ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

স ম সা ম য়ি ক

‘অনলাইন সচেতনতা বাড়াতে হবে’

‘অনলাইন সচেতনতা বাড়াতে হবে’

.

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া

প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৫ | ২৩:৫৯ | আপডেট: ২৯ জুন ২০২৫ | ১৮:৩৭

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয়, প্রেম, অতঃপর ভবিষ্যতে স্বপ্নীল জীবনের টানে প্রিয়জনের হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে অন্ধকার জগতে পা ফেলা। কেউ সেখান থেকে বেরোতে পারে, আবার কেউ পারে না। সম্প্রতি এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে নোয়াখালীর একজন নারীর সঙ্গে। জেলার সুধারাম উপজেলার দশম শ্রেণির এক মাদ্রাসাছাত্রীকে ফেসবুকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ঢাকায় এনে ধর্ষণ ও যৌনপল্লিতে বিক্রির অভিযোগে সাতক্ষীরার দুই তরুণের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ভুক্তভোগীর মা। ২১ জুন সুধারাম থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করা হয়। মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ৬ মে সাতক্ষীরার এক তরুণের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে ওই ছাত্রী বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঢাকায় যায়। যাত্রাবাড়ীর এক হোটেলে তাকে প্রায় ২০ দিন আটকে রেখে একাধিকবার ধর্ষণ করা হয়। পরে ওই তরুণের এক বন্ধু ঢাকার একটি যৌনপল্লিতে মেয়েটিকে বিক্রি করে দেয়। সেখানে ১০ দিন আটকে থাকার পর আরেক নারীর ফোনে মেয়েটি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ‘প্রটেক্ট আওয়ার সিস্টার বিডি’ নামে একটি সংগঠন তাকে উদ্ধার করে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে।
-------------------------------------------------------------------------------------------------

নারী ও শিশু বিশেষত, তাদের প্রতি অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের হয়রানি, নানা ধরনের পর্নোগ্রাফিক ছবি ছাপানো এবং সেগুলো দিয়ে ভিডিও তৈরি করে পোস্ট করা, ব্ল্যাকমেইল করা– এগুলো মোটামুটি পুরোনো রোগে পরিণত হয়েছে। যদিও আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। তবুও বিভিন্নভাবে এর মাধ্যমে নারী ভয়াবহ সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন।

অন্যান্য সম্পর্কের মতো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও ঘটছে এগুলো। স্ত্রীকে হয়তো স্বামী ক্রমাগত ভয় দেখাচ্ছেন– তাঁর সঙ্গে না থাকলে বা তাঁর কথা না শুনলে নিজেদের অন্তরঙ্গ ছবিগুলো প্রকাশ করে দেবেন। কিংবা প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবণতার কারণে এগুলো একটি উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

আমাদের পূর্ববর্তী কোনো আইনে নারী ও শিশুকে এ ধরনের নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য কোনো বিধান ছিল না। ২০২৩ সালের সাইবার সুরক্ষা আইন অধ্যাদেশেও বিষয়টি খুব পরিষ্কার না। যৌন হয়রানি, ব্ল্যাকমেইলিংসহ বিভিন্ন হয়রানিকে একসঙ্গে করে একটি ধারাতে যুক্ত করা হয়েছে। এটি স্বীকৃতির দিক থেকে খুব  ছোট আকারে হলেও একটি পথ উন্মুক্ত হলো। এ আইনে অন্যায়কারীকে আগে থেকেই চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে ভার্চুয়াল পৃথিবীতে এই কাজ করা বেশ জটিল এবং ভার্চুয়াল জগতের অপরাধগুলো অত্যন্ত আকস্মিকভাবেই হয়ে থাকে। কে, কার সঙ্গে ব্যক্তিগত মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করছে এবং সেই যোগাযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কে, কার সঙ্গে কেমন সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছে– সেটি কোনোভাবেই মনিটর করা সম্ভব নয়। যদি তা মনিটর করার জন্য আইন করা হয়, সেটি আবার ব্যক্তিগত জায়গা লঙ্ঘন করবে।

ফলে অনলাইন নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়ার পরিবর্তে আমাদের অনলাইন সচেতনতা বাড়াতে হবে। ভার্চুয়াল জগৎ ব্যবহার করতে গিয়ে নিপীড়িত বা বিপদের মধ্যে পড়তে হতে পারে, সে জন্য নয় শুধু; সারা পৃথিবীর বৃহৎ অর্থনৈতিক লেনদেন ও ব্যক্তিগত তথ্যের ভান্ডার জমা থাকে এই ভার্চুয়াল জগতে। পশ্চিমা দেশগুলোতে অনলাইনে সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক অপরাধ ঘটে। এসব অপরাধ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার জন্যও দরকার সচেতনতা বাড়ানো। 

ব্যক্তিকেন্দ্রিক অপরাধ ছাড়াও অনলাইনে যে কোনো ধরনের তথ্য চুরি, তা ফাঁস করা কিংবা অন্য কাজে ব্যবহার করা– এগুলো সবচেয়ে বড় বিপদের জায়গা।

আসলে কীভাবে সচেতন ও সতর্কতার সঙ্গে অনলাইন ব্যবহার করা যায়, নিজের ক্ষতি যাতে না হয় কিংবা প্রলোভনের ফাঁদে না পড়া– রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই শিক্ষাগুলোর সঙ্গে প্রচার-প্রচারণাও বাড়ানো দরকার। তাহলে তরুণ প্রজন্মও বুঝতে পারবে যে কোনটা আসল বিষয়।

এর মধ্যেও যে সম্পর্কে বন্ধন আসলেই তৈরি হচ্ছে না, তাও কিন্তু না। আমি পেশাগত জীবনে বেশ কয়েকজনকে পেয়েছি, যাদের পরিচয় ফেসবুকের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে তাদের প্রণয় ও পরিণতি ঘটেছে। তাই অনলাইনের বিপদ কী, সেসব নিয়ে শিক্ষাদীক্ষা প্রচার-প্রচারণা যেমন দরকার, তেমনি শিক্ষা কার্যক্রমের মাঝেও এ বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্তি দরকার। প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হতে পারে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাদা করে এসব বিষয়ে কথা বলা এবং প্রচার-প্রচারণা চালানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। 

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ দায়িত্ব নিতে পারে। তাদের অবকাঠামো ও লোকবল সবকিছুই আছে। তাদের অতিরিক্ত একটি দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। যখনই এসব ইস্যু তৈরি হবে, তখন এবং তার আগে থেকেই মানুষের সঙ্গে হৃদ্যতা বাড়িয়ে সতর্ক করা। যখনই কেউ একজন বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছে, কোনোকিছু না জানিয়ে বা তাকে কেউ অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে– সে তথ্য জানার পর দ্রুততর সময়ের মধ্যে কাজ শুরু করা। ভিকটিমের অ্যাকাউন্ট অ্যাকসেস করার মাধ্যমে মূল ঘটনা বের করা। অ্যাকাউন্ট অ্যাকসেস বর্তমানে খুব কঠিন বিষয় না। তাহলে পরিস্থিতি অনেক বেশি খারাপের দিকে যাওয়ার আগে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করি।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

গ্রন্থনা : দ্রোহী তারা

আরও পড়ুন

×