এক্মি বছরে ১৫০ টন এপিআই উৎপাদন করবে, আগামী মে মাসে শুরু
অবশেষে উৎপাদনে যাচ্ছে এপিআই শিল্প পার্ক
পুরোদমে উৎপাদন হলে বছরে এ খাতে সাশ্রয় হবে ১৪০০ কোটি টাকা

মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার বাউশিয়ায় এপিআই শিল্প পার্ক সমকাল
আবু হেনা মুহিব
প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৪ | ২১:২১
বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ১৮ কোটি ডলার বা ২ হাজার কোটি টাকার ওষুধ রপ্তানি হয়। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ বাজার প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার। রপ্তানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজার চাহিদার ৯৭ শতাংশই জোগান দেওয়া হচ্ছে স্থানীয় উৎপাদন থেকে। ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ২১৩টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে এখন। এসব প্রতিষ্ঠান তাদের ওষুধ উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রিডিয়েন্টসের (এপিআই) সামান্যই স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করতে পারে। প্রায় ৮৫ শতাংশ এপিআই আমদানি করতে হয়। এ বাবদ বছরে ব্যয় প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ১৩০ কোটি ডলার। আমদানি অনুমতির জটিলতা এবং বিদেশ থেকে কাঁচামাল আনার প্রক্রিয়ায়ও একটা লম্বা সময় লেগে যায়, যা হিসাবে নিলে ওষুধের কাঁচামাল আমদানি ব্যয় মোটামুটি বড় অঙ্কের।
বিশাল এই অর্থ সাশ্রয়ে দেশেই এপিআই উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ‘এপিআই শিল্প পার্ক’ স্থাপনে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় ২০০৮ সালে। এরপর নানা চড়াই-উতরাইয়ে ১৬ বছর পার। অপেক্ষার অবসান। আগামী মে মাসে এক্মি ল্যাবরেটরিজের চার ধরনের কাঁচামাল উৎপাদন শুরুর মাধ্যমে মূল কার্যক্রম শুরু হচ্ছে এপিআই পার্কে। দেশে এ ধরনের বিশেষায়িত পার্ক এটিই প্রথম।
এক্মি ল্যাবরেটরিজ সূত্রে জানা গেছে, চার ধরনের এপিআই উৎপাদন করা হবে। ২০১৮ সালে এপিআই শিল্প পার্কে ভূমির বরাদ্দ বুঝে পাওয়ার পর নানা প্রক্রিয়া শেষে এখন উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত। বছরে ১৩০ থেকে ১৫০ টন এপিআই উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তাদের। উৎপাদিত এপিআই নিজেদের ওষুধ তৈরি, অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি এবং পরবর্তী সময়ে রপ্তানি করা হবে। বিনিয়োগ করা হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫০০ কোটি টাকা। গত বছর টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেশ বেড়ে যাওয়ার কারণে পরিকল্পনার তুলনায় বিনিয়োগ ব্যয় বেড়েছে। এতে অন্তত ৫০০ লোকের কর্মসংস্থান হতে পারে। কাঁচামাল উৎপাদনেও কাঁচামাল লাগে। সেই কাঁচামাল আমদানির যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ। ভারত থেকে এপিআই আসতে এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এক্মি ল্যাবরেটরিজের পরিচালক শেখ মাকসুদুর রহমান সমকালকে বলেন, সব ধরনের প্রক্রিয়া এখন শেষের দিকে। মে মাসেই উৎপাদনে যাবেন তারা। তিনি বলেন, দেশেই এপিআই উৎপাদনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের প্রকল্প এই শিল্প পার্ক। তাঁর আন্তরিকতার কারণেই এত বড় বিনিয়োগে সাহস পেয়েছেন তারা। সরকারের অনেক সহযোগিতা তারা পেয়েছেন। তবে প্রয়োজনীয় সব ক্ষেত্রে সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া দেশে এপিআই উৎপাদন সার্থকভাবে করা সম্ভব হবে না।
কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। নাজুক পণ্য হিসেবে এসিডসহ বিভিন্ন রাসায়নিক আমদানি, পরিবহন ও পরিমাণমতো ব্যবহারের অনুমতি নিতে হয়। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হচ্ছে। এতে নানা ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হতে হয়। অর্থ ব্যয় হয়। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অকারণে সময় ব্যয় হয়, যা শেষ পর্যন্ত উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যায়।
শেখ মাকসুদুর রহমান বলেন, এর চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, স্বল্পোন্নত দেশের (এলিডিসি) কাতার থেকে উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পেটেন্টকৃত ওষুধ উৎপাদনে ছাড় সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। তখন রয়্যালটি ফি দিয়ে পেটেন্টকৃত কাঁচামাল দেশে আনতে হবে। এতে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে কয়েক গুণ। এ সুবিধা থাকতে থাকতেই দেশে এপিআই উৎপাদনে এগিয়ে যেতে হবে। যাতে ওই সময়সীমার পর যতটা সম্ভব কম আমদানি করা লাগে। এটা সম্ভব না হলে ওষুধের মতো অতি আবশ্যক পণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকবে না। প্রকারান্তরে যা জাতীয় স্বাস্থ্যসেবায় বড় ধরনের অভিঘাত ডেকে আনবে। রপ্তানি বাজারেও সক্ষমতা কমবে। এর আগেই সতর্ক হওয়া
উচিত। এপিআই উৎপাদন বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক করার মাধ্যমে এ খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করা প্রয়োজন।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বাণিজ্যসংক্রান্ত মেধাস্বত্ব (ট্রিপস) চুক্তি অনুসারে, এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ ওষুধের পেটেন্ট ছাড় পেয়ে থাকে। এ কারণে অন্য অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশে তুলনামূলক সুলভ মূল্যে ওষুধ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। ২০২৬ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উন্নীত হলে এ সুবিধা আর প্রযোজ্য হবে না। সে ক্ষেত্রে ওষুধ উৎপাদনে বিদেশি মেধাস্বত্বের জন্য বাংলাদেশকে রয়্যালটি ফি গুনতে হবে। এতে ওষুধের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে, যার প্রভাব পড়বে এর দামের ওপর।
দেশীয় ওষুধশিল্পের প্রসার, প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি, পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, ওষুধের মান উন্নয়নে গবেষণা এবং সর্বোপরি প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যেন বাংলাদেশেই উৎপাদন করা যায়– সে লক্ষ্যে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় ২১৬ একর জমির ওপর এপিআই শিল্প পার্ক প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ৩৮১ কোটি টাকা। প্রকল্পের মোট ৪২টি প্লট ২৭টি কোম্পানিকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে এক্মি ল্যাবরেটরিজ, হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, ইউনিহেলথ ইউনিমেড ফার্মাসিউটিক্যালস ও ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজ এ পার্কে কারখানা স্থাপন করেছে।
শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জে গজারিয়ার বাউশিয়ায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) ২০০৮ সালে এপিআই শিল্প পার্ক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করে। তবে ভূমি অধিগ্রহণসহ নানা জটিলতায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাজ এগোয়নি। প্রথমে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ২১৩ কোটি টাকা। এরপর দুই দফা সংশোধন করে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ৩৩১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। একরপ্রতি জমির দাম ধরা হয় ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা।
শিল্পসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের এপিআইর চাহিদার অন্তত ৫০ শতাংশ স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে মেটানো যাবে, যদি আরও বড় কোম্পানি শিল্পে বিনিয়োগ করে। তবে গ্যাসের মতো মৌলিক সেবার অপর্যাপ্ততায় এপিআই পার্কে বিনিয়োগ বিলম্বিত হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিসিকের চেয়ারম্যান সঞ্জয় কুমার ভৌমিক সাংবাদিকদের বলেন, অল্প সময়ের মধ্যেই শিল্প পার্কে গ্যাস সংযোগ পৌঁছে যাবে। ইতোমধ্যে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সঙ্গে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। পানি এবং অন্যান্য ইউটিলিটি সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার পরে দ্রুত ইউনিট স্থাপনের জন্য ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কাজ করবে বিসিক। যেসব কোম্পানি এখনও তাদের কারখানা স্থাপনের বিষয়ে কাজ শুরু করেনি, তাদের সঙ্গে শিগগিরই বৈঠকে বসবেন বলে জানান তিনি।
- বিষয় :
- শিল্প প্রতিষ্ঠান