ঢাকা বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫

যৌনপল্লি থেকে নারীর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

যৌনপল্লি থেকে নারীর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

ছবি:: নিলস ফিস্ক

ফারহানা আক্তার

প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২৫ | ০০:০০ | আপডেট: ২৯ জুন ২০২৫ | ১৮:১৭

এই গল্পটা সায়েমা খাতুন (ছদ্মনাম) ও তাঁর মায়ের। যিনি নিজের ভাগ্য নতুন করে লিখতে চেয়েছেন। সায়েমার জন্ম সমাজের সবচেয়ে নিষ্পেষিত এক বাস্তবতায়, খুলনা জেলার বানিশান্তার এক প্রথাগত যৌনপল্লিতে। তবে তিনি আজ হয়ে উঠেছেন শত নারীর অনুপ্রেরণা। সায়েমা ও তাঁর মা এখন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। সমাজের চোখে ব্রোথেল বা যৌনপল্লি শব্দটি অবজ্ঞার। সায়েমার মা ছিলেন একজন যৌনকর্মী। তিনি তাঁর অনাগত সন্তানের জন্য এক ভিন্ন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাই তিনি সন্তানের জন্য একটি যথাযথ পরিবেশ চেয়েছেন। সেই ভাবনাই তাঁকে তৈরি করে সংগ্রামী এক মা হিসেবে। তিনি ঝুঁকি নিয়েছেন, অবহেলা সহ্য করেছেন, বাস্তবতার কঠিন পরিস্থিতি দেখেছেন। হাল ছাড়েননি। সায়েমা বলেন, ‘আমার মা শিখিয়েছেন, জন্ম যেখানেই হোক, স্বপ্ন দেখার অধিকার আছে সবার।’

সায়েমার আরও এক বোন ও এক ভাই আছে। সায়েমা সবার ছোট। তাঁর মা বলেন, ‘আমি যদি জীবনে ঝুঁকি না নিতাম, আমার সন্তানরা হয়তো কখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারত না।’ এই অদম্য চেষ্টার ফলে সায়েমা পেয়েছেন একটি আলোকিত, সম্মানজনক এবং সম্ভাবনাময় নতুন জীবন।

১৯৯৮ সালে খুলনা জেলায় কার্যক্রম শুরু করে বেসরকারি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ‘দলিত’। শুরু থেকেই তারা যৌনপল্লি ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুদের মধ্যে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে সংস্থাটির বিভিন্ন প্রকল্পের পাশাপাশি ৭৪টি লার্নিং সেন্টারে প্রায় সাত হাজার শিশু পাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি, শিক্ষা উপকরণ, প্রতিভা বিকাশের সুযোগ, উপবৃত্তি এবং নানাবিধ সহায়তা। সায়েমা ছিলেন এমনই একটি লার্নিং সেন্টারের শিক্ষার্থী। সেখানে তাঁকে শুধু বইপত্রই দেওয়া হয়নি, লার্নিং সেন্টারের শিক্ষকদের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়াসহ গড়ে তোলা হয়েছে আত্মবিশ্বাস ও নেতৃত্বগুণ।

সায়েমার ভাষায়, ‘দলিত আমাকে শিখিয়েছে, আমি পারি। শিখিয়েছে অধিকার সম্পর্কে জানতে, লড়াই করতে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের লার্নিং সেন্টারের শিক্ষকরা নিয়মিত খোঁজ রাখতেন, উৎসাহ দিতেন, যা আমার আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে বড় ভূমিকা রেখেছে।’ সায়েমা জানান, যৌনপল্লির মেয়েদের জীবন সমাজের অন্য সাধারণ শিশুর মতো নয়। এখনও সেখানকার মেয়েদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মায়েরা বিয়ে দিয়ে দেন। সায়েমা বলেন, ‘আমার মা দলিতের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন, বাল্যবিয়ে কীভাবে একজন মেয়েশিশুর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন করে। শিক্ষা কীভাবে একজন নারীর জীবনে সুফল বয়ে আনতে পারে।’ সায়েমাসহ যৌনপল্লির অনেক মেয়েশিশুকে পড়াশোনার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে দলিত। সায়েমা আরও যুক্ত করেন, ‘আমি যৌনকর্মী মায়ের সন্তান। এর মানে এই নয় যে এটি একটি পেশা। কোনো নারী কেন যৌনকর্মীর জীবন বেছে নেন, আমাদের সেই কারণ খুঁজে বের করতে হবে।’

দলিতের প্রকল্প ব্যবস্থাপক প্রহ্লাদ কুমার দাস বলেন, ‘আমরা শুধু শিক্ষা দিই না, গড়ে তুলি নেতৃত্ব এবং সচেতনতা। সায়েমারা যেন নিজেদের অধিকার জানতে পারে, সেটিই আমাদের লক্ষ্য।’
প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক স্বপন কুমার দাস বলেন, ‘শিক্ষাই পারে সামাজিক কুসংস্কারের বেড়াজাল ভাঙতে। সায়েমারা প্রমাণ করেছে, সুযোগ পেলে এই মেয়েরাই পারে সমাজ 
বদলে দিতে।’

সায়েমার জীবনে শিক্ষার পাশাপাশি একটি বড় অনুপ্রেরণা ছিল তাঁর মায়ের সঙ্গে শৈশবের কাজ। যৌনকর্মীর কাজ ছেড়ে তাঁর মা একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হিসেবে নতুন জীবন শুরু করেন। সায়েমাও এতে সহায়তা করতেন। এসএসসি পাসের পর তিনি পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন ক্ষুদ্র ব্যবসায়। 

সায়েমার মতো অনেক নারী আজ নিজের জীবনকে বদলে দেওয়ার সাহস রাখেন শুধু তখনই, যখন সমাজ এবং প্রতিষ্ঠান তাদের পাশে দাঁড়ায়। তবে সমাজের প্রতিকূলতা যে সব কেটে গেছে, এমনও নয়। আমাদের সমাজে যৌনকর্মীর মেয়েকেও যৌনকর্মীর চোখে দেখা হয়। একজন নাগরিক হিসেবে তাঁর সামাজিক অধিকারের বিষয়গুলো এখনও নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। সায়েমার ক্ষেত্রেও ভিন্ন কিছু হয়নি। তবে কণ্ঠে খানিক হতাশা থাকলেও তাঁর স্বপ্ন আরও বড়, তিনি হতে চান একজন পুলিশ কর্মকর্তা।

সায়েমার গল্প যেমন একজন নারীর সাফল্যগাথা, তেমনি এটি সমাজ বদলের বার্তাও বহন করে। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তবেই বঞ্চনার চক্র ভেঙে নতুন প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখাতে, পথ দেখাতে সক্ষম হবো আমরা।

লেখক : উন্নয়নকর্মী

আরও পড়ুন

×