আছে, আবার কোনো কোনো ব্লাউজে নেকে লেইস ব্যবহার করে ভিন্ন লুক আনা হয়েছে।
হাইনেক, অব দ্য শোল্ডার, সুইটহার্ট নেকলাইন এখন খুবই ট্রেন্ডি। দেশের গরম আবহাওয়া বিবেচনায় স্লিভলেস ব্লাউজের আলাদা গুরুত্ব আছে। নুডলস স্ট্র্যাপ থেকে শুরু করে কাঁধে একটু চওড়া অংশ রেখে স্লিভলেস ব্লাউজ পছন্দ করছেন অনেকে।
লো নেক, হাই নেক, পাফ স্লিভ, বেল স্লিভ, এলবো স্লিভসহ বিভিন্ন ধরনের ব্লাউজ আজকাল বেশ চলছে বলে জানান ফারজানা মঈন। এগুলো শর্ট আবার লং লেন্থের আছে। ব্লাউজগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে শর্টগুলো শাড়ি আর লং লেন্থের ব্লাউজগুলো জিন্সের সঙ্গে টপস হিসেবে পরা যায়।
গরমে লো নেক, শর্ট স্লিভ অনেকের পছন্দ বলে জানান তিনি। নিট ফেব্রিকের তৈরি ব্লাউজগুলো আরামদায়ক হওয়ায় এগুলো এ সময়ে পরার উপযোগী বলে মত ফারাজানার।
ব্লাউজের হাতা : ব্লাউজের হাতার ডিজাইন প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। বর্তমানে স্লিভ-ভিক্টোরিয়ান, রেট্রো, পাফ, লেয়ার্ড, রাফলেস, বেল হাতার ব্লাউজ বেশ টেন্ড্রি।
কন্ট্রাস্ট ব্লাউজ : একসময় শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে ব্লাউজ পরাটাই ছিল ট্রেন্ড। এখন শাড়ির সঙ্গে কনট্রাস্ট ব্লাউজ পরার ট্রেন্ড চলছে। এ ধরনের ব্লাউজের সুবিধা হলো, একই ব্লাউজ বিভিন্ন শাড়ির সঙ্গে পরা যায়। সাজে যারা ট্র্যাডিশনাল লুক পছন্দ করেন, তাদের কাছে কনট্রাস্ট করে পোশাক পরা ছাড়া খুব একটা বিকল্প নেই। ব্লাউজের ক্ষেত্রেও তাই। তবে কনট্রাস্ট করারও একটা ব্যাকরণ আছে, সেটি না মেনে চললে দেখতে ভালো লাগবে না।
মনে রাখবেন, হালকা এবং গাঢ় রঙে ভালো কনট্রাস্ট হয়। যেমন– সাদা আর কালো হচ্ছে খুব ভালো কনট্রাস্ট বা বৈপরীত্য। সেই নিয়ম মেনেই সাদা এবং লালও দারুণ। শেডের লাইট আর ডার্ক টোন দিয়েও খুব ভালো কন্ট্রাস্ট করা সম্ভব। একাধিক শেডের মধ্যেও কনট্রাস্ট করানো যায়।
বিভিন্ন ধরনের জ্যামিতিক নকশা দিয়ে তৈরি কনট্রাস্ট ব্লাউজ পরতে পারেন। একরঙা শাড়ির সঙ্গে প্রিন্টেড ব্লাউজ এখন বেশ ট্রেন্ডি। তবে রঙের ব্যবহারে যেন একটা ভারসাম্য থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখুন।
ফিউশন: নতুনের সঙ্গে পুরোনোর মিশেল হিসেবে ব্লাউজের ডিজাইনে কয়েক বছর ধরে ফিউশন দেখা যাচ্ছে। পুরোনো ধারা অনুযায়ী ফাঁকা, ব্যাকলেস ব্লাউজগুলো সব সময়ই ট্রেন্ডি। কারও আবার পছন্দ পিঠে ফিতা বা নুডলস স্ট্র্যাপের জিগজ্যাগ করা ব্লাউজ। সাধারণ শাড়ির সঙ্গে এসব ডিজাইনের ব্লাউজ পরলে বেশ আকর্ষণীয় দেখাবে।
শাড়ির সঙ্গে মানানসই ব্লাউজ: শাড়ির সঙ্গে মানানসই ব্লাউজ না পরলে সাজটাই মাটি হয়ে যায়। আপনার ব্লাউজ যেন খুব ঢিলে বা খুব চাপা না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখুন। কারণ ব্লাউজ ঢিলে হলে যেমন ভালো দেখায় না, তেমনি খুব চাপা ব্লাউজ পরলেও অস্বস্তি লাগবে। তাই শাড়ি পরার সময় ব্লাউজের ফিটিংয়ে অবশ্যই খেয়াল রাখুন। তবে পরিবেশ, অনুষ্ঠান, বয়স ও রুচির কথা মাথায় রেখে ব্লাউজ নির্বাচন করাটা জরুরি।
এ ব্যাপারে ডিজাইনার মৌনতা আলম বলেন, শারীরিক গঠনের ওপর ব্লাউজের ডিজাইন অনেকটা নির্ভর করে। সব ধরনের ব্লাউজ আসলে সবার জন্য নয়। যাদের গঠন একটু মোটা ধাঁচের তারা স্লিভলেসের বদলে ফুলস্লিপ, বোট নেক পরলে ভালো দেখাবে। আবার যাদের শারীরিক গঠন স্লিম ধরনের তারা স্লিভলেস পরলে সহজেই মানিয়ে যায়। যে কোনো উৎসব অনুষ্ঠানে গাঢ় রঙের ব্লাউজ পরলে ভালো দেখাবে। যেমন– লাল, নীল, কমলা, সবুজ, সি গ্রিন, বেগুনি ইত্যাদি। বিভিন্ন শাড়ি দিয়ে পরার জন্য এ রকম কয়েকটি রঙের ব্লাউজ সংগ্রহে রাখতে পারেন। গরমের সময় হালকা রং যেমন গোলাপি এবং টারকোয়াইজ ব্লুর ওপর সিলভারের কাজ করা, সাদা, হালকা ক্রিম রঙের ব্লাউজ বেশি চলে। এসব ব্লাউজ শুধু সুতি নয়, সিল্ক, শিফন, জর্জেট শাড়ির সঙ্গেও পরা যায়। শাড়িটা যদি একটু সাদামাটা হয় তাহলে এর সঙ্গে ভারী কারুকাজ ও নকশা করা ব্লাউজ ভালো মানাবে। একইভাবে শাড়ি যদি খুব জমকালো শিফনের বা সিল্কের হয় তাহলে তার সঙ্গে খুব বেশি জমকালো ব্লাউজ না পরলেও চলে।
দামদর: ব্লাউজের কাজ এবং মেটেরিয়াল অনুযায়ী এর দাম নির্ধারণ করা হয়। সাধারণত ৩০০ থেকে শুরু করে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত তৈরি ব্লাউজ বাজারে পাওয়া যায়। এ ছাড়া রয়েছে পার্টি ওয়্যার ব্লাউজ। বিভিন্ন মার্কেটের পাশাপাশি অনলাইন পেজ থেকেও কিনতে পারেন পছন্দের ব্লাউজটি।
ব্লাউজের যত্ন
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ডিজাইনের ব্লাউজগুলো উৎসব আয়োজনেই পরা হয়। বাকি সময় অযত্নে পড়ে থাকে। এটা ঠিক নয়। এ কারণে কেনার সঙ্গে সঙ্গে ব্লাউজ সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রেও অনেক যত্নের প্রয়োজন। ঘামে ভিজে গেলে ব্লাউজটি খোলা বাতাসে শুকিয়ে সংরক্ষণ করুন। নকশাদার ব্লাউজ সব সময় ড্রাইওয়াশ করানোই ভালো। সুতির তৈরি ব্লাউজ ভাঁজ করে রাখতে পারেন। অন্যান্য ফেব্রিকের ব্লাউজ হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখলে অনেক দিন ভালো থাকবে।
- বিষয় :
- পরিকল্পনা