ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

মিথোম্যানিয়া

অকারণে মিথ্যা বলা রোগ

অকারণে মিথ্যা বলা রোগ

.

ফারহানা ইয়াসমিন

প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ২২:৫৮

মিথ্যা কথা বলা সরাসরি কোনো রোগ নয়। এটি একটি অপরাধ। তবে অকারণে মানুষের প্রতিনিয়ত মিথ্যা কথা বলা কিংবা বানিয়ে বানিয়ে এবং বাড়িয়ে বাড়িয়ে কথা বলাটা এক ধরনের রোগ। যার নাম মিথোম্যানিয়া। তবে কেউ কেউ এই রোগের নাম দিয়েছেন প্যাথলজিক্যাল লাইয়িং। একাধিক গবেষণা বলছে, মানুষ কারণে-অকারণে দৈনিক গড়ে ১ দশমিক ৬৫টি মিথ্যা কথা বলে। 
উদাহরণে স্পষ্টতা: ধরুন, আপনি আপনার বান্ধবীর কাছে গল্প বলছেন, স্বামী ১৫-২০ ভরি গহনা কিনে দিয়েছে, ডায়মন্ডের হার-আংটি গিফট করেছে কিংবা আপনি মালদ্বীপ ও থাইল্যান্ডে ট্যুর দিয়ে এসেছেন, কিন্তু এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। অর্থাৎ, আপনি যা বলছেন তা সত্য নয়; বরং বাড়িয়ে বাড়িয়ে অনেক কিছু বলছেন। এমন ধরনের গপ্পো আসলে এক ধরনের রোগ, যার নাম মিথোম্যানিয়া। 
কেন মানুষ অকারণে মিথ্যা কথা বলে? 
মনস্তাত্ত্বিক কারণ: প্রায় দেখা যায়, আমাদের চারপাশের কিছু মানুষ অকপটে মিথ্যা বলে যাচ্ছে এবং তারা এমনভাবে মিথ্যা বলে যাচ্ছে, যেন তারা একেকজন স্টোরিটেইলার। তাদের গল্পে নেই কোনো সত্যের ছাপ, কিন্তু সেটা অনুধাবন করা প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার আমাদের জন্য। আসলে কেন তারা মিথ্যা বলে?
তারা আত্মমর্যাদার অভাববোধ করে। এ জন্য তারা মানুষের মনোযোগ পাওয়ার জন্য বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে।
অতীতের কোনো মানসিক চাপ, নির্যাতন কিংবা ট্রমা, ব্যক্তির মধ্যে মিথ্যা বলার প্রবণতা সৃষ্টি করে। নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার (NPD), সাইকোপ্যাথি, বা অ্যান্টি-সোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের মতো মানসিক সমস্যাগুলো তাদের মিথ্যা বলতে বাধ্য করে।
সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণ: একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে তার সামাজিক 
ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি অনেকটা দায়ী। আবার একইভাবে একটি শিশুর শারীরিক এবং মানসিক অস্থিরতার (যেমন– বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলা) পেছনেও তার সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা দায়ী।
পরিবার, সমাজ এবং আত্মীয়স্বজনের অতিরিক্ত প্রত্যাশা এবং চাপের কারণে শিশুদের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই মিথ্যা বলার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। কারণ, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ না করার জন্য তারা ছোটবেলা থেকেই পরিবার, সমাজের চাপ মোকাবিলা করার জন্য টুকটাক মিথ্যা বলা শুরু করে। এভাবে তাদের মধ্যে মিথ্যা বলার তীব্র প্রবণতা দেখা যায়।
নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের জন্য অনেকেই মিথোম্যানিয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া ত্রুটিগত প্যারেন্টিংয়ের কারণে মিথ্যা বলার প্রবণতা ছোটবেলা থেকেই মানুষ রপ্ত করে।  
জৈবিক কারণ: জৈবিক কারণে মানুষের মধ্যে মিথ্যা বলার তীব্র প্রবণতা দেখা যায়। যেমন–
গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের কিছু নির্দিষ্ট অংশ যেমন প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের কার্যকারিতার ব্যাঘাত মিথ্যাচারের প্রবণতার সঙ্গে সম্পর্কিত।
নিউরোট্রান্সমিটার ব্যালান্সের সমস্যাও মিথোম্যানিয়ার আরেকটি জৈবিক কারণ হতে পারে।
মিথোম্যানিয়ার পরিণতি
মিথ্যাচারের কারণে পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাসের পাহাড় দেখা দেয়, যা তাদের মধ্যকার সম্পর্ক ভেঙে দেয়। ক্রমাগত মিথ্যা বলা এবং তা ধরে রাখার চেষ্টায় মানসিক চাপ ও উদ্বেগ তৈরি হয়, যা ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।
মিথ্যাচার অনেক সময় আইনগত সমস্যায় ফেলে দিতে পারে। তা ছাড়া সামাজিকভাবে অসম্মান এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মতো সমস্যাও হতে পারে। ক্রমাগত মিথ্যাচার একজন ব্যক্তির আত্মপরিচয়ের সংকট তৈরি করে এবং তার নিজের প্রতি এবং অন্যের প্রতি বিশ্বাস কমে যায়।
করণীয় কী?
মিথোম্যানিয়া, একটি জটিল মানসিক অবস্থা, যা চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ জন্য সঠিক মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা এবং সঠিক পরিবেশের প্রয়োজন। তাই এই সমস্যা সমাধানে পরিবার ও সমাজের দায়িত্বশীলতা এবং মনস্তাত্ত্বিক সচেতনতার গুরুত্ব অপরিসীম।
এ ছাড়া তারা যখন মিথ্যা বলে, তখন তাদের অবহেলা, হেয় কিংবা তিরস্কার করা যাবে না। তবে তাদের মিথ্যা কথাও মনোযোগ দিয়ে শোনা যাবে না। তখন আলোচনার বিষয় পরিবর্তন করে তাদের মিথ্যা বলার মনোযোগ সরিয়ে দিতে হবে। v

সূত্র: কাউন্সেলিং ডিরেক্টরি, হোপথেরাপি
মডেল: ফাতেমা; ছবি: কাব্য

আরও পড়ুন

×